দেখা গেল ৭৫ হাজার বছর আগে মারা যাওয়া নিয়ানডারথাল নারীর মুখ
৭৫ হাজার বছর আগে আমাদের, মানে মানুষের, সবচেয়ে কাছের কোনো আত্মীয়কে দেখতে পারলে কেমন হতো? তাও একেবারে 'রক্তমাংসে গড়া' চেহারাটা যদি দেখা যেত? খবর বিবিসি'র।
নিয়ানডারথাল এক নারী জীবিত থাকতে দেখতে কেমন ছিলেন, তার [চেহারার] একটি দারুণ পুনঃনির্মাণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
আর এ মুখমণ্ডলটাও তৈরি করা হয়েছে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ও ভাঙাচুরা একটি নিয়ানডারথাল খুলি থেকে। খুলিটি উদ্ধার করার সময় এটির হাড় এতই নরম ছিল যে, সেটাকে 'চায়ে ডোবানে বিস্কুটের' মতো নরম বলে অভিহিত করেছেন বিজ্ঞানীরা।
খুলির ভাঙা অংশগুলোকে পুনরায় জোড়া দেওয়ার আগে সেগুলোকে কঠিন রূপ দিতে হয়েছিল গবেষকদের।
তারপর বিশেষজ্ঞ প্যালিওআর্টিস্টরা সেই খুলির ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করেন। যেসব শিল্পী প্রাগৈতাহাসিক প্রাণীর বৈজ্ঞানিক প্রতিকৃতি অঙ্কন করেন, তাদেরকে প্যালিওআর্টিস্ট বলা হয়।
নেটফ্লিক্সের জন্য বিবিসি স্টুডিওর তৈরি করা ডকুমেন্টারি সিক্রেটস অব দ্য নিয়ানডারথাল-এ মুখাবয়বটি দেখানো হয়েছে। ডকুমেন্টারিটিতে ৪০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানুষের বিবর্তনীয় সঙ্গী নিয়ানডারথাল নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
নতুন এ ভাস্কর্যসদৃশ মুখাবয়বের ফলে নিয়ানডারথালের মুখ দেখতে কেমন ছিল তা বাস্তবেই প্রত্যক্ষ করা গেল।
প্রকল্পটির একজন প্যালিঅ্যানথ্রোপলিজস্ট ও ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের শিক্ষক ড. এমা পমরয় বলেন, 'আমি মনে করি, তার [নিয়ানডারথাল নারী] মাধ্যমে আমরা তাদেরকে বোঝার এক নতুন সংযোগ পেলাম।'
ইরাকি কুর্দিস্তানের শানিদার গুহায় এ নিয়ানডারথালের খুলিটি পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৫০-এর দশকে ওই গুহা থেকে অন্তত ১০টি নিয়ানডারথাল নারী, পুরুষ ও শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়।
২০১৫ সালে কুর্দিশ কর্তৃপক্ষ একটি ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে পুনরায় আমন্ত্রণ জানায়। তখনই ওই নারীর কঙ্কালটি খুঁজে পান তারা। সেটির নাম দেওয়া হয় শানিদার জেড।
কঙ্কালটির মেরুদণ্ড, কাঁধ, বাহু ও হাতসহ ঊর্ধ্বাঙ্গের বেশিরভাগ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়।
মাথার খুলিটির বেশিরভাগ অংশও পাওয়া গিয়েছিল। তবে সেটা খুলির আকৃতিতে নয়। খুলিটি চ্যাপ্টা হয়ে দুই সেন্টিমিটার পুরু একটি পরতে রূপান্তরিত হয়েছিল।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, দূর অতীতের কোনো এক সময় গুহার কোনো পাথর মাথায় পড়ার কারণে ওই নারীর খুলির এমন পরিণতি হয়েছে।
শানিদারে নতুন অনুসন্ধানের নেতৃত্ব দেওয়া ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রিম বার্কারের ভাষায়, 'ওই খুলিটা মূলত একটা পিজ্জার মতো চ্যাপ্টা ছিল।'
স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে খুলিটির অংশগুলো যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসা হয়। তারপর সেগুলোকে মাটি-পাথরের মিশ্রণ থেকে আলাদা করা হয়।
এরপরের কাজ ওই টুকরোগুলোকে একত্রিত করা। অনেকটা ধাঁধা সমাধান করার মতো করেই একজন প্রত্নতত্ত্ববিদকে কাজটি করতে হয়েছিল। তা-তে সময় লেগেছিল প্রায় বছরখানেক।
পুনরায় রূপ দেওয়া খুলিটি তারপর স্ক্যান করেন বিশেষজ্ঞরা। সেটাকে ত্রিমাত্রিকভাবে ছাপিয়ে তা দেওয়া হয় ডাচ শিল্পী আদ্রি ও আলফঁস কেনিসকে।
এ দুজন শিল্পী প্রাচীন মানুষের হাড় ও ফসিলের অবশিষ্টাংশ থেকে তাদের শরীরের বৈজ্ঞানিক প্রতিকৃতি আঁকার দক্ষতার জন্য বিখ্যাত।
তবে তাদের তৈরি এ মুখাবয়বটি যতই কৌতূহল জাগানিয়া হোক না কেন, প্রকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য কেবল মূল কঙ্কালটারই রয়েছে।
গবেষকেরা একদম নিশ্চিত যে, 'কঙ্কালটা নারীরই'।
পেলভিক হাড়গুলো থাকলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া আরও সহজ হতো, কিন্তু কঙ্কালটির সঙ্গে সেগুলো পাওয়া যায়নি।
তার বদলে গবেষকেরা নিয়ানডারথাল কঙ্কালটির দাঁতের এনামেলে অধিক পরিমাণে পাওয়া এক ধরনের প্রোটিনের মাধ্যমে এটির লিঙ্গ নির্ধারণ করেছেন। এ প্রোটিন স্ত্রী জেনেটিক্সের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আর বয়স? বোধহয় মধ্য চল্লিশে প্রাণ হারিয়েছিলেন ওই নিয়ানধারথাল নারী। আর এটাও বোঝা গেছে তার দাঁতের ক্ষয় দেখে।
ড. পমরয় বলেন, 'আমরা তার দুর্বল দাঁতের আরও কিছু ইঙ্গিতও খুঁজে পেয়েছি। কিছু ক্ষত, মাড়ির কিছু রোগও ছিল। তাই জীবনের ওই পর্যায়ে তার স্বাভাবিক আয়ুও শেষের দিকে ছিল বলে মনে হয়।'