‘আদুজীবিতাম’: উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রবাসী কর্মীদের নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছে যে সিনেমা
কাজের সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া দারিদ্র্যপীড়িত ভারতীয়দের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা মালয়ালম ভাষার একটি চলচ্চিত্র দেখতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে সিনেমা হলগুলোতে।
২০০৯ সালে প্রকাশিত বেস্টসেলিং মালয়ালম বই অবলম্বনে তৈরি 'আদুজীবিতাম (গোট লাইফ)' সিনেমায় ভারতীয় অভিবাসী নাজিবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পৃথ্বীরাজ সুকুমারান। সৌদি আরবে নাজিবকে অপহরণ করে ক্রীতদাসের মতো মরুভূমিতে ছাগল পালনকারীর কাজ করতে বাধ্য করা হয়। নাজিব নামের এক ব্যক্তির জীবনের সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত এ গল্প। ১৯৯০-এর দশকে সৌদি আরবে অপহরণের শিকার হন তিনি। এর দুই বছর পর তিনি সেখান থেকে পালাতে পারেন।
'আদুজীবিতাম' বইটি কোনো অংশেই থ্রিলার উপন্যাসের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের সাংস্কৃতিক ভিত্তিপ্রস্তরে পরিণত হয়েছে এ বই। চলতি বছরই বইটির ২৫০তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে! এ বইয়ের ব্যাপক সাফল্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে অভিবাসীদের জীবনের নির্মম বাস্তবতাকে আলোচনার কেন্দ্রে টেনে এনেছে।
প্রায় তিন ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের সিনেমাটিও বক্স অফিসে দারুণ করছে। মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই ছবিটি বিশ্বব্যাপী ৮৭ কোটি রুপি আয় করে নিয়েছে। সমালোচকরা চলচ্চিত্রটিকে 'অসাধারণ সারভাইভাল ড্রামা' এবং 'পাশবিক লড়াইয়ের সিনেমাটিক চিত্রায়ন' বলে আখ্যা দিয়েছেন।
'আদুজীবিতাম'-এ দেখা যায় বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নাজিবকে। ঊষর, খরতপ্ত, বৈরী মরুভূমিতে মনিব ও প্রাণীদের সঙ্গে তিনি একা। নিকটতম সড়কও বহু মাইল দূরে। কারও সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তার কাছে নেই কোনো ফোন, কাগজ কিংবা কলম। আর নেই বন্ধু বলে ডাকার মতো একজন মানুষও। প্রাণীরা যে পাত্র থেকে পানি খায়, তিনিও সেই একই পাত্রের পানি পান করেন।
একটি দৃশ্যে দেখা যায়, নাজিব তার মালিককে মাতৃভাষা মালয়ালমে বলছেন, সবকিছু বিক্রি করে পরিবার ছেড়ে কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সেসব কথা বলতে বলতে নাজিবের দুচোখ দিয়ে অশ্রুর বান ডাকে। মালিককে কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করেন, 'দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।' কিন্তু নাজিবের মালয়ালাম ভাষার কথার কোনো অর্থই বহন করে না তার আরবিভাষী মালিকের কাছে।
কেরালার প্রায় ২১ লাখ মানুষ প্রবাসী। তাদের ৯০ শতাংশই উপসাগরীয় দেশগুলোতে অভিবাসী হয়েছেন। বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে রাজ্যটির পাঁচ দশকের বেশি সময়ের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের সুবাদে এসব দেশে অভিবাসী হন তারা।
