দ্বিতীয় সপ্তাহেও চলছে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ; উত্তপ্ত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জুড়ে চলছে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি। এর শুরুটা হয় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল গাজার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। দ্রুতই এ বিক্ষোভের উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সহ ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভের কারণে গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে তাদের অনুষ্ঠান বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
সম্প্রতি আন্দোলনে যোগ দেওয়া সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক (সিইউএনওয়াই)-এর শিক্ষার্থীরা 'বর্ণবাদে আর বিনিয়োগ নয়' এর মতো স্লোগানসহ ব্যানার নিয়ে ক্যাম্পাসে একটি প্রতিবাদশিবির স্থাপন করেছে।
সিইউএনওয়াই বিক্ষোভের একজন ছাত্র সংগঠক গ্যাবি আওসি আল জাজিরাকে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থী তরুণদের এভাবে একত্রিত হওয়া দেখতে অনেক ভালো লাগছে। তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইসরায়েলিদের সাথে তাদের সম্পর্কের জন্য জবাবদিহি করছে এবং আহ্বান জানাচ্ছে তাদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার।'
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারা বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেছেন এবং অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছেন। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ায় বিক্ষোভকারীদের ধরপাকড় চলছে এবং ক্যাম্পাসগুলো থেকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সরে যেতে বাধ্য করার জন্য পুলিশ ডেকে আনছে কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রকাশিত ভিডিওতে শত শত শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকদেরও জোর করে গ্রেপ্তার করতে দেখা গেছে।
শনিবার সকালে বোস্টনে নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের একটি প্রতিবাদশিবির খালি করে পুলিশ। কয়েক ডজন শিক্ষার্থী দূর থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও তারা প্রতিরোধ গড়তে পারেনি।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে দু'দিন আগে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভটিতে প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন পেশাদার সংগঠকদের অনুপ্রবেশ ঘটছে, এজন্য তাদের খালি করা হয়েছে। এছাড়া কিছু বিক্ষোভকারী ইহুদি-বিদ্বেষী ভাষা ব্যবহার করেছিল।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ পোস্ট করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'আমরা আমাদের ক্যাম্পাসে এই ধরনের ঘৃণা সহ্য করতে পারি না।'
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে প্রায় এক সপ্তাহ আগে ক্যাম্পাসে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনপন্থী কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারা শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয় যদি আবার নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগকে শিক্ষার্থী উচ্ছেদ করতে ডেকে আনে তবে এটি ক্যাম্পাসের উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করবে এবং যা ঘটছে তা আরও উসকে দেবে।'
কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা এবং রাজ্য কর্মকর্তারা এই বিক্ষোভকে 'ইহুদিবিদ্বেষী' বলে অভিহিত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
বিক্ষোভকারীরা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছেন, অনেক ইহুদিরাও তাদের সাথে আন্দোলনে শামিল হয়েছেন।
গাজার প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলো থেকে নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বিচ্ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল সেটি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
জার্মান সরকারের কাছে ইসরায়েলে অস্ত্র রফতানি বন্ধের দাবিতে বার্লিনে আন্দোলনকারীরা পার্লামেন্টের সামনে প্রতিবাদশিবির স্থাপন করেছেন।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিখ্যাত সায়েন্সেস পো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারীরা শুক্রবার কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসের একটি ভবন অবরোধ করে কর্তৃপক্ষকে অনলাইনে ক্লাস নিতে বাধ্য করেছেন।
শনিবার সুইডেনে ফিলিস্তিনের সমর্থনে সর্বশেষ সমাবেশে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে 'ফ্রি প্যালেস্টাইন' ও 'বয়কট ইসরায়েল' স্লোগান দিচ্ছেন।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে শনিবার বিকেলে শত শত লোক সেন্ট্রাল লন্ডনে জড়ো হয়েছিল।
লন্ডন থেকে আল জাজিরার সংবাদদাতা হ্যারি ফসেট বলেন, 'লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে বড় ধরনের বিক্ষোভের জন্য পার্লামেন্ট ভবনের ঠিক বাইরে পার্লামেন্ট স্কয়ারে লোকজন জড়ো হচ্ছে।'
প্যালেস্টাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেইনের পরিচালক বেন জামাল জানান, তিনি আশা করছেন যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ এতে অংশ নেবেন।
তিনি বলেন, 'আবারও আমরা দ্বৈত বার্তা দিচ্ছি। একটি হলো ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতির বার্তা যে আমরা তাদের পাশে আছি। আর, দ্বিতীয় বার্তাটি হলো ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গণহত্যার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পৃক্ততার অবসান ঘটাতে হবে।'
সমালোচকদের এ বিক্ষোভকে ইহুদিবিদ্বেষী দাবি করলেও জামাল তা প্রত্যাখান করেছেন।
তিনি বলেন, ইসরায়েলের এই কৌশলটি খুব পরিচিত। যারা ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কথা বলছে তাদের নীরব করার জন্য ইসরায়েল বিশ্বব্যাপী এটি ব্যবহার করে।'
ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক কৌশলবিদ রিনা শাহ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভকে গণতন্ত্রের প্রদর্শন হিসেবে বর্ণনা করেছেন, বিশেষ করে নির্বাচনের বছরে যখন গাজার সংঘাতের কারণে ভোটারদের উদাসীনতা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়।
তিনি শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ ও অহিংস কর্মকাণ্ডকে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন এবং যেখানে করদাতাদের অর্থ ইসরায়েলিদের বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে উদ্বেগের ইতিবাচক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখেন।
রিনা শাহ্ বলেন, 'এই শিক্ষার্থীরা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে আমেরিকার ভূমিকা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। একদিকে আমরা ইসরায়েলিদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করছি, অন্যদিকে আমরা গাজায় মানবিক সাহায্য পাঠাচ্ছি। এই ভণ্ডামি নিয়েই উদ্বিগ্ন এই শিক্ষার্থীরা।'
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন