পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড়
বিজ্ঞানীরা এর জীববিজ্ঞান বা আচরণ সম্পর্কে জানার সুযোগ পাওয়ার আগেই লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে।
এমনকি দ্বীপের বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা খুব কমই এই বাদুরকে স্বচক্ষে দেখেছেন। বোঝা যাচ্ছে, লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড় দীর্ঘকাল ধরে একটি বিপন্ন বাদুড় হিসেবে বিবেচিত ছিল।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামে পাওয়া এক ধরনের বৃহৎ প্রজাতির বাদুড়ের রহস্যময় জাত ভাই এই বাদুড়।
ফল খেয়ে বাঁচা অন্যান্য বাদুড়ের মতোই, লিটল মারিয়ানা প্রজাতির এই বাদুড় আকারে খুবই ছোট। এর মুখ শিয়ালের মতো এবং দেহ বাদামি ও লোমশ। তাই এর আরেক নাম মারিয়ানা বা গুয়ামের উড়ন্ত শিয়াল।
১৯৬০-এর দশকে স্থানীয় লোকজনের শিকার করা কয়েক ডজন বাদুড়ের ওপর চালানো এক জরিপে লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড়ের মাত্র একটি নমুনা পাওয়া যায়।
গুয়ামের উত্তর উপকূলের তারাগু ক্লিফে গুলিবিদ্ধ হয় একটি মেয়ে বাদুড়। সে কিছুদিন আগেই সন্তান প্রসব করেছে এবং ওই দিন পর্যন্ত স্তন্যদান করেছে। তাই তার বাচ্চা থাকার কথা।
ধারণা করা হয়, গুলি চালানোর পরে সেটি উড়ে যায়, অন্য কোথাও গিয়ে মারা যায়।
পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের গবেষণা করা তৃতীয় লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড় ছিল এটি। এর আগে, ১৯৩০ এর দশকে একজন প্রকৃতিবিদ দুটি পুরুষ বাদুড় সংগ্রহ করেছিলেন।
জানা যায়, এই বাদুড়টি ছিল মাঝারি আকারের, প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার (৫.৯ ইঞ্চি) লম্বা এবং আধা মিটারেরও বেশি দীর্ঘ ছিল এর ডানা।
লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড় 'মেগাব্যাট' পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বিশ্বের বেশ কয়েকটি বৃহৎ বাদুড় রয়েছে।
আমরা এই বাদুড়ের জীববিজ্ঞান সম্পর্কে বেশি তথ্য জানি না। যেমন: এটি কোন খাবার পছন্দ করে বা কখন এটি প্রজনন করে এসব আমাদের অজানা। গুয়ামের বৃহত্তর বাদুড় প্রজাতির সঙ্গে কীভাবে এদের মিথস্ক্রিয়া হয়েছিল, আমরা তাও জানি না।
লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড় প্রায় অজানা প্রজাতি হিসেবেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।
টানা কয়েক বছর এর দেখা না পাওয়া যাওয়ায়, গত বছর ইউএস ফিস অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করা বাদুড় গবেষক ট্যামি মিলডেনস্টাইন বলেন, 'এগুলোকে দেখলে আমি অবশ্যই চিনতে পারব।'
তিনি বলেন, পৃথিবীতে এখনও এই প্রজাতির বাদুড় টিকে থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে। হয়ত গুয়ামের কোথাও তারা লুকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তিনি ফিলিপাইনের বেয়ার ব্যাকড ফ্রুট বাদুড়ের কথা উল্লেখ করেছেন।
১৯৬০ থেকে ১৯৯০ এর দশকের মধ্যে এই প্রজাতির কোনো বাদুড়ের দেখা মেলেনি, তাই এটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০০ সালে এটি পুনরায় আবিষ্কৃত হয়।
ফিলিপাইনের নেগ্রোস দ্বীপের চেয়ে গুয়াম অনেক ছোট জায়গা। সেখানে বেশিরভাগই ফিলিপাইনের বেয়ার ব্যাকড ফ্রুট বাদুড় বাস করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুয়ামে বাদুড় নিয়ে প্রচুর জরিপ করা হয়েছে।
টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটির টিগা কিংস্টন বলেন, লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড় যদি সত্যিই সেখানে টিকে থাকত, তাহলে এতদিনে হয়ত এদের দেখা পাওয়া যেতো।
তবে একটি প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত, তা হলো লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড় আসলে অন্য কোনো দ্বীপে উদ্ভূত হয়েছিল, নাকি গুয়ামই তাদের আদি নিবাস।
মিল্ডেনস্টাইনের মতে, সম্ভবত এই বাদুড়গুলোর একটি দল কোনো এক ঝড়ের সময় গুয়ামে উড়ে গিয়েছিল। এই দ্বীপে তাদের বিলুপ্তির এটি একটি যুতসই ব্যাখ্যা হতে পারে।
কিংস্টন বলেন, এটি একটি 'বিশাল ট্র্যাজেডি' যে আমরা এই প্রজাতিটি হারিয়ে ফেলেছি। কারণ এটি সম্ভবত দ্বীপে উদ্ভিদের পরাগায়ন বা বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের উচিত এই বিলুপ্তি থেকে শিক্ষা নেওয়া।
গত বছর ফলের বাদুড় নিয়ে একটি গবেষণাপত্রের সহ-লেখক কিংস্টন বলেন, 'এই প্রজাতির বাদুড়ের শেষ পরিণতি হয়ত ক্যানারি বাদুড়ের মতোই। প্রতিনিয়ত বাদুড়ের আরও অনেক প্রজাতি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্তির মুখে পড়ছে। বিশেষত ক্ষুদ্র বিভিন্ন দ্বীপে বসবাসরত বাদুড়েরা বিপন্নের গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত ঝড়ের পরিমাণ বাড়ছে।
আবাসস্থল হ্রাস, শিকারের চাপ এবং চরম আবহাওয়া প্রভৃতি কারণে বাদুড়েরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করা শুরু করে। তাই যখন বিপদে পড়ে, এই বাদুড়দের পালানোর কোনো জায়গা থাকে না।
কিংস্টন বলে, 'বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এরা বিভিন্ন চরম ও ভয়াবহ সমস্যায় পড়ে।'
তিনি আরও বলেন, ওল্ড ওয়ার্ল্ড ফ্রুট বাদুড়ের ৭৫টি বড় প্রজাতির বেশিরভাগই (৭১ শতাংশ) হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের বিষয়ে সচেতন না হলে, শিগগিরই এদের বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
মিল্ডেনস্টাইন আশা করেন, এ ধরনের বিপর্যয় আমাদের দেখতে হবে না।
তিনি এবং তার সহকর্মীরা মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড়ের পাশাপাশি বৃহত্তর গুয়াম বাদুড় নিয়েও গবেষণা করছেন। বিপন্ন এবং দ্বীপে বসবাসকারী অবশিষ্ট একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী গুয়াম বাদুড়।
মাঝে মাঝে এই বাদুড় শিকার করা হয়, তবে ধীরে ধীরে স্থানীয়দের মনোভাব পরিবর্তিত হচ্ছে
তিনি বলেন, 'এখনও বিভিন্ন জায়গায় প্রাণী শিকার করে পাচার চলছে। তবে আমার ধারণা, বাদুড়দের বিষয়ে আগের চেয়ে স্থানীয়রা অনেক বেশি সচেতন। '
দুঃখের বিষয় হলো, লিটল মারিয়ানা ফ্রুট বাদুড়ের কথা ভাবতে আমরা দেরি করে ফেলেছি। এই প্রজাতি চিরকাল রহস্যে থেকে যাবে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি