যুদ্ধাপরাধের তদন্তে আইসিসির প্রসিকিউটরকে ‘হুমকি’ দিয়েছিলেন মোসাদ প্রধান
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান ইয়োসি কোহেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদাকে গোপন বৈঠকে হুমকি দিয়েছিলেন এবং তাকে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। এ তথ্যগুলো দ্য গার্ডিয়ান এর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্কিত '+৯৭২ ম্যাগাজিন' এবং হিব্রু ভাষার প্রকাশনী 'লোকাল কল'-এর একটি তদন্তে প্রতিবেদনের অংশ।
২০২১ সালে শুরু হওয়া এ তদন্তের ওপর ভিত্তি করেই বেনসুদার উত্তরসূরি ও আইসিসির বর্তমান প্রসিকিউটর করিম খান গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান চালানো ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সহ অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়েছেন।
নেতানিয়াহু এবং তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট সহ তিন হামাস নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়ে আইসিসির বিচারকদের কাছে করিম খানের আবেদনের ব্যাপারে ইসরায়েলের সামরিক ও রাজনৈতিক সংস্থাগুলো অনেকদিন থেকেই ভয় পেয়ে আসছিলো।
মোসাদের প্রধান থাকার সময় ইয়োসি কোহেন ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিচার রোধ করার জন্য ইসরায়েলের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন নিয়েই আইসিসির বিরুদ্ধে চলমান প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ইসরায়েলি একটি সূত্র জানিয়েছে, মোসাদের লক্ষ্য ছিল আইসিসির প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদার সাথে আপস করা বা তার থেকে সহযোগিতা নেওয়া।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর 'বেসরকারি বার্তাবাহক' হিসেবে কাজ করা কোহেন আইসিসিকে দুর্বল করার লক্ষ্য নিয়েছিলেন। নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ মিত্র কোহেন ব্যক্তিগতভাবে মোসাদের প্রায় দশকব্যাপী প্রচারণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আইসিসিকে দুর্বল করার জন্য। তিনি এখন ইসরায়েলে একজন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।
চারটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, বেনসুদা আইসিসির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোহেনের ক্রমাগত ও হুমকিমূলক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাকে প্রভাবিত করার বিষয়ে অবহিত করেছিলেন।
আইসিসির কাছে বেনসুদা কোহেনের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন— এমন ঘটনার সাথে পরিচিত তিনটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, কোহেন বেনসুদা কে আইসিসির ফিলিস্তিন মামলায় ফৌজদারি তদন্তে এগিয়ে না যাওয়ার জন্য একাধিকবার চাপ দিয়েছিলেন।
তিনি বেনসুদাকে বলেছিলেন, "আপনি আমাদের সাহায্য করুন এবং আমাদের আপনার যত্ন নিতে দিন। আপনি এমন কিছুতে পড়তে চান না যা আপনার বা আপনার পরিবারের নিরাপত্তার সাথে আপস করতে পারে।"
কোহেনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরিচিত একজন ব্যক্তির মতে, তিনি বেনসুদার বিরুদ্ধে "ঘৃণ্য কৌশল" ব্যবহার করেছিলেন যা তাকে ভয় দেখানো এবং প্রভাবিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছিল। মোসাদ বেনসুদার পরিবারের প্রতিও আগ্রহ দেখিয়েছিল, তার (বেনসুদা) স্বামীর গোপন রেকর্ডিংয়ের প্রতিলিপি সংগ্রহ করেছিল তাকে অসম্মান করার জন্য।
এতে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রায় এক দশক ধরে আইসিসির বিরুদ্ধে কীভাবে একটি গোপন "যুদ্ধ" চালিয়েছিল তার বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মুখপাত্রের সাথে গার্ডিয়ান যোগাযোগ করার পর তিনি অভিযোগগুলোকে মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন বলেছেন। কোহেন মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি এবং বেনসুদা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বেনসুদাকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টায় ইসরায়েল কঙ্গোর সাবেক রাষ্ট্রপতি জোসেফ কাবিলার সাহায্য নিয়েছিল। বর্তমান চিফ প্রসিকিউটর করিম খান আইসিসি কর্মকর্তাদের প্রতিবন্ধকতা বা ভয় দেখানোর প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক করার সময় এই গোপন তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞ এবং আইসিসির সাবেক কর্মকর্তাদের মতে, বেনসুদাকে হুমকি দেওয়ার বা চাপ দেওয়ার জন্য মোসাদের প্রচেষ্টা রোম আইনের ৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে বিচার প্রশাসনের বিরুদ্ধে অপরাধের সমান হতে পারে।
আইসিসির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন যে করিম খান কোহেনের সাথে বেনিসুদার যোগাযোগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখেছেন কিনা তা না জানা গেলেও, খান কখনো মোসাদের প্রধানের সাথে দেখা করেননি বা কথা বলেননি।
যদিও মুখপাত্র সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও বলেছেন, খানের কার্যালয়কে "অনেক ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল যা তার কাজকে অযথা প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে"।
নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাওয়া জন্য করিম খানের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো আইসিসি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ঘনিষ্ঠ মিত্র, এমন দেশের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
ইসরায়েলের নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হওয়া
যে অপরাধগুলোর জন্য নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট অভিযুক্ত হয়েছেন সেগুলো গাজা যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সরাসরি আক্রমণ ও যুদ্ধের কৌশল হিসেবে দূর্ভিক্ষকে ব্যবহার করার মতো অপরাধ এখানে জড়িত আছে।
আইসিসিতে মামলাটি ২০১৫ সালে প্রথমবারের উদ্ভূত হয়েছিল যখন বেনসুদা ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রাথমিক পর্যালোচনা শুরু করেছিলেন। ইসরায়েলের নাগরিকদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে— এ ভয় থেকে ইসরায়েলের কর্মকর্তারা এর বিরোধিতা করেন। ইসরায়েলি মন্ত্রীরা আদালতের ওপর আক্রমণ তীব্র করে এবং এটি ভেস্তে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
বেনসুদা এবং তার প্রসিকিউটরদের সতর্ক করে বলা হয়েছিল, প্রাথমিক পর্যালোচনার সময় ইসরায়েলি গোয়েন্দারা তাদের কাজ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
দুটি সূত্রের মতে, আইসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে সন্দেহ ছিল যে ইসরায়েল আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগের মধ্যে নিজেদের লোক বহাল করেছে। মোসাদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা না হলেও কিছু কার্যক্রম সংস্থাটির সাথে যুক্ত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
আইসিসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের একটি ছোট দলকে জানানো হয়েছিল, মোসাদের প্রধান ব্যক্তিগতভাবে আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটরের সাথে যোগাযোগ করেছেন।
কোহেন বিদেশি এজেন্টদের একজন কার্যকর নিয়োগকারী হিসাবে পরিচিত। নেতানিয়াহু তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পরে ২০১৬ সালে মোসাদ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। কোহেন ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে তার মেয়াদকালে আইসিসির বিরুদ্ধে একটি 'বহু-সংস্থা' প্রচেষ্টা তদারকি করেছিলেন।
বেনসুদার সাথে কোহেনের প্রথম আলাপটি ২০১৭ সালে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ঘটেছিল। পরবর্তীতে তিনি ম্যানহাটনের একটি হোটেল স্যুটে বেনসুদার মুখোমুখি হয়েছিলেন যা একাধিক সূত্রে রিপোর্ট করা হয়েছে।
২০১৮ সালে নিউইয়র্কে একটি সরকারি সফরের সময় আইসিসি প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা কঙ্গোতে তথাকথিত অপরাধের বিষয়ে চলমান তদন্ত নিয়ে হোটেলে কঙ্গোর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কাবিলার সাথে দেখা করেছিলেন।
বৈঠকটি একটি অপ্রত্যাশিত মোড় নেয় যখন কোহেন বেনসুদার কর্মীদের চলে যেতে বলার পর রুমে প্রবেশ করে যা বেনসুদা এবং তার আইসিসি কর্মকর্তাদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করে।
কোহেনকে কাবিলার সহায়তার কারণ অস্পষ্ট হলেও কাবিলা এবং কোহেনের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি ২০২২ সালে প্রকাশ পায় যা ২০১৯ সালে মোসাদ পরিচালকের কঙ্গোতে গোপন ভ্রমণের সাথে সম্পর্কিত।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা প্রধান ইয়োসি কোহেনের ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো (ডিআরসি) থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জোসেফ কাবিলার পরামর্শ নেওয়ার জন্য করা অত্যন্ত অস্বাভাবিক সফর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর অনুমোদন নিয়ে এটি করা হয়েছিল।
সফরগুলো ইসরায়েলের অন্যতম সংবেদনশীল গোপনীয়তা হিসেবে বর্ণিত একটি বিতর্কিত পরিকল্পনার সাথে সম্পর্কিত ছিল। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, সফরগুলো আংশিকভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিরুদ্ধে অভিযানের সাথে যুক্ত ছিল এবং কাবিলা আইসিসির প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদার বিরুদ্ধে মোসাদের পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
হুমকি এবং বিভিন্ন কারসাজি
নিউ ইয়র্কে ইসরায়েলি গোয়েন্দা প্রধান ইয়োসি কোহেন এবং আইসিসির প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা অপ্রত্যাশিতভাবে মুখোমুখি হওয়ার পর,কোহেন বারবার বেনসুদার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে কোহেন একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন।
বেনসুদা শেষ পর্যন্ত আইসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোহেনের আচরণ সম্পর্কে অবহিত করেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বেনসুদা গাজা, পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে কথিত যুদ্ধাপরাধের জন্য একটি ফৌজদারি তদন্ত শুরু করার পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক ট্রায়াল চেম্বার থেকে ফিলিস্তিনের উপর আইসিসির এখতিয়ারের বিষয়ে একটি রায় মুলতবি রেখেছিলেন।
২০১৯ সালের শেষের দিকে এবং ২০২১ সালের শুরুর দিকে আইসিসির প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা এবং মোসাদ প্রধান ইয়োসি কোহেন অন্তত তিনবার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এ সময় কোহেন বেনসুদার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সম্পূর্ণ তদন্ত তার কর্মজীবনের ক্ষতি করতে পারে।
তিনি বেনসুদাকে গোপনে তার স্বামীর তোলা ছবিও দেখিয়েছিলেন এবং এবং সংস্থাটির কর্মকাণ্ডে বেনসুদা হুমকি বোধ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, মোসাদ সক্রিয়ভাবে বেনসুদা এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে আপোষমূলক তথ্য খুঁজছিল।
মোসাদ আইসিসি প্রসিকিউটর বেনসুদার স্বামীর ব্যাপারে সম্ভাব্য অপরাধমূলক তথ্য পেলেও তাকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।
ইসরায়েলের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্পের সরকারের সাথে সমন্বয় করে ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কথিত যুদ্ধাপরাধের তদন্তে থেকে আইসিসিকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও নিষেধাজ্ঞাকে ফিলিস্তিন মামলার সাথে যুক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "এটা পরিষ্কার যে আইসিসি শুধু নগ্নভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইসরায়েলকে বলি দিচ্ছে।"
কয়েক মাস পরেই তিনি বেনসুদাকে কোন প্রমাণ ছাড়াই ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য দুর্নীতিমূলক কাজে জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্ত করেন
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইসিসির প্রাথমিক বিচার চেম্বার থেকে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে আইসিসির এখতিয়ার রয়েছে তা নিশ্চিত করে একটি রুল জারি করা হয়। পরের মাসে বেনসুদা ফৌজদারি তদন্ত শুরু করার ঘোষণা দেন।
বেনসুদা আইসিসিতে তার মেয়াদ শেষ করেন তদন্তের ভার তার উত্তরসূরিকে দিয়েছিলেন। এ প্রচেষ্টায় ইসরায়েলের মোসাদের ব্যবহারকে ভীতি প্রদর্শনের কৌশল হিসেবে দেখা হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়