গুপ্তচর থেকে লেখক; পিয়েরে বুলের 'প্ল্যানেট অফ দি এপস'-এ বুদ্ধিমান গরিলা ও দুর্বল মস্তিষ্কের মানুষের বিশ্ব
পিয়েরে বুলে বিশ্বের সবচেয়ে অনূদিত ফরাসি লেখকদের একজন। একইসাথে সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যেও অন্যতম।
৪০টি উপন্যাস ও ছোট গল্পের লেখক পিয়েরে পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। একইসাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি একজন সেনা সদস্যও ছিলেন। তিনি ইন্দোচীন উপদ্বীপে লেফটেন্যান্ট পদে এবং পরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গোপন এজেন্ট হিসাবে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি একজন লেখক হয়ে ওঠেন।
দেশে ফিরে পিয়েরে 'দ্য ব্রিজ ওভার দ্য রিভার কওয়াই' নামের বইটি লেখেন। সেখানে বার্মার যুদ্ধবন্দিদের একটি দলকে জাপানি সৈন্যরা একটি রেল ক্রসিং তৈরি করতে বাধ্য করার গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বইটিকেই ডেভিড লিন ১৯৫৭ সালে রূপালী পর্দায় তুলে ধরেন। পিয়েরের খ্যাতি আরও অনেক বৃদ্ধি পায় যখন তিনি 'প্ল্যানেট অফ দ্য এপস' প্রকাশ করেন। যেখানে প্রাইমেটদের আধিপত্যবাদী এক বিশ্বের কাল্পনিক গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটিও ১৯৬৮ সালে ফ্র্যাঙ্ক শ্যাফনার সিনেমায় রুপান্তর করেন। যেখানে মুখ্য চরিত্রে ছিল চার্লটন হেস্টন।
এদিকে গতকাল (শুক্রবার) প্রেক্ষাগৃহে প্রকাশ পেয়েছে 'কিংডম অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এপস' সিনেমাটি। মূলত এটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত 'ওয়ার ফর দ্য প্ল্যানেট অব দ্য এপস' সিনেমার সিকুয়েল। বইটিতে পিয়েরে দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরে সভ্যতার ভবিষ্যৎ এবং পারমাণবিক বোমার বিপর্যয়কর পরিণতি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন অবস্থাকে দার্শনিকরুপে তুলে ধরেছেন।
১৯৯৪ সালে মৃত্যুর পূর্বে এই লেখক বলেন, "ভাল ও মন্দের আপেক্ষিকতার থিম আমি আমার বেশিরভাগ বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।" যুদ্ধ ফ্রন্টে পিয়েরের অভিজ্ঞতাই ছিল তার কাজের 'আধ্যাত্মিক উপাদান'।
যুদ্ধোত্তর সময়কালে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, "অযৌক্তিকতাই যেন একপ্রকার যুক্তিতে পরিণত হয়েছে।" পিয়েরে তার লেখায় আধিপত্যবাদী মানুষের প্রাইমেটদের দ্বারা উৎখাত হওয়ার চিত্র তুলে ধরেছিলেন। যেখানে গরিলারা পুলিশ সদস্য, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ; শিম্পাঞ্জিরা শিক্ষক ও বিজ্ঞানীর ভূমিকায় থাকবেন।
পিয়েরে তার বইয়ে লিখেন, "বানর ও মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে বিকশিত হয়েছে। একদল একটু একটু করে চেতনার দিকে যাচ্ছে এবং অন্যদল তাদের পশুত্বের স্তরে স্থবির হয়ে আছে।"
পিয়েরে ১৯১২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং প্যারিসে একজন প্রকৌশলী হিসাবে স্নাতক লাভ করেন। এরপর তিনি মালয়েশিয়ার একটি রাবার বাগানে ফোরম্যান হিসাবে চাকরি গ্রহণ করেন।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পিয়েরে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যুক্ত হন। তিনি ব্রিটিশ চীন, বার্মা ও ইন্দোচীনে যুদ্ধ করেছিলেন। পিয়েরে হ্যানয়ে এক বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। সেখানে তাকে কঠোর শ্রমের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
পিয়েরের মতে 'প্ল্যানেট অফ দ্য এপস' ছিল তার ছোটখাটো কাজগুলির মধ্যে একটি। মানব প্রজাতির আত্ম-ধ্বংসাত্মক প্রবণতার উপর একটি নিছক ব্যঙ্গ। বইটির তুমুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যিক পরিসরে খুব একটা ভালো অবস্থানে থাকেননি। সেক্ষেত্রে তিনি তার বোন ও ভাইঝির প্যারিসের বাড়িতে একজন সন্ন্যাসীর মতো থাকতেন।
পিয়েরে মারা যাওয়ার আগে উত্তরাধিকারীদের তার পাণ্ডুলিপি প্রথম পড়তে বলেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, বিশ্ব তাকে ভুলে যাবে না। বিষয়টা অনেকটা এমন যে, ইতোমধ্যেই এটি সম্পর্কে সচেতন ছিল।
হয়ত পিয়েরের ভাবনাই অনেকটা সঠিক ছিল। কেননা তার উপন্যাস 'দ্য ভার্চুস অফ হেল' ও একটি অপ্রকাশিত স্ক্রিপ্ট 'দ্য প্ল্যানেট অফ মেন' নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এগুলোকে সিনেমা ও সিরিজ আকারে প্রকাশের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
মজার বিষয় হল, জীবনকালে পিয়েরে মনে করেছিলেন যে, 'প্ল্যানেট অফ দ্য এপস' সিনেমার জন্য অনুপযুক্ত এক কাজ। মূলত এর জটিল বর্ণনামূলক কাঠামোর কারণেই তিনি এমনটা বলেছিলেন।
বইটিতে দুই নভোচারী মহাকাশে একটি পাণ্ডুলিপি খুঁজে পায়। সিনেমাতেও ঐ ঘটনাগুলি বর্ণনা করা হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে অপ্রত্যাশিতভাবে পিয়েরে জানায়, ঐ অংশে নারী ও পুরুষের যে দুটি চরিত্র দেখানো হয়েছে তারা ছিল মূলত বানর!
বইয়ে ঐ দুই চরিত্র মানুষের বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বের সম্ভাবনা নিয়ে হেসেছিল। সেখানে বলা হয়, "যুক্তিবাদী মানুষ? প্রজ্ঞার অধিকারী মানুষ? না, এটা সম্ভব নয়। বর্ণনাকারী অতিরিক্ত বলে ফেলেছেন।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান