বিপৎসংকুল সোমালি জলসীমা ও জলদস্যুদের শিকার যত জাহাজ!
কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার সময় ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুর কবলে পড়েছে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। এ সময় জাহাজটিতে ২৩জন ক্রু ছিলেন।
সোমালিয়ার জলদস্যুদের জাহাজে হামলা ও ছিনতাইয়ের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সোমালি গৃহযুদ্ধের শুরু থেকে সোমালিয়ার উপকূলের জলদস্যুরা আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০০৫ সাল থেকে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা জলদস্যুদের তৎপরতা বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
প্রাথমিকভাবে ২০০০ সালের গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক মাছ ধরার জাহাজগুলোতে হামলা চালালেও সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় (২০০৬-২০০৯) জলদুস্যুরা আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে হামলা চালানো শুরু করে।
২০১২ সালে সোমালিয়ার সরকারের তথ্য অনুযায়ী, জলদস্যুরা প্রাথমিকভাবে দেশের কেন্দ্রীয় অংশের গালমুডুগ অঞ্চল থেকে হামলা ও ছিনতাই পরিচালনা করতো। দেশটির আঞ্চলিক প্রশাসন একটি বড় জলদস্যুতা বিরোধী অভিযান শুরু করার পর এবং মেরিটাইম পুলিশ ফোর্স (পিএমপিএফ) প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত সোমালিয়ার উত্তরপূর্ব প্রদেশ পুন্টল্যান্ডে অবস্থিত বন্দরগুলো থেকে সমুদ্রে হামলা চালাতো জলদস্যুরা।
ওশেনস বিয়ন্ড পাইরেসির (ওবিপি) তথ্য অনুসারে, জলদস্যুদের কারণে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শিপমেন্ট খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কারণে বিশ্ব বাণিজ্যে বছরে আনুমানিক ৬.৬ থেকে ৬.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে।
সোমালি জলদস্যুদের জাহাজে হামলা এবং ছিনতাইয়ের কিছু ঘটনা
২০০৮ সালে সোমালি জলদস্যুরা ১১১টি হামলা চালিয়েছিল যার মধ্যে ৪২টি সফল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় জলদস্যুরা ডেনমার্কের মালিকানাধীন রাশিয়ান টাগবোট এমভি স্বিতজার কোরসাকভ ছিনতাই করেছিল। জাহাজটি পুন্টল্যান্ডের আইল শহরের কাছে আটকে রাখা হয়েছিল। আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস কার্নি ৭ লাখ মার্কিন ডলারের মুক্তিপণের বিনিময়ে ১৮ মার্চ ছয়জন ক্রুসহ জাহাজটি উদ্ধার করে।
২০০৯ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসেই জাহাজে হামলার হার ২০০৮ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি ছিল। ২০০৯ সালের মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৭৯টি আক্রমণ চালিয়ে সোমালি জলদস্যুরা ২১টিতে সফল হয়েছিল। এই আক্রমণগুলোর বেশিরভাগই এডেন উপসাগরে ঘটেছিল। পরবর্তীতে সোমালি জলদস্যুরা তাদের হামলার পরিসর বাড়িয়ে ভারত মহাসাগরের কেনিয়ার উপকূল থেকে দক্ষিণের জাহাজগুলোতে হামলা চালানো শুরু করে।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় উপকূল থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার (১৮৫ মাইল) দূরে লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জের কাছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাহান মনিতে হামলা করেছিল জলদস্যুরা। একই বছরের ১১ মে সোমালি জলদস্যুরা এডেন উপসাগরে একটি বুলগেরিয়ান পতাকাবাহী জাহাজ ছিনতাই করেছিল। পানেগা নামের জাহাজটি ১৫ জন বুলগেরিয়ান ক্রু সদস্য নিয়ে লোহিত সাগর থেকে ভারত বা পাকিস্তানে যাচ্ছিলেন। এটি ছিল বুলগেরিয়ান পতাকাবাহী জাহাজের প্রথম ছিনতাইয়ের ঘটনা।
২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় রয়্যাল নেদারল্যান্ডস নৌবাহিনীর কমোডর মিশেল হিজম্যানস বলেছিলেন, সাম্প্রতিক ছিনতাই করা জাহাজ ব্যবহারের মাধ্যমে জলদস্যুরা তাদের পরিসর বাড়িয়েছে এবং অপহৃত নাবিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এ বছর জলদস্যুরা সোমালি জলসীমা, ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ২১২টি হামলা চালিয়েছিল।
২০১২ সালে সোমালি জলদস্যুরা ৩৪টির মত জাহাজে হামলা চালায় ও ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর প্রচেষ্টা, জাহাজে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধি এবং সোমালিয়ায় স্থলভাগে উন্নয়নের জন্য সোমালি জলদস্যুদের আক্রমণের হার ২০১২ সালে হ্রাস পেয়েছিল। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) তথ্য অনুসারে, ২০১২ সালের অক্টোবরে মধ্যে জলদস্যুদের আক্রমণ ছয় বছরের মধ্য সর্বনিম্নে পৌঁছেছিল। ২০১১ সালের একই সময়ে জলদস্যুরা ৩৬ টি জাহাজে হামলা চালিয়েছিল।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ মার্কিন নৌ গোয়েন্দা অফিস রিপোর্ট করেছিল, জলদস্যুরা মাত্র নয়টি জাহাজ আক্রমণ করেছে এবং কোন সফল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি।
২০১৭ সালের ১৩ মার্চ পুন্টল্যান্ডের সোমালিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহর আলুলা থেকে কয়েক মাইল দূরে জলদস্যুরা এরিস ১৩ জাহাজটি ছিনতাই করেছিল। ২০১২ সালের পর এটিই ছিল বড় বাণিজ্যিক জাহাজের প্রথম ছিনতাইয়ের ঘটনা। জাহাজটি জিবুতি থেকে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিশুতে তেল নিয়ে যাচ্ছিল। প্রায় দুই ডজন সশস্ত্র জলদস্যু জাহাজটি ছিনতাই করেছিল।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ার উপকূল থেকে ১৬০ নটিক্যাল মাইল (৩০০ কিমি) দূরে জলদসুরা লেপার্ড সান জাহাজে গুলি চালিয়েছিল। জাহাজের নিরাপত্তা দল পাল্টা গুলি চালালে জলদস্যুদের জাহাজটি পালিয়ে যায়। ২০১৭ সালের নভেম্বরের পর এই এলাকায় এটিই প্রথম জলদস্যু হামলা বলে ধারণা করা হয়েছিল।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সোমালি জলদস্যুদের আক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় ভারত মহাসাগর হাই রিস্ক এরিয়া (এইচ) তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আইএমবি সতর্ক করে বলেছিল, সোমালি জলদস্যুদের এখনও এডেন উপসাগরীয় অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করার সক্ষমতা এবং জনবল রয়েছে।
২০০৫ সাল থেকে জলদস্যুতার জন্য ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি সোমালি যুবক বিদেশে বিভিন্ন কারাগারে বন্দী রয়েছেন। বেশিরভাগই যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ২০১৫ সালে আল জাজিরাকে জানিয়েছিল, প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন 'জলদস্যু এবং সন্দেহভাজন জলদস্যু' ২১টি দেশের আদালতে বা কারাগারে রয়েছে।