দরিদ্র পরিবারের এই প্রবাসী কর্মীদের অনেকেই এসব দেশের কাফালা ব্যবস্থার জন্য ভীষণ ভোগান্তি সহ্য করেছেন। এ ব্যবস্থায় প্রবাসীদের থাকা ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে তাদের স্পন্সর। ফলে এই কর্মীদের ইচ্ছামতো নিপীড়ন ও শোষণ করার সুযোগ পেয়ে যায় স্পন্সররা। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো আয়ে মজবুত হয়েছে কেরালার অর্থনীতির ভিত। সরকারের একটি থিঙ্কট্যাঙ্কের তথ্যমতে, ভারতে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম এ রাজ্যে।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজের নির্মম পরিবেশ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে।
শ্রম অভিবাসন নিয়ে গবেষণা করা মনিপাল সেন্টার ফর হিউম্যানিটিজ-এর মোহাম্মদ শফিক কারিনকুরায়িল প্রবাসী কর্মীদের দুর্দশা প্রসঙ্গে বলেন, 'আপনার পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়, আপনি দেশে ফিরতে পারেন না, আপনাকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়।'
ইউটিউবে এক সাক্ষাৎকারে নাজিব—যার জীবনের ওপর ভিত্তি করে বই ও চলচ্চিত্রের কাহিনি গড়ে উঠেছে—বলেন, কাহিনিতে বর্ণিত জায়গাগুলোতে তিনি আর কখনোই ফিরতে পারবেন না।
তিনি বলেন, 'আমি ১৯৯১ সালে অনেক স্বপ্ন নিয়ে [কেরালা] ছাড়ি। সেখানে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে—নির্মম মনিব আর ছাগলের পালের সঙ্গে জীবন—তাতে আমি আত্ম-চেতনা এবং মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে ফেলেছি।'
২০০৮ সালে সিনেমার পরিচালক ব্লেসি বইটির চলচ্চিত্র নির্মাণ স্বত্ব কিনে নেন। পৃথ্বীরাজ সুকুমারান বিবিসিকে বলেন, পরিচালক যখন এর পরের বছর বইটির একটি কপি তাকে দেন, ততদিনে দিনে এর প্রায় পুরো ঘটনাই জেনে গেছেন। 'মানুষ বইটা নিয়ে এত বেশি কথা বলছিল যে গল্পটার সব ঘটনাই আমি জানতাম। বিশেষ করে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে কথা হচ্ছিল বেশি। কিন্তু তারপরও বইটা পড়ার পর আমি রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে যাই।'
তিনি বলেন, 'এ গল্পের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে তাদের পরিচয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই মানুষটি ধীরে ধীরে তার মানুষ পরিচয় হারিয়ে, প্রাণীগুলোর সান্নিধ্যে থেকে তাদের একজন হয়ে উঠছে। আমি আগে কখনও এরকম কিছু পড়িনি।'
সিনেমায় নাজিব ধীরে ধীরে মালয়ালম বলা বন্ধ করে দেন; শুধু ছাগলের মতো আওয়াজ করেন। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা আমের আচার চেখে দেখেন।
দীর্ঘ ১৬ বছরের অপেক্ষার পর চড়া খরচ, প্রোডাকশনের ঝামেলা ও মহামারির ধাক্কা সামলে অবশেষে পর্দায় মুক্তি পেয়েছে 'আদুজীবিতাম'। নিজের সঞ্চয়ের অর্থ খরচ করে এ সিনেমা বানিয়েছেন পরিচালক। ব্লেসি বলেন, গল্পের 'নির্যাস ধরতে' তিনি উপন্যাসের মাত্র ৪৩টি পৃষ্ঠা পর্দায় এনেছেন।
মুক্তির পর প্রথম ছুটির দিনে মানুষ হয় সিনেমাটি দেখার অথবা দেখার জন্য টিকেট কাটার কথা বলেছে। বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে দেখা গেছে, মানুষ অশ্রুসজল চোখে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসছেন। বলছেন, সিনেমাটি তাদের আবেগকে অসাধারণভাবে ছুঁয়ে গেছে।
একজন নারী বলেন, 'এ গল্প আমার খুব ভালোমতোই জানা আছে। কিন্তু তারপরও মনে হয়েছে, ছবিটা না দেখলেই ভালো করতাম—এমনই বেদনাদায়ক ছিল এই কাহিনি।