গাজার গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজে
গত ৭ অক্টোবর থেকে চলমান যুদ্ধে গাজা যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। উপত্যকাটিতে মায়েরা তাদের নিখোঁজ সন্তানদের হন্য হয়ে খুঁজছেন। এক্ষেত্রে যতক্ষণ তাদের দেহে শক্তি আছে, তারা নিজের সন্তানকে খুঁজেই যাচ্ছেন।
চলমান কঠিন পরিস্থিতিতে অনেক মা জানেই না যে, তার সন্তান জীবিত আছে না-কি মৃত। তবে এটা মুখ্য বিষয় নয়। বরং সন্তানের খোঁজ করতে হবে, এটাই মূল কথা।
চারদিন ধরে গাজার নাসের হাসপাতালের গণকবরে কোলাহল, ধুলোবালি ও প্রবল দুর্গন্ধের মাঝে সন্তানের খোঁজ করছেন কারিমা এলরাস। গত ২৫ জানুয়ারি তার ২১ বছর বয়সী সন্তান আহমেদ খান ইউনিস শহরে নিহত হন। এরপর থেকে তার মরদেহ নিখোঁজ রয়েছে। অবশেষে গত মঙ্গলবার কারিমা তার ছেলের মরদেহ খুঁজে পেয়েছে।
এই বিষয়ে কারিমা বলেন, "আমি এখানে প্রতিনিয়ত আসছিলাম। যতক্ষণ না আমি আমার আদরের ছেলে আহমেদের লাশ না পাই। ১২ বছর বয়সে সে তার বাবাকে হারিয়েছিল এবং আমি তাকে বড় করেছিলাম।"
শুধু কারিমাই নয়, অন্যান্য পরিবারগুলোকেও কবরের লাইন বরাবর হাঁটতে দেখা যায়। এমন হতাশাজনক দৃশ্য বিশ্বজুড়ে প্রায় সব যুদ্ধক্ষেত্রেই কমবেশি চোখে পরে।
চলমান গাজা যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। সেক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ছোট এই উপত্যকাটিতে মৃতদেহগুলোকে কবর দেওয়া বেশ জটিল ও বিপজ্জনক।
ইতোমধ্যেই কিছু কবরস্থান পূর্ণ হয়ে গেছে। আর কিছু কবরস্থানে ইসরায়েলের সাথে হামাসের তথাকথিত লড়াই চলার কারণে পৌঁছানো অসম্ভব। এমতাবস্থায় ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে মৃতদেহগুলোকে হাসপাতাল প্রাঙ্গণেই কবর দেওয়া হয়েছে।
গাজার চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাইরে থেকে সাংবাদিকেরা প্রবেশ করতে পারছে না। লাশের ফরেনসিক রিপোর্টও ঠিকঠাক করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নাসের হাসপাতালে ও গাজা শহরের উত্তরে আল-শিফা হাসপাতালের গণকবরে থাকা মৃতদেহগুলো থেকে তাদের মৃত্যুর কারণ জানার উপায় নেই।
এক্ষেত্রে কেউ হয়তো ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন। আবার কেউ হয়ত খাবারের অভাব কিংবা অপুষ্টিতে মারা গেছেন। একইসাথে মরদেহগুলোকে ইসরায়েল এক কবরস্থান থেকে অন্য কবরস্থানে সরাচ্ছে কি-না, সেটাও স্পষ্ট নয়।
বিবিসি ভেরিফাই গত ২২, ২৫ ও ২৮ জানুয়ারি অনলাইনে পোস্ট করা ভিডিওগুলি যাচাই করেছে। যাতে দেখা যায় নাসের হাসপাতাল প্রাঙ্গণের দুটি স্থানে মৃতদেহ দাফন করা হচ্ছে৷
আশেপাশের এলাকায় তীব্র হামলা চালু থাকায় সাময়িকভাবে হাসপাতালেই মরদেহগুলোকে কবর দেওয়া হয়। একইসাথে ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতালটি ঘিরে রাখাও এমনটি করার অন্যতম কারণ।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সেখানে ইসরায়েলি অভিযান শুরুর আগে ঠিক কত লাশ দাফন করা হয়েছিল তা নিশ্চিত করতে পারেনি বিবিসি। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ২৭ জানুয়ারি জানায়, ১৫০ জনের মৃতদেহ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়েছে। তবে এখন সংখ্যাটি যাচাই করা প্রায় অসম্ভব।
গাজার সিভিল ডিফেন্স ফোর্স জানায়, ৩৩০ টিরও বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তারা কখন ও কীভাবে মারা গিয়েছিল সে সম্পর্কে ধোঁয়াশা রয়েছে। নাসের হাসপাতালের কর্মকর্তারা অবশ্য ইসরায়েলি অভিযানের আগে দাফন করা মৃতদেহগুলো সম্পর্কে রেকর্ড রাখতে পারে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, নিহতদের মধ্যে হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের কেউ ছিল কি-না তা দেখার জন্য তারা মৃতদেহগুলোকে উত্তোলন ও পরীক্ষা করেছে। পরবর্তীতে সেগুলোকে ফের কবর দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু স্কাই নিউজের কাছে থাকা ভিডিও ও স্যাটেলাইট ইমেজ যাচাই করে দেখা যায়, অভিযানের সময় ইসরায়েলি বুলডোজার হাসপাতাল প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে চলে গেছে। যার ফলে সেখানকার দৃশ্যমান ক্ষতি হয়েছে।
ফিলিস্তিনে নিয়োজিত জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের পরিচালক অজিথ সুংহে মনে করেন, কবরগুলি নিয়ে একটি স্বাধীন ফরেনসিক তদন্ত হতে হবে। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের আরেক কর্মকর্তা জানান, কবরে কয়েকজনের হাত বাঁধা লাশ পাওয়া গেছে।
উদ্ধার ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের সাথে যুক্ত প্যালেস্টাইন সিভিল ডিফেন্সের এক কর্মকর্তা বিবৃতিতে বলেন, মৃতদেহগুলোকে হাতকড়া পরা অবস্থায় পাওয়া গেছে। অন্যদের মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখা গেছে এবং কয়েকজনকে বন্দিদের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দেখা গেছে।
রিম জেইদান দুই সপ্তাহ ধরে তার ছেলের নাবিলের লাশের সন্ধান করেছে। যা গতকাল (বুধবার) বিকেলে পাওয়া গেছে।
জেইদান জানান, তার ছেলের মরদেহ হাত বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং নির্যাতনের চিহ্ন দেখেছেন। তিনি বলেন, "তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কারো কারো হাত-পা একসাথে বেঁধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কবে নাগাদ এসব চলবে?"
হাত বাঁধা লাশ পাওয়ার প্রমাণ আছে কি-না সেটা সুংহের কাছে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে তিনি বলেন, "আমাদের কাছে এখনও প্রমাণ নেই। তবে আমাদের কাছে তথ্য আছে। এখন সেই তথ্য বিভিন্ন উত্স থেকে নিশ্চিত করা দরকার। ঠিক সে কারণেই আমাদের একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত প্রয়োজন।"
সুংহে বলেন, "ইসরায়েলের অনুমতি ও নিরাপদে প্রবেশের নিশ্চয়তা পেলে গাজায় কাজ শুরুর জন্য তার দল প্রস্তুত রয়েছে।" অন্যদিকে হাসপাতালে হত্যা করে কবরের যে অভিযোগ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে উঠেছে সেটিকে 'মানহানিকর' আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে তেল আবিব।
বিবৃতিতে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স জানায়, "আইডিএফ ফিলিস্তিনিদের লাশ দাফন করেছে এমন দাবি ভিত্তিহীন ও অপ্রমাণিত।" বরং তাদের দাবি, শুধু মরদেহগুলোর মধ্যে ইসরায়েলি জিম্মি আছে কি-না শুধু সেটাই যাচাই করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, "যাচাইটি সতর্কতার সাথে করা হয়েছে। এটি এমন সব জায়গায় করা হয়েছে যেখানে জিম্মিদের থাকার গোয়েন্দা তথ্য ছিল। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির মর্যাদা বজায় রেখে সম্মানের সাথে যাচাই করা হয়েছিল।"
অন্যদিকে স্বজনদের লাশের খোঁজ করা ও সম্মানজনকভাবে দাফনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ফিলিস্তিনিরা। ঠিক তেমনি একজন সোমায়া আল-শোরবাগি।
সম্প্রতি তিনি নাসের হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে স্বামী ওসামার মৃতদেহ উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে পরিবারের বাকি সদস্যদের পাশে একটি কবরস্থানে দাফন করেন।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান