৪২ বছর যুক্তরাজ্যে থাকার পর জানলেন তিনি ব্রিটিশ নাগরিক নন!
ঘানার ৭৪ বছর বয়সী নেলসন শারদে, প্রায় ৫০ বছর ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। নিজেকে সবসময় ব্রিটিশ ভেবে আসলেও ২০১৯ সালে এসে জানতে পারেন তিনি ব্রিটিশ নাগরিক নন। খবর বিবিসি'র।
হোম অফিস থেকে তাকে জানানো হয়েছে, যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পেতে হলে তাকে আরও ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
এতদিন ধরে সকল নাগরিক কর প্রদান করে আসলেও, এখন তাকে যুক্তরাজ্যে বসবাস চালিয়ে যেতে এবং জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা (এনএইচএস) ব্যবহার করতে বড় অঙ্কের অর্থ প্রদান করতে হবে।
হোম অফিস এই চলমান আইনি বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
'কখনও জিজ্ঞাসা করিনি'
অবসরপ্রাপ্ত নিউজএজেন্ট নেলসন ১৯৭৭ সালে স্টুডেন্ট ভিসায় হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করতে যুক্তরাজ্যে আসেন। তার জন্মভূমি ঘানায় একটি অভ্যুত্থানের পরে তার পরিবার আর তাকে পড়াশুনা ও থাকা খাওয়া বাবদ অর্থ পাঠাতে পারেনি।
নিজের খরচ মেটাতে নেলসন যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করেছেন। তিনি সাউদাম্পটনের কাছে মাদার্স প্রাইড ব্রেড এবং কিপলিংয়ের কেক এবং উইনচেস্টারে বেনডিকের চকোলেট তৈরির কাজ করেছিলেন। তার কাজ করার সময়, কেউ কখনও তার যুক্তরাজ্যে বসবাস বা কাজ করার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি।
নেলসন একজন ব্রিটিশ মহিলাকে বিয়ে করেন এবং নিজের ব্যবসা শুরু করার জন্য ওয়ালাসিতে চলে আসেন। নেলসনস নিউজ নামে একটি পত্রিকার দোকান খোলেন।
প্রথম স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর অন্য একজন ব্রিটিশ মহিলাকে বিয়ে করেন তিনি। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে জ্যাকব এবং হারুন নামে দুটি পুত্রসন্তান আছে তাদের।
নেলসন বলেন, 'আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তাদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে, যাতে তাদের কোনো সামাজিক সহায়তা বা ভাতার ওপর নির্ভর করতে না হয়।'
নেলসন তার ছেলেদের অধ্যবসায়ের সাথে পড়াশোনা করতে, ভালো চাকরি পেয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী তার দুই ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এক ছেলে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট এবং আরেক ছেলে পাবলিক রিলেশন এক্সিকিউটিভ হয়েছেন।
নেলসন জানান, তিনি কখনই যুক্তরাজ্য ছেড়ে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি, এই দেশকে তার নিজের দেশ হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছেন।
কোনো ধরনের অনুসন্ধান ও ঝামেলা ছাড়াই তার বাড়িসহ তার সমস্ত জিনিসপত্র ধারে কিনতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে বন্ধকে ঋণও পেয়েছেন তিনি।
নেলসন আদালতের একটি জুরি বোর্ডেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৭ সালে এক ডাকাত বেসবল ব্যাট দিয়ে একজন ডেলিভারি ম্যানকে আক্রমণ করলে তিনি সাহসিকতার সাথে তাকে মোকাবিলা করেছেন, পরে এর জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে পুরষ্কারও দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ২০১৯ তার মায়ের মৃত্যুর পর ঘানায় ফিরতে চাইলে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন তিনি। কিন্তু তখন তাকে জানানো হয় তিনি ব্রিটিশ নন, তাই পাসপোর্ট পাওয়ার সুযোগ নেই তার।
হোম অফিস জানিয়েছে, তার যুক্তরাজ্যে থাকার কোনো অধিকার নেই।
'টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই'
কর্তৃপক্ষ নেলসনকে আরও ১০ বছর অপেক্ষা করে মীমাংসা করতে বলেছে। এই সময়ে তাকে অন্তত ৭ হাজার পাউন্ড এবং এনএইচএস ব্যবহারের জন্য আরও সাড়ে ১০ হাজার পাউন্ড প্রদান করতে হবে।
সম্প্রতি প্রোস্টেট ক্যান্সার থেকে সেরে ওঠা নেলসনের জন্য এই ব্যয়ভার বহন করা অনেকটা অসম্ভব বলে জানান তিনি। তার মতে তার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে এবং এক ধরনের শাস্তি হিসেবে এ প্রক্রিয়া প্রস্তাব করা হয়েছে।
সারাজীবন এ দেশের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে গেলেও কেন তার নাগরিকত্ব নিয়ে এত জটিলতা এটা তার বোধগম্য হচ্ছে না।
দুই বছর আগেও তিনি একই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হন যখন অনলাইনে তার ইউকে রেসিডেন্সি বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং ভুল করে ভুল ফর্ম পূরণ করেছিলেন।
২০২৩ সাল থেকে তার ১০ বছরের প্রক্রিয়ার গণনা শুরু হয়েছে, ফলে ৮৪ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে থাকতে পারবেন না নেলসন।
কার্ডিওভাসকুলার ফিজিওলজি নিয়ে গবেষণা করা ছেলে জ্যাকব বলেন, 'আমি শুরুতে ভেবেছিলাম এটা একটা রসিকতা। ব্যাপারটা হাস্যকর। ১৯৭৭ সাল থেকে এখানে বাস করা আমার বাবাকে কেন আরও ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে?'
জ্যাকব আরও বলেন, 'তার মামলা নিয়ে হোম অফিসে যারা কাজ করছেন তাদের চেয়ে বেশি সময় ধরে আমার বাবা এখানে বাস করছেন।'
'ব্যতিক্রমী ঘটনা'
গ্রেটার ম্যানচেস্টার ইমিগ্রেশন এইড ইউনিটের (জিএমআইএইউ) আইনজীবী নিকোলা বার্গেসের সহায়তায় নেলসন বর্তমানে হোম অফিসের বিরুদ্ধে মামলা করছেন। মামলার খরচ তার ছেলেরা ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে জোগাড় করার চেষ্টা করছেন।
মামলায় তারা যা দাবি করেছেন তা হলো— যুক্তরাজ্যে দীর্ঘদিন অবস্থান এবং সাহসিকতার পুরস্কারসহ কমিউনিটিতে তার অবদানের কারণে হোম অফিসের উচিত ছিল তাকে ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করা।
মিস বার্গেস বলেন, অন্তত একজন কেসওয়ার্কার তার ফাইল পর্যালোচনা করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন যে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির কারণে তাকে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি দেয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, 'যদি নেলসন আপনার বন্ধু বা আপনার প্রতিবেশী হতেন তবে আপনি পুরোপুরি একমত হতেন যে তার এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার আছে।'
তবে হোম অফিসের একজন মুখপাত্র বলেছেন যে চলমান আইনি কার্যক্রম সম্পর্কে মন্তব্য করা উপযুক্ত হবে না।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন