মোদি ম্যাজিক: কেন ভারতের বুথফেরত জরিপে বিজেপির রেকর্ড জয়ের আভাস দেয়া হচ্ছে
বিভিন্ন বুথফেরত জরিপে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে স্বাধীন ভারতে টানা তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড করতে যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদি (৭৩)।
গত শনিবার ছয় সপ্তাহ ধরে চলা সাত দফার শেষ ধাপের ভোটগ্রহণ হয়েছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ১০০ কোটি ভারতীয় ভোট দিয়েছেন।
শনিবার সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন বুথফেরত জরিপে মোদির পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (৪ জুন) নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা করা হবে।
যদি বুথফেরত জরিপ সত্য হয় তাহলে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কেবল ক্ষমতায় আসবেই না, বরং ২০১৯ সালের নির্বাচনের চেয়েও ভালো ফলাফল নিয়ে আসবে।
এর আগে স্বাধীন ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী টানা তিনবার লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিততে পারেননি।
ভারতীয় গণমাধ্যম সংস্থাগুলোর প্রকাশিত অন্তত সাতটি বুথফেরত জরিপে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি ও তার মিত্ররা ৩৫০-৩৮০টি আসনে জয়লাভ করবে।
তবে বুথফেরত জরিপ নিয়ে ভাবতে নারাজ বিরোধী দলীয় জোট 'ইন্ডিয়া'।
বিজেপির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী সরকারের অপসারণপ্রত্যাশী দুই ডজনেরও বেশি রাজনৈতিক দলের জোট 'ইন্ডিয়া'।
ইন্ডিয়া জানিয়েছে, আত্মবিশ্বাস আছে নির্বাচনে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে।
যদিও অতীতে ভারতের সব বুথফেরত জরিপ সঠিক হয়েছে, তা নয়। তবে কিছু ব্যতিক্রম বাদে গত দুই দশকে বেশিরভাগ জরিপে সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
রবিবার নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিআর) সিনিয়র ফেলো নীলাঞ্জন সরকার বলেন, 'মোদি অসাধারণ জনপ্রিয়। তাই বিজেপির প্রচারণার সবকিছুই মোদিকে ঘিরে।'
তিনি বলেন, 'জনগণ হয়ত সরকারের উপর বিরক্ত। তারপরও বিজেপিকে টক্কর দেওয়া সব দলের জন্যই কঠিন হবে।'
নতুন নতুন এলাকায় সম্প্রসারিত হচ্ছে বিজেপি
এর আগে বিভিন্ন পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, দেশের দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে 'ইন্ডিয়া' ভালো ফল করবে।
তবে বেশিরভাগ বুথ ফেরত সমীক্ষা বলছে, সেখানেও বিজেপি চমকপ্রদ সাফল্য লাভ করতে পারে।
বেশ কয়েকটি বুথফেরত জরিপে ধারণা করা হচ্ছে, ভারতীয় বামপন্থীদের শেষ শক্ত ঘাঁটি কেরালায় এবার বিজেপি দুই-তিনটি আসন পেতে পারে। এর আগে মোদির দল কখনো এখানে কোনো আসন জিততে পারেনি।
এছাড়া, বিজেপি তামিলনাড়ুতে এক থেকে তিনটি আসন জিততে পারে, গত নির্বাচনে সেখানেও তারা কোনো আসন পায়নি।
এসব আসনে জয় পেলে বিভিন্ন বিরোধীর শক্ত ঘাঁটিতে পা রাখার সুযোগ পাবে বিজেপি। গত কয়েক দশক ধরে তারা এ চেষ্টা করছে।
এছাড়া বিজেপি এবং তার সহযোগীরা কর্ণাটকে তাদের আগের আসন ধরে রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে রাজ্যের ২৮টি আসনের মধ্যে ২৫টি আসন জিতেছিল বিজেপি। এমনকি তেলঙ্গানায় সর্বোচ্চ আসন জিততে পারে বিজেপি।
এসব ধারণা সত্য হলে তা বিরোধী কংগ্রেসের জন্য একটি নাটকীয় ধাক্কা হবে। কংগ্রেস 'ইন্ডিয়া' জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। গত বছর কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানায় রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করে জয়লাভ করেছে দলটি।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার অসীম আলী বলেন, 'দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিজেপির জয় পাওয়ার বিষয়টি বিস্ময়কর। এসব জরিপে বিজেপির বড় ব্যবধানে জয়ের পূর্বাভাস দেওয়া যাচ্ছে। যদি বিজেপি এত বেশি (বুথফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস) আসন না-ও পায়, তাহলেও তাদের আসন সংখ্যা আগের চেয়ে বহুদূর এগিয়ে যাবে।'
ধারণা করা হচ্ছে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, দিল্লি, উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশসহ নিজেদের শক্ত ঘাঁটি ধরে রাখবে বিজেপি।
এছাড়া বিহার, রাজস্থান, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবেও বিরোধী জোট তেমন সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয়না। গত নির্বাচনে বিহার ও রাজস্থানে বিজেপি পায় সবগুলো আসনে জয়লাভ করেছিল। এবারও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাজস্থানের চিতোরগড়ের ৭৬ বছর বয়সী ভোটার সুধা জোশী তার স্মার্টফোনে শনিবার সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন চ্যানেলের সংবাদ দেখে যাচ্ছেন। কারণ সংবাদ পাঠকেরা শনিবার সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন জরিপে মোদির জয়ের সম্ভাবনার কথা বলছেন।
