হিট স্ট্রোক মোকাবিলায় ভারতের ইমার্জেন্সি রুম, চিকিৎসা হচ্ছে বরফ পানির সিরামিক টাবে
'আমি এর আগে এমন পরিস্থিতি কখনও দেখিনি', বলছিলেন ভারতের দিল্লির স্বনামধন্য এক হাসপাতালের চিকিৎসক।
রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালের (আরএমএলএইচ) ড. অজয় চৌহান বলেন, '১৩ বছরের কর্মজীবনে হিট স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুতে কোনো ডেথ সার্টিফিকেটে সই করেছি বলে মনে পড়ে না। অথচ