ভিসুভিয়াসের ছাইচাপা থেকে উদ্ধার লিপিতে প্লেটোর জীবনের শেষ সন্ধ্যার বর্ণনা!
৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির ছাই চাপা পড়েছিল প্যাপিরাস কাগজে তৈরি একটি লিপি। সম্প্রতি উদ্ধার করা গেছে যার অর্থ। এতে পশ্চিমা দর্শনের অন্যতম দিকপাল প্লেটোর জীবনের শেষ সময়ের বর্ণনা রয়েছে।
বিশ্বখ্যাত গ্রিক প্লেটো ছিলেন আরেক মহান দার্শনিক সক্রেটিসের ছাত্র। আবার প্লেটোর শিষ্য ছিলেন এরিস্টটল। এ হিসেবে প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনজন দার্শনিকের মধ্যে প্লেটো দ্বিতীয়। প্রথম সক্রেটিস এবং শেষ এরিস্টটল। এরাই পশ্চিমা দর্শনের ভিত রচনা করেছেন বলা যায়। প্লেটোর মৃত্যু হয়েছিল ৩৪৮ খৃস্টপূর্ব সালের কাছাকাছি সময়ে।
প্যাপিরাস লিপিতে প্লেটো কীভাবে তাঁর জীবনের শেষ সন্ধ্যা কাটান সেটি লেখা রয়েছে। লিপিতে বর্ণিত হয়েছে, থ্রেসীয় এক ক্রীতদাসীর বাঁশি বাজানো শুনেছিলেন প্লেটো। তিনি তখন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী, জ্বরও ভীষণ। তারমধ্যেও বাজনায় ছন্দের কমতি থাকায় ওই ক্রীতদাসীর সমালোচনা করার মতো সজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন কালজয়ী এই দার্শনিক।
প্লেটো একাধারে গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক ভাষ্যের রচয়িতা হিসেবে খ্যাত। তিনিই পশ্চিমা বিশ্বে উচ্চ শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এটি ছিল এথেন্সের আকাদেমি। প্যাপিরাস লিপির উদ্ধারকৃত শব্দমালা জানাচ্ছে, বিশ্বের প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানের জমিতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
আকাদেমিতে প্লেটোকে সমাধিস্থ করার কথা ঐতিহাসিকরা আগে জানলেও – এবারই প্রথম সুনির্দিষ্টভাবে তাঁর সমাধিস্থল সম্পর্কে জানা গেছে।
বহুযুগ ধরে আগ্নেয়গিরির ছাইচাপা পড়ে থেকে প্যাপিরাস লিপি কার্বনে পরিণত হয়েছিল। ফলে এর শব্দগুলো উদ্ধার করা বেশ কঠিনই ছিল গবেষকদের জন্য। ইতালির পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রাজিয়ানো র্যানোচ্চিয়ার নেতৃত্বে একদল গবেষক সেই কাজেই যুক্ত ছিলেন।
সম্প্রতি ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব নেপলসে তাঁরা এই গবেষণার ফল প্রকাশ করেন। এসময় অধ্যাপক গ্রাজিয়ানো এই আবিষ্কার সম্পর্কে বলেন, "অত্যাশ্চর্য এই ঘটনা প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জানাশোনাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।"
তিনি জানান, "সর্বাধুনিক চিত্র বিশ্লেষক প্রযুক্তির কল্যাণে শেষপর্যন্ত আমরা এই লিপি পড়তে পেরেছি। একইসঙ্গে লেখনীর নতুন কিছু অংশও পড়তে সক্ষম হই। যদিও আগে ধারণা করা হয়েছিল, এগুলোর পাঠোদ্ধার আর করা সম্ভব না।"
প্রাচীন লিপিটি থেকে আরো জানা গেছে, এজিনা দ্বীপে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল প্লেটোকে। ধারণা করা হয়, খৃষ্টপূর্ব ৪০৪ অব্দে এই দ্বীপটি দখলে নেয় স্পার্টান যোদ্ধারা। তাদের হাতে বন্দি হওয়ার পরে প্লেটোকে দাস বিসেবে বিক্রি করা হয়। অথবা সক্রেটিসের মৃত্যুর কিছু সময় পরে খৃষ্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দেও এটি ঘটতে পারে।
র্যানোচিয়া গবেষণার ফল উপস্থাপনকালে বলেন, "এপর্যন্ত মনে করা হতো, খৃষ্টপূর্ব ৩৭৬ অব্দে প্লেটো যখন সিসিলির সিরাকাউসের রাজা প্রথম দিওনাইসিয়াসের দরবার অবস্থান করছিলেন – তখন তাঁকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল। তবে এই প্রথমবারের মতো প্যাপিরাস লিপিটির লুকানো অক্ষরগুলো আমরা পড়তে পেরেছি। গোল করে পাকানো ওই প্রাচীন লিপির বহুস্তরের মধ্যে অক্ষরগুলো লুকানো ছিল। বিশেষ কারিগরি প্রক্রিয়ায় সেই ভাঁজ খোলা হয়। বহু শতাব্দী ধরে এসব অক্ষর একটির সাথে অন্যটি প্রায় লেপ্টে ছিল।" এজন্যই সেগুলোকে আলাদা করে পাঠোদ্ধার করতে সময় লেগেছে।
এই অধ্যাপক আরো বলেন, প্যাপিরাসের এসব স্তরকে চিহ্নিত করতে, এবং সেই অনুযায়ী অক্ষরগুলোকে তাঁদের প্রকৃত অবস্থানে সাজাতে হয়েছে আমাদের। এটি সম্পন্ন হলে– লিপিটির ধারাবর্ণনা স্পষ্ট হয়। এই সাফল্য আগামীতে প্রাচীন পুঁথি বা লিপি থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করবে।
তবে এখনও পুরো কাজটি সম্পন্ন হয়নি, বরং শুরুর পর্যায়ে আছে। পুরোপুরি পাঠোদ্ধারের জন্য আরো কয়েক বছর লাগতে পারে। তখন প্রাচীন ইতিহাসের আরো অজানা তথ্য জানা যাবে।
১৭৫০ সালে আবিষ্কৃত প্রাচীন হেরাকুলেনিয়ামের এক অভিজাত ভিলা থেকে লিপিটি উদ্ধার করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, ওই বাড়িটি ছিল বিখ্যাত রোমান শাসক জুলিয়াস সিজারের শ্বশুরের।
সেখানে আরো অনেক প্রাচীন প্যাপিরাস কাগজের লিপি পাওয়া গেছে, অনেক বছর ধরে সেগুলোর পাঠোদ্ধারও করে চলেছেন গবেষকরা। এজন্য বাড়িটির নামও তাঁরা দিয়েছেন ভিলা অব দ্য প্যাপাইরি।
৭৯ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ অগ্নুৎপাতে লন্ডভণ্ড হয় হেরাকুলেনিয়াম শহর। প্রত্নতাত্ত্বিক ডমিনিকো কামরাডো এই ঘটনার প্রভাবের সঙ্গে হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার ধবংসলীলার তুলনা করেছেন।
ভিসুভিয়াসের উদ্গীরণ করা লাভা ছাই ও ধোঁয়ার উত্তাপ এতই ছিল যে, ধারণা করা হয় এটি ৪০০ থেকে ৫০০ ডিগ্রি পর্যন্ত হয়ে থাকতে পারে। এই তাপমাত্রায় মানবদেহের মগজ ও রক্ত পর্যন্ত সঙ্গেসঙ্গে বাস্পীভূত হয়ে যায়।
অনুবাদ: দ্য গার্ডিয়ান