প্লেটোর উদ্বেগ ও টিকটকের অন্তহীন স্রোত
প্লেটো বিশ্বাস করতেন, মানুষ যদি লেখা শেখে, তবে তাদের মগজ দুর্বল হয়ে পড়বে। মনের ওপর নির্ভর না করে তারা কাগজের ওপর নির্ভর করবে, চিন্তার গভীরতা কমে যাবে। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে যখন নতুন প্রযুক্তি এসেছে, তখনই দেখা গেছে একই ধরনের প্রতিক্রিয়া। ছাপাখানা আবিষ্কারের পরও অনেকে উদ্বিগ্ন হয়েছিল। বই সহজলভ্য হলে ইউরোপের ক্ষমতাশালীরা আশঙ্কা করেছিল, জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সেই ভয়ই একদিন সত্যি হয়েছিল। মার্টিন লুথারের মুদ্রিত প্রবন্ধগুলো নাড়িয়ে দিয়েছিল ক্যাথলিক চার্চের শক্ত ভিত।
প্রতিটি যুগেই নতুন যোগাযোগপ্রযুক্তি মানুষের কণ্ঠকে আরও শক্তিশালী করেছে, তথ্যকে আরও সহজলভ্য করেছে, সমাজের কাঠামোকে বদলে দিয়েছে। আজকের যুগে সেই পরিবর্তনের সর্বশেষ একটি প্রতিচ্ছবি টিকটক। এটি মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু প্রতিটি নতুন মাধ্যমের মতো এটিও প্রশ্নের মুখে। এটি কি নিছক বিনোদনের প্ল্যাটফর্ম, নাকি এমন এক হাতিয়ার, যা মানুষের মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আসক্তি তৈরি করতে পারে এবং তথ্যপ্রবাহের নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে?
নিউরোসায়েন্টিস্ট ড. বেন রেইন কীভাবে কিছু ভিডিও ভাইরাল হয় আর কিছু একেবারেই জনপ্রিয়তা পায় না—এ রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে একটি গবেষণা করেন, যার ফলফল ২০২৩-এর অক্টোবরে Neuroscience জার্নালে প্রকাশিত হয়। তার গবেষণায় উঠে আসে, টিকটকের রেকমেন্ডেশন অ্যালগরিদম কীভাবে ভিডিওর দর্শকসংখ্যা নির্ধারণ করে।
অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাথে টিকটকের একটা বড় পার্থক্য হলো ভিডিওর জনপ্রিয়তা অনুসারী বা ফলোয়ারের সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। রেইনের গবেষণা দেখায়, মাত্র কয়েক শ অনুসারী থাকা অ্যাকাউন্টও ভাইরাল হতে পারে—যদি অ্যালগরিদম সেটিকে আকর্ষণীয় বলে মনে করে। তিনি নিজের পোস্ট করা ১৫০টি ভিডিওর বিশ্লেষণ করে দেখেন, ভিডিওর শেয়ার এবং লাইক সংখ্যা যত বেশি, তার দর্শকসংখ্যাও তত বেশি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ভিডিও দেখার সময়কাল—দর্শক যত বেশি সময় ধরে একটি ভিডিও দেখেন, সেটি তত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো হ্যাশট্যাগ, সাউন্ড বা অন্যান্য ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট এই জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি।
কোন ধরনের কনটেন্ট সবচেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে? রেইন দেখতে পান, যারা গবেষণাপত্রের সারাংশ ব্যাখ্যা করেছেন, তাদের ভিডিওগুলো সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী এবং তারা পিয়ার-রিভিউড গবেষণা বা বৈজ্ঞানিক জার্নালকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে। কিন্তু এই গবেষণা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের জন্য জটিল ভাষায় লেখা হয় এবং অনেকে এগুলো পড়ার সুযোগও পান না। তাই যখন টিকটকের মতো একটি প্ল্যাটফর্মে সহজবোধ্য উপস্থাপনার মাধ্যমে এই তথ্যগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়, তখন এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
রেইনের গবেষণার আরেকটি চমকপ্রদ ফলাফল হলো—তার অনুসারীদের ৮৪ শতাংশ বলেছেন, তারা বিজ্ঞানের প্রতি আরও বেশি আস্থাশীল হয়ে উঠেছেন। আজকের ডিজিটাল যুগে, যেখানে ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে এটি একটি ইতিবাচক সম্ভাবনা নির্দেশ করে—সঠিকভাবে ব্যবহার করলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রচারের একটি কার্যকর মাধ্যম হতে পারে।
অন্যদিকে টিকটক ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তি নিয়ে গবেষণা এখনো সম্পূর্ণ নয়, তবে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাতে পারে, উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিতে পারে এবং দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করেন, তারা কম মনোযোগী হয়ে ওঠেন এবং বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান না করে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এটি সাময়িক স্বস্তি দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে আরও বেশি মানসিক ক্লান্তি তৈরি করে।
আমরা নিজেরা বারবার ভাবি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে থাকব, তবুও কেন ফিরে আসি? টিকটক কীভাবে আমাদের ধরে রাখে?
প্রথমত, টিকটক বা যেকোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'লাইক' পাওয়া আমাদের মস্তিষ্কে একধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা আমাদের আরও সক্রিয়ভাবে এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। যখন কেউ আমাদের কনটেন্টে লাইক দেয়, তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসৃত হয়, যা আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। এটি একধরনের পুরস্কারব্যবস্থার মতো কাজ করে। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রশংসার প্রতি সংবেদনশীল। তাই যখন কেউ তার কনটেন্টে লাইক পায়, সেটি একধরনের সামাজিক স্বীকৃতির অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং সেই অভিজ্ঞতা পুনরায় পাওয়ার জন্য ব্যবহারকারী আরও বেশি কনটেন্ট তৈরি করে, আরও বেশি সক্রিয় থাকে। এই প্রতিক্রিয়া ক্রমাগত পুনরাবৃত্ত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত আসক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
টিকটকের আরেকটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এর অবিরাম স্ক্রলিং, যা একধরনের ডিজিটাল ফাঁদের মতো কাজ করে। এখানে ভিডিওর কোনো নির্দিষ্ট শেষ নেই। ব্যবহারকারী স্ক্রল করলেই নতুন কনটেন্ট সামনে আসে। ঠিক যেমন স্লট মেশিনে প্রতিবার হাতলে চাপ দেওয়ার পর ফলাফল বদলে যায়, তেমনি টিকটকের ফিডে নতুন ভিডিও আসে, যা ব্যবহারকারীর মনে একধরনের কৌতূহল তৈরি করে—পরবর্তী ভিডিওটি হয়তো আরও আকর্ষণীয় হবে। মাঝেমধ্যে সত্যিই অত্যন্ত আকর্ষণীয় কিছু সামনে আসে, যা ব্যবহারকারীকে আরও স্ক্রল করতে বাধ্য করে। এই অনিশ্চিত পুরস্কারের নীতিই টিকটকের অন্যতম প্রধান শক্তি, যা ব্যবহারকারীকে দীর্ঘ সময় ধরে প্ল্যাটফর্মে আটকে রাখে।
টিকটকের উত্থান সরাসরি ফেসবুকের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। আগে যেখানে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের বন্ধু ও অনুসরণকৃত অ্যাকাউন্টগুলোর পোস্ট দেখানোর ওপর গুরুত্ব দিত, টিকটক সেই ধারণা বদলে দেয়। এই প্ল্যাটফর্মে ফলোয়ার সংখ্যা বড় বিষয় নয়, বরং ব্যবহারকারীর ইন্টারঅ্যাকশনের ভিত্তিতে কনটেন্ট সাজেস্ট করা হয়। এটি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, যেখানে অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে কোন কনটেন্ট ভাইরাল হবে এবং ব্যক্তিগত পছন্দ ও অভ্যাস অনুযায়ী ফিড সাজিয়ে দেয়। ফেসবুক দ্রুত বুঝতে পারে যে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তাদেরও ফলোয়ারনির্ভর মডেল থেকে অ্যালগরিদমভিত্তিক রিকমেন্ডেশন মডেলে যেতে হবে।
এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রতিফলন দেখা যায় ভিডিও কনটেন্টের ধরনে। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে আগে ছবি ও দীর্ঘ ভিডিও বেশি গুরুত্ব পেত, কিন্তু টিকটকের ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ডের সংক্ষিপ্ত ভিডিওর জনপ্রিয়তা ফেসবুককে বাধ্য করে শর্ট ফর্ম ভিডিওতে মনোযোগ দিতে। ফলে ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক উভয়েই 'রিলস' চালু করে, যা কার্যত টিকটকের অনুকরণ। দ্রুত বদলে যাওয়া এই কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজির ফলে রিলস ব্যবহারকারী সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ২০২২ সালে মেটা ঘোষণা দেয়, ইনস্টাগ্রামে ব্যয় করা সময়ের ২০ শতাংশই এখন রিলসে কাটছে।
ফেসবুকের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যবহারকারীদের অ্যাপে ধরে রাখা। টিকটকের ইনফিনিট স্ক্রলিং ব্যবহারকারীদের নিরবচ্ছিন্নভাবে ভিডিও দেখতে বাধ্য করে, যেখানে প্রতিটি নতুন স্ক্রল নতুন একটি আকর্ষণীয় ভিডিও সামনে নিয়ে আসে। এটি অনেকটা স্লট মেশিনের মতো কাজ করে—পরবর্তী ভিডিওটি হয়তো আরও বেশি মজার হবে, এই আশায় মানুষ স্ক্রল করতে থাকে। এই অভ্যাস ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামেও সংযোজন করা হয়, যেখানে নিউজ ফিডে এখন আরও বেশি ভিডিও ঠেলে দেওয়া হয় এবং অটো-প্লে সুবিধা যুক্ত করা হয়, যাতে ব্যবহারকারী প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার আগেই নতুন কনটেন্ট সামনে আসে।
টিকটকের অ্যালগরিদম শুধু কনটেন্ট সাজেশনেই নয়, বরং ব্যবহারকারীর মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রেও বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারকারীর প্রতিটি লাইক, কমেন্ট এবং কতক্ষণ তারা একটি ভিডিও দেখেছে, তা বিশ্লেষণ করে ফিড তৈরি করে। ফেসবুকও সেই মডেল অনুসরণ করে তাদের নিউজ ফিড ও রিলসের অ্যালগরিদমে 'প্রেডিক্টিভ এনগেজমেন্ট' যুক্ত করে, যাতে ব্যবহারকারীরা অজান্তেই আরও বেশি সময় প্ল্যাটফর্মে ব্যয় করেন।
এই পরিবর্তন শুধু ফেসবুকের কনটেন্ট মডেল নয় বরং এর মনিটাইজেশন কৌশলকেও বদলে দেয়। টিকটক ক্রিয়েটর ইকোনমিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়, যেখানে ছোট কনটেন্ট ক্রিয়েটররাও সহজেই ভাইরাল হতে পারে এবং অর্থ উপার্জনের সুযোগ পায়। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম সেই মডেল অনুসরণ করে 'Reels Play Bonus' চালু করে, যেখানে কনটেন্ট নির্মাতারা তাদের ভিডিও থেকে সরাসরি আয় করতে পারে। একই সঙ্গে ইনস্টাগ্রামে সাবস্ক্রিপশন সুবিধা যোগ করা হয়, যাতে ইনফ্লুয়েন্সাররা তাদের অনুগামীদের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করতে পারেন।
টিকটকের প্রভাবের ফলে সোশ্যাল মিডিয়া আর আগের মতো নেই। একসময় যেখানে ফেসবুক ছিল বন্ধু ও পরিবারের সংযোগ তৈরির একটি মাধ্যম, এখন তা ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে ব্যক্তিগত পছন্দনির্ভর মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে, যেখানে ব্যবহারকারীর সোশ্যাল কানেকশনের চেয়ে অ্যালগরিদম নির্ধারিত কনটেন্টই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
টিকটক বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেলেও এখন এটি রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ এটিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছে। তাদের আশঙ্কা, এর মূল প্রতিষ্ঠান, চীনা কোম্পানি বাইটড্যান্স, ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। তবে বিষয়টি শুধু নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, বরং এটি একধরনের ডিজিটাল ক্ষমতার লড়াইও বটে। চীন বহুদিন ধরে মার্কিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর (যেমন ফেসবুক ও টুইটার) ব্যবহার নিষিদ্ধ রেখেছে জাতীয় নিরাপত্তা ও ভুল তথ্যের ঝুঁকির কথা বলে। এখন পশ্চিমা দেশগুলোও একই কারণে চীনা মালিকানাধীন অ্যাপগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে।
টিকটক নিষিদ্ধ হোক বা না হোক, এটি যে বিষয়গুলোকে সামনে এনেছে—সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি, অ্যালগরিদমনির্ভর কনটেন্ট এবং তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ—এসব প্রশ্ন শুধু একটি অ্যাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কারণ, অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের আচরণ প্রভাবিত করে।
মজার ব্যাপার হলো, এদিক থেকে আমেরিকার মতো প্রযুক্তিপ্রধান দেশ যে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে, তা কিন্তু নয়। যুক্তরাষ্ট্রে কিছু নির্দিষ্ট ডেটা সুরক্ষা আইন থাকলেও (যেমন CCPA – California Consumer Privacy Act এবং GDPR-এর কিছু প্রভাব সংযুক্ত সংস্থাগুলোর জন্য), দেশটিতে এখনো একটি জাতীয় পর্যায়ের বিস্তৃত ডেটা সুরক্ষা আইন নেই। ইউরোপের জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশনের (GDPR) মতো কঠোর ও সমন্বিত আইন যুক্তরাষ্ট্রে নেই, যা ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ও ব্যবহারের ওপর সুস্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন রাজ্যে আলাদা আলাদা আইন কার্যকর রয়েছে, বিশেষত ক্যালিফোর্নিয়া (CCPA এবং সম্প্রতি CPRA – California Privacy Rights Act)। তবে ফেডারেল পর্যায়ে এখনো কোনো সমন্বিত ডিজিটাল প্রাইভেসি আইন নেই, যা গোটা দেশে সমস্ত কোম্পানির জন্য বাধ্যতামূলক। ফলে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন গুগল, মেটা, টিকটক) বিভিন্ন নীতির ফাঁকফোকর ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিদ্যমান। দেশে এখনো কোনো কার্যকর ডেটা সুরক্ষা আইন নেই, যা ব্যবহারকারীদের তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারের নীতিমালা নির্ধারণ করে। সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং ডেটা সুরক্ষা বিল নিয়ে কিছু আলোচনা হলেও তা এখনো বাস্তবায়নের পর্যায়ে যায়নি বা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বচ্ছ নয়। ফলে বাংলাদেশ হোক বা যুক্তরাষ্ট্র, তথ্য সুরক্ষার অভাবের কারণে ব্যবহারকারীরা ঝুঁকির মধ্যে থাকছেন এবং প্ল্যাটফর্মগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
প্লেটো ভয় পেয়েছিলেন যে লেখা মানুষের চিন্তার গভীরতা কমিয়ে দেবে, যেমন আজ আমরা আশঙ্কা করি টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম আমাদের মনোযোগের ক্ষমতা ও স্বাধীন বিচারবোধ দুর্বল করে দিচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস দেখিয়েছে, প্রতিটি নতুন যোগাযোগপ্রযুক্তি আমাদের সমাজকে বদলে দিয়েছে—কখনো মুক্তির দিগন্ত খুলে দিয়েছে, আবার কখনো নতুন শৃঙ্খলের পথ তৈরি করেছে। টিকটকের ভবিষ্যৎ যা-ই হোক, প্রযুক্তির এই লড়াইয়ে আমরা কি কেবল দর্শক থাকব, নাকি আমাদের নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও নীতিনির্ধারণের শক্তিকে কাজে লাগাব—সেই প্রশ্নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।