ইসরায়েলে হামলা না করার জন্য ইরানকে নিষেধ করতে চীনকে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র
ইরান যেন ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক হামলা না করে সেজন্য চীন, তুরস্ক, সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশকে তেহরানকে বোঝানোর অনুরোধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে জায়নবাদী রাষ্ট্রটির মারাত্মক হামলার প্রেক্ষাপটে ইরান যখন পাল্ট-আক্রমণের কঠিন সংকল্প করেছে, তখন এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ওয়াশিংটন।
এর মধ্যেই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইসহ অন্যান্য দেশের সমকক্ষদের সাথে কথা বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। এসব কথা হয়েছে চলতি সপ্তাহজুড়ে। দিনদুয়েক আগে মার্কিন গোয়েন্দারা ইরানের আসন্ন হামলা নিয়ে সতর্ক করেছে। এরপরেই ইসরায়েলকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাট মিলার বলেন, 'গত কয়েকদিন ধরে আমরা ইউরোপীয় মিত্রদের সাথেও এ বিষয়ে যোগাযোগ রাখছি। সংঘাতকে ছড়িয়ে দেওয়া যে ইরানের স্বার্থ, আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক স্বার্থের অনুকূল হবে না — ইরানকে এই স্পষ্ট বার্তা দিতে তাদেরকেও বলা হয়েছে।'
অন্যান্য আরব ও পশ্চিমা দেশের সরকারও সংযম প্রদর্শন করতে ইরানকে রাজি করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, কারণ তারাও আশঙ্কা করছে যে, ইরান যেকোনো মুহূর্তে ইসরায়েলে ব্যাপকতর হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইরানের কুদস ফোর্সের শীর্ষ তিন জেনারেলকে বিমান হামলায় হত্যা করেছে ইসরায়েল। ফলে ইরান তার আঞ্চলিক প্রক্সিদের ব্যবহার না করে সরাসরি প্রতিশোধমূলক হামলা করবে, এমন আশঙ্কাই দেখা দিয়েছে।
ইরানের পাল্টা-আঘাত অত্যাসন্ন বলে মিত্রদের জানিয়েছে ওয়াশিংটন। এসব আলোচনার বিষয়ে জ্ঞাত এক কূটনীতিক এমনটাই জানান প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে।
অবহিত আরেক কূটনীতিক বলেছেন, ওই সতর্কবার্তায় যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, ইরান নিজে সরাসরি হামলা করবে এমন সম্ভাবনা রয়েছে। এতে গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ, এটি একটি বৃহত্তর যুদ্ধে রূপ নেবে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, নিজ স্বার্থের ওপর ইরানের করা যেকোনো আক্রমণের পাল্টা-জবাব দেবে ইসরায়েল। তিনি জানান, ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আসা যেকোনো বাহ্যিক হুমকি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে তার সামরিক বাহিনী। 'যে আমাদের ক্ষতি করবে, আমরাও তাদের আঘাত করব,' বলেন তিনি।
শুধু গত সপ্তাহের ঘটনাতেই নয়, গত কয়েক মাস ধরেই ইরানকে বোঝাতে চীনের যে সমস্ত সুযোগ রয়েছে, তা কাজে লাগাতে বেইজিংকে অনুরোধ করেছে বাইডেন প্রশাসন। লোহিত সাগরে ইরান-সমর্থিত হুথিদের আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পরেও ওয়াশিংটন এমন অনুরোধ করেছে। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেন, তেহরানের ওপর চীনের কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগের প্রমাণ তারা পাননি।
গতকাল বৃহস্পতিবার জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যানালিনা বেয়ারবক তার ইরানি সমকক্ষ হোসেন আমির আব্দুলাহিয়ানের সাথে ফোনালাপ করেন। মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির বিষয়ে তাদের মধ্যে কথা হয়।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আঞ্চলিক সংঘাতকে আরও উস্কে দেওয়ার মধ্যে কারও স্বার্থ থাকতে পারে না। এই অঞ্চলের সকল পক্ষকে সংযম ও দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানাচ্ছি।'
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন জানান, তিনি আব্দুলাহিয়ানকে স্পষ্টভাবে বলেছেন, 'ইরান যেন কোনোভাবেই মধ্যপ্রাচ্যকে বৃহত্তর যুদ্ধের দিকে না নেয়।'
সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) ক্যামেরুন লিখেছেন, 'সম্ভাব্য ভুল সমীকরণ থেকে আরও সহিংসতা হওয়ার বিষয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।'
বুধবার রাতে আমির আব্দুলাহিয়ানের সাথে সৌদি আরব, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও ফোনালাপ করেছেন। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দামাস্কাসে তাদের কনস্যুলেটে হামলার (সম্ভাব্য) পরিণাম নিয়েই তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদানের সাথেও কথা বলেছেন আব্দুলাহিয়ান।
গত সপ্তাহে দামাস্কাসের ইরানি কনস্যুলেটে যে হামলা চালানো হয়, তাতে ইরানের শীর্ষ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হন। ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বুধবার প্রতিশোধের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, কনস্যুলেটে হামলা সরাসরি ইরানের ভূখণ্ডে হামলার শামিল। এজন্য ইসরায়েলকে অবশ্যই 'শাস্তি' পেতে হবে।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ইরান সরকারের এই অবস্থান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আমির আব্দুলাহিয়ান। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুসারে, আগ্রাসনকারীর বিরুদ্ধে 'বৈধ প্রতিরক্ষার' অধিকার আছে তার দেশের।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ডেভিড ক্যামেরুনকে আমির আব্দুলাহিয়ান বলেছেন, ইরান কখনো সংঘাতকে উস্কে দেওয়ার পক্ষে ছিল না, কিন্তু তাদের দামাস্কাস কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা এবং এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নীরবতা নেতানিয়াহুর 'যুদ্ধকামী' আচরণকে উৎসাহিত করেছে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনার স্ফুলিঙ্গ উস্কে দিয়েছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবরে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা ছিল আঞ্চলিক সংঘাতের দিক থেকে সবচেয়ে বড় উস্কানির ঘটনা। এই হামলা চালিয়ে নেতানিয়াহুর সামরিক বাহিনী পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাতের আগুন জ্বালানোর হুমকি তৈরি করেছে।
ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা যেভাবে বলেছেন, এ ঘটনা ইরানের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করেছে, তাতেই আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইসরায়েলে ইরানের সরাসরি আক্রমণ করবে।
খামেনির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, 'ইরান বা তার প্রক্সি বাহিনীগুলোর যেকোনো হুমকি থেকে ইসরায়েলকে নিরাপদ রাখতে আমাদের ইস্পাতদৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে।' ইহুদি রাষ্ট্রকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র 'সাধ্যের সবকিছু' করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মার্কিন এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, দামাস্কাসে হামলার পর ওয়াশিংটনকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল ইরান। জবাবে ওয়াশিংটন 'এ অঞ্চলে সহিংসতা আরও বাড়াতে এ হামলাকে ওজর হিসেবে ব্যবহার না করতে এবং মার্কিন স্থাপনা ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা না চালাতে' তেহরানকে সতর্ক করে দেয়।
গত ছয় মাসে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাক সীমান্তে ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে গুলি বিনিময় করেছে ইসরায়েল। অন্যদিকে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে একাধিক বাণিজ্য জাহাজের ওপর হামলা চালিয়েছে।
দামাস্কাসে কনস্যুলেটে হামলার দায় স্বীকার করেনি ইসরায়েলে। ২০২০ সালে ইরানি শীর্ষ সামরিক নেতা কাসেম সোলাইমানিকে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যার পর এ হামলাকেই ইরানের সশস্ত্রবাহিনীর ওপর সবচেয়ে তীব্র আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
তবে কনস্যুলেটে হামলার জন্য ইরান, সিরিয়া ও তেহরানের সমর্থনপুষ্ট হিজবুল্লাহ সবাই ইসরায়েলেকে দায়ী করেছে। ইরানি কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, হামলার জবাব দেওয়া হবে।
ইরানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও প্রতিশোধমূলক হামলার পক্ষে খবর প্রকাশ করেছে। ইসরায়েলি বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানের হামলা হতে পারে এর প্রক্সি হিজবুল্লাহর মাধ্যমে অথবা খোদ ইরান ইসরায়েলের ওপর হামলা চালাতে পারে। বলা বাহুল্য, এতে এ অঞ্চলের চলমান সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়ার বড় আশঙ্কা তৈরি হবে।
গত সপ্তাহে একজন ইরানি কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েলি দূতাবাসগুলো 'এখন আর নিরাপদ নয়'। ফলে এগুলো সম্ভাব্য হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বলেও জল্পনা তৈরি হয়েছে।