ভারতের নির্বাচনে গোপন ‘পরামর্শকের’ কাজ করছে বেকার ইঞ্জিনিয়ার, এমবিএ ডিগ্রিধারীরা
ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির একটি নিজস্ব রাজনৈতিক পরামর্শক সংস্থা হলো 'নেশন উইথ নমো' (এনডব্লিউএন)। নিয়োগ পেতে এই সংস্থায় ইন্টারভিউ দেন নীরাজ নামের এক যুবক। ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান – ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করা এই যুবক বেকার ছিলেন, তাই একটা কাজেরও সুযোগও তাঁর দরকার ছিল।
১৫ মিনিটের সাক্ষাৎকারে নীরাজকে একটি প্রশ্নের গাণিতিক সমাধান দিতে বলা হয়। প্রশ্নটি হচ্ছে, একটি যাত্রীবাহী বিমানে কতগুলো টেনিস বল আঁটতে পারে? আঁক কষে এর সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিলেন নীরাজ। ফলে নিয়োগও পেয়ে যান। তাকে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে এক জরিপের কাজ দেওয়া হয়। যেখানে ভারতের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করা অন্যান্য গ্রাজুয়েটদের একটি ছোট্ট টিমের সাথে নীরাজও যুক্ত হন।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওই রাজ্যে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে তাদেরকে জরিপের কাজে ত্রিপুরা পাঠানো হয়, যাতে করে ভোটারদের সম্পর্কে নানান তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা যায়।
তাদের দায়িত্ব ছিল– যেসব ভোটার বিজেপিকে ভোট দিতে চান না তাদের শনাক্ত করা, তাদের জনমিতিক বিভিন্ন তথ্য – বয়স, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম – ইত্যাদি অনুসারে আলাদা আলাদা শ্রেণিবিভাগ তৈরি এবং সবার মধ্যেই আছে এমন একটি সাধারণ, উদ্বেগ বা ভীতিকে চিহ্নিত করা। যেটি নিজেদের কৌশলে রেখে সুবিধা আদায় করতে পারবে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। তবে এসব কিছুই করতে হবে যথাসম্ভব গোপনে।
এখনও ওই সংস্থায় কর্মরত হওয়ায়, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ছাড়া গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার অনুমতি নেই তাঁর। কাতার-ভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে এজন্যই তিনি শুধু ডাকনাম প্রকাশের শর্তে এসব কথা জানান।
ভারতের সরকারি অর্থায়নপুষ্ট শীর্ষ প্রকৌশল, আইন ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তি হতে ভর্তিচ্ছুদের সর্বভারতীয় এক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়– যাকে বলা হয় জয়েন্ট এনট্রেস এক্সাম (জেইই)। আইআইটি-সহ ভারতের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হতে প্রতিবছর কয়েক কোটি শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেন। তবে এদের মধ্যে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশই ভর্তি হতে পারেন।
নীরাজের ভাষ্য, "জয়েন্ট এনট্রেস এক্সামে আমরা যারা সমস্যা সমাধানের ভালো দক্ষতা দেখিয়েছিলাম– তারাই টিকতে পেরেছিলাম।"
অর্থাৎ মুষ্টিমেয় ওই সৌভাগ্যবানদের দলে ছিলেন নীরাজ। তবে পাসের পরে চাকরি না পেয়ে বর্তমানে কাজ করছেন রাজনৈতিক দলের পরামর্শক সংস্থায়। তাঁরই মতো ভারতের শীর্ষ বিদ্যাপীঠগুলোর শত শত গ্রাজুয়েট বিগত বছরগুলোয় বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনে যুক্ত হয়েছেন। অবশ্য, এটাই সবার মূল লক্ষ্য নয়। এই নিয়োগ সীমিত সময়ের জন্যও হয়, ফলে বাণিজ্যিক কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়ার আগে এই কাজটা তারা খণ্ডকালীনই করেন।
আইআইটির ডিগ্রি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যালামনাইদের মধ্যে রয়েছেন গুগলের বর্তমান প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই, টুইটারের সাবেক সিইও পরাগ আগারওয়ালের মতো ব্যক্তিত্ব। অন্যদিকে, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ করেছিলেন পেপসিকোর সাবেক ইন্দ্রা নোয়ি। খ্যাতনামা এসব প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি মানেই একসময় ছিল নিশ্চিত মোটা বেতনের চাকরির নিশ্চয়তা। কিন্তু, সেই অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। ক্যাম্পাস থেকে মেধাবি শিক্ষার্থীদের নিয়োগ কার্যক্রমেও যেন ভাটা পড়েছে গত কয়েক বছর ধরে। একইসঙ্গে ভারতের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কর্মী ছাঁটাইও বেড়েছে।
কিন্তু, এসব প্রতিষ্ঠানের স্মাতকদের তথ্য ব্যবস্থাপনা ও বিশ্লেষণের যে যোগ্যতা রয়েছে – তাকে সহজেই কাজে লাগানো যায়। আর সেই কাজটাই করছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে, বিভিন্ন আসনের ভোটারদের তথ্য বিশ্লেষণে এই দক্ষতা থাকায় তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে উঠেছে।
ভারতে ভোটার তথ্য ব্যবস্থাপনা ও বিশ্লেষণের বাজারটি ৩০ কোটি ডলারের বলে ধারণা করা হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ প্রাদেশিক বিভিন্ন দলও বেকার গ্রাজুয়েটদের নিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছে, তাঁদের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে চাইছে। ফলে আগামীতে এই বাজার আরো বড় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্নাতকদের আকৃষ্ট করতে রাজনৈতিক দলগুলো ফেলোশিপ অফার করেছে, যদিও চুক্তি-ভিত্তিক এসব চাকরি হলো স্বল্পমেয়াদি। সাধারণত এই চাকরির মেয়াদ হয় তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ তিন বছর। বেতন অবশ্য তারা ভালোই দেয়, আর এই কাজ করে দিলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে এমন প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।
এই প্রতিশ্রুতিও মেধাবি যুবাদের আকৃষ্ট করে। কারণ রাজনৈতিক দলের জরিপে কাজ করে তাঁরা ক্ষমতাবানদের কাছাকাছি আসতে পারে। এমন মন্তব্য করেন ভারতের একটি রাজনৈতিক পরামর্শক সংস্থা পলিটিক অ্যাডভাইজর্সের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার অঙ্কিত লাল।
ফিরে আসা যাক নীরাজের কাহিনিতে। নীরাজ ও তাঁর টিমের অন্য সদস্যরা ত্রিপুরা রাজ্যের ভোটার তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজেপি নেতৃত্বকে জানান, দলটি এই প্রদেশের উত্তরাংশে সুবিধেজনক অবস্থানে আছে। অর্থাৎ, এই অংশের ভোটাররা বিজেপিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছেন। অন্যদিকে অমরপুরের আসন– যার আওতায় চাবিমারার মতো কিছু আদিবাসী এলাকা রয়েছে, সেখানকার ভোটাররা অন্য দলগুলোকে সমর্থন করেন।
বিজেপি তখন ত্রিপুরার রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন ছিল, এবং পুনঃরায় নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করছিল।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে দীর্ঘ এক পাহাড়ি সর্পিল পথে যেতে হয় চাবিমারা। যাত্রার প্রথম অংশটা হয় সড়কপথে, তারপর মোটরবোটে চেপে গোমতি নদী ধরে। সেই নদীপথের বেশিরভাগটাও পাহাড়ঘেরা। হাজারো জনশ্রুতি আর লোকগাঁথার ঐতিহ্য আছে এখানকার মানুষের, প্রাচীন উপকথায় আছে এই পাহাড়গুলোর কোনো কোনো গুহায় ধনরত্ন পাহারা দেয় বিশালাকায় সব অজগর। তবে লোকঐতিহ্য যতই থাক– আদিবাসী অধ্যুষিত চাবিমারা দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত এক দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা।
চাবিমারার জামাতিয়া উপজাতির সদস্যরা কথা বলেন কোকবরক ভাষায়। এটি বর্মী-তিব্বতীয় ভাষার একটি রূপ। তাঁরা থাকেন, দুর্গম অরণ্যঘেরা অঞ্চলে, যেখানে বৃষ্টিপাত এতই বেশি যে এই এলাকাকে বলা হয় 'ত্রিপুরার আমাজন' ।
চাবিমারায় মাঠপর্যায়ের জরিপ চালিয়ে নীরাজ একটি সমাধানও খুঁজে পান। তিনি দেখেন জামাতিয়া সম্প্রদায়ের কিছু প্রভাবশালী পরিবারকে পক্ষে আনতে পারলেই স্থানীয়রা বিজেপিকে ভোট দিতে উৎসাহী হবে।
নীরাজ বলেন, "সেখানকার মানুষ খুবই দরিদ্র, তাঁদের চাওয়াও আহামরি কিছু ছিল না। শুধু বাড়ির চারপাশে (সরকারিভাবে) সীমানা প্রাচীর তুলে দেওয়ার দাবি ছিল তাঁদের।"
জরিপের দুই থেকে তিন দিন পরে রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বের কাছে কিছু সুপারিশ করেন নীরাজ। তক্ষণাৎ কাজও শুরু হয়। তড়িঘড়ি করে জামাতিয়া আদিবাসীদের প্রায় ৮০টি বাড়ির চারপাশে নির্মাণ করা হয় মাটির প্রাচীর। বাড়তি প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয় জোরা ছাগল। দেওয়ালগুলো বিজেপির প্রচারণার ক্যানভাসেও রূপ নেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীসহ স্থানীয় বিজেপি প্রার্থীর ছবি আঁকা হয়ে দেওয়ালে দেওয়ালে।
গত বছরের ওই নির্বাচনের আগে পাঁচ বছর ত্রিপুরায় ক্ষমতাসীন ছিল বিজেপি। ফলে চাইলে আগেই এসব দেওয়াল নির্মাণ করে দিতে পারতো। সেটি না করে, তাঁরা নির্বাচনপূর্ব ভোট জরিপের ভিত্তিতে এই কাজ করে দায় সাড়ে। তাই এবিষয়ে আল জাজিরার কাছে কোনো মন্তব্য করতে চাননি ত্রিপুরা বিজেপির মুখপাত্র।
অবশ্য এটুকুও অনেক পাওয়া ছিল দারিদ্রপ্রবণ ওই জনগোষ্ঠীর। ভারত – যেখানে ৮০ কোটি মানুষকে সরকারি ভর্তুকির খাদ্যশস্যের ওপর নির্ভর করতে হয়, সেখানে এক জোড়া করে ছাগল ও সীমানা প্রাচীর পেয়েই খুশি হয়ে যায় তাঁরা। বিজেপিও পায় তাঁদের কৃতজ্ঞতা আর ভোট।
আইআইটির আরেকজন গ্রাজুয়েট যিনিও বর্তমানে নেশন উইথ নমো'তে কাজ করছেন তাঁর মতে, "রাজনীতিতে ভোটই হলো একমাত্র কারেন্সি/ মুদ্রা। দেশের সব ভোটার মাত্র একটি ভোটই দিতে পারেন। তাই কেউ একজন কীভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন – আমাদের সব প্রচেষ্টার কেন্দ্রে থাকে সেটি চিহ্নিত করা।"
ভারতের নির্বাচনবিধিতে ভোটারদের ঘুষ দেওয়া একটি অপরাধ, এই কাজ করলে কারাদণ্ড থেকে শুরু করে ভোট বাতিলও করা হতে পারে। তবে রাজনৈতিক দল যদি তাদের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় এমন কোনো ঠিকাদারের মাধ্যমে এসব কাজ করায় – তাহলে ঘুষের অভিযোগ অস্বীকার করতে পারে, ফলে বিষয়টি তখন নির্বাচন পরবর্তী তদন্ত সাপেক্ষ হয়ে যায়।
দলের এই কৌশলেই অমরপুরের আসনটিতে জেতেন বিজেপির প্রার্থী। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ও কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার প্রার্থীকে হারান সামান্য ব্যবধানে।
গত ১৯ এপ্রিল থেকে ভারতে লোকসভা নির্বাচনের মহাযজ্ঞ। বিশ্বের বৃহত্তম এই নির্বাচন চলবে ৪৪দিন ব্যাপী। নির্বাচনের এক মাস আগে থেকেই প্রযুক্তি দক্ষ আইআইটি গ্রাজুয়েট, এমবিএ ও আইনজীবী ও গবেষকরা ভোটার তথ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
ভোটার তথ্য বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে নির্বাচনী প্রচারের কৌশল প্রণয়ন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় আলোকপাত করা থেকে শুরু করে কোথায় কাকে উপহার দিতে হবে, বা কোন ধরনের মেরুকরণের রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে হবে তা নিয়েই চলে এদের কর্মমুখরতা। একইসঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া সংবাদ প্রচার বা হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়ে ভোটারদের দলের পক্ষে টানার কাজটিও এরা করেন।
ভারতীয় গণতন্ত্রের এই নেপথ্য যুবারা নিজেদেরকে "রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ সমস্যার সমাধানকারী" বলে অভিহিত করেন। কারণ, আকর্ষণীয় বেতনভাতা ও জয়ের আনন্দ ছাড়া এখানে তাঁদের অন্য স্বার্থ তেমন নেই।
আল জাজিরার সাথে আলাপকালে তাঁদের অনেকেই স্বীকার করেন তাঁদের নিয়োগদাতা রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে ভোটারদের পক্ষে টানার এসব কৌশল গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। তবে তাঁরা দাবি করেন, তাঁরা কোনো পক্ষের প্রতি অনুরক্ত বা অনুগত্য থেকে এটি করছেন না, বরং কেবল 'সমস্যা' সমাধানেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।
অনুবাদ: নূর মাজিদ