গত বছর রাজ্যে কংগ্রেস সরকার পরিচালিত একটি কল্যাণমূলক প্রকল্পের আওতায় স্মার্টফোনটি হাতে পান তিনি।
গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে কংগ্রেসকে হারিয়ে রাজস্থানের ক্ষমতায় আসে বিজেপি।
অন্য অনেকের মতোই জোশীর রাজনৈতিক মতাদর্শও বদলেছে। ১৯৪৭ সালে জন্ম নেওয়া জোশী কখনো ভোট দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
একসময়ের কংগ্রেসের একনিষ্ঠ ভোটার যোশী বলেন, তিনি নেহরু-গান্ধী পরিবারে প্রতি আশা হারিয়ে ফেলেছেন। এর পরিবর্তে মোদির মধ্যে তিনি একজন সত্যিকার নেতাকে দেখতে পেয়েছেন।
বুথফেরত সমীক্ষা নিয়ে উচ্ছ্বসিত জানিয়ে তিনি বলেন, '২০১৪ সালে মোদি যখন প্রথমবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন আমি এমন একজন নেতাকে দেখতে পেয়েছিলাম; যিনি ভারতকে আন্তর্জাতিক উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। আমরা তার শাসনে সন্তুষ্ট কারণ তিনি আমাদের মতোই একজন ধার্মিক মানুষ, সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।'
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নারীর মতামত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনোভাবের প্রতিফলন।
সিপিআর নিয়ে সরকার বলেন, 'সমাজের একটা বড় অংশ মনে করেন, যেই দলে মোদির মতো একজন মানুষ শীর্ষে আছেন, সেই দলকে তারা বিশ্বাস করতে পারবেন। মোদিকেই তারা নিজেদের নেতা হিসেবে মনে করতে পারেন। বিজেপি তার সাফল্যের জন্য মোদির জনপ্রিয়তার কাছে ঋণী।'
বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র জাফর ইসলাম বলেছেন, বুথফেরত সমীক্ষায় প্রতিফলিত হয়েছে যে ভোটাররা 'বিজেপির শাসনের মডেল, কল্যাণমূলক প্রকল্প এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেছেন'।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, 'মোদির নেতৃত্বে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। তাই আমরা এই ঐতিহাসিক বিজয়ের অপেক্ষায় রয়েছি।'
বিজেপির আধিপত্যের আরও পাঁচ বছর?
মোদির এবারের নির্বাচনী প্রচারণা সমাবেশগুলো ছিল রীতিমতো ভীতিপ্রদ।
এসব সমাবেশে তিনি নিজে এবং বিজেপি ক্রমাগত মোদিকে মুসলমানদের সমর্থনকারী বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর হিন্দু জনগণের ত্রাণকর্তা হিসেবে দাবি করেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের দাবি করা ভারতের নির্বাচনী প্রচারণা সমাবেশে মোদি অসংখ্যবার মুসলমানদের 'অনুপ্রবেশকারী' এবং 'যারা বেশি বেশি সন্তান জন্ম দেয়' বলে অভিহিত করেছেন।
আনুমানিক ২০০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ ভারত। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ মুসলমান বসবাসকারী দেশ ভারত।
এদিকে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যের প্রশ্নে মোদিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে বিরোধীরা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ২১ বছরের ছাত্র বিক্রান্ত সিংয়ের কথায় সেই প্রসঙ্গ উঠে আসে।
বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়ে ১৬০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে নিজের বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে, বেকারত্ব বাড়ছে। আমার স্নাতকোত্তর প্রায় শেষ, কিন্তু দেশে কোনো চাকরির সুযোগ নেই।'
তিনি নতুন ভোটার। সিং এবং তার সমবয়সী ভারতীয়দের কাছে কংগ্রেস সরকারের শাসনকাল এখন বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতি। সর্বশেষ ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস।
তিনি বলেন, কংগ্রেসের ভবিষ্যত খুব ভালো বলে মনে হয় না।
তিনি আরও বলেন, 'শাসনের চেয়ে বিজেপির মূল লক্ষ্য ভোটে জেতা। তারা সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তথ্য পাওয়ার মাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা তরুণদের মনে জায়গা করে নিচ্ছে।'
ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে বিজেপি তার মিত্রদের নিয়ে ৮০টি আসনের মধ্যে ৬৫টিরও বেশি আসন পাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। গত নির্বাচনে বিজেপি এখানকার ৬২টি আসন জিতেছিল।
বুথফেরত সমীক্ষা প্রকাশের পর মোদি বলেন, বিরোধী জোট ভোটারদের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি এক্স-এ লিখেছেন, এত প্রচারণা করার মাধ্যমে তারা কেবল একটি বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছে, তা হলো মোদি ব্যাশিং (গালমন্দ করা)। তাই এ ধরনের পশ্চাৎপদ রাজনীতিকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।'
নির্বাচনের ফলাফলে যদি বুথফেরত জরিপের প্রতিফলন ঘটে, তবে আরও পাঁচ বছর 'মোদি এবং অমিত শাহ জোটের হাতে' ভারতের শাসন ক্ষমতা থাকবে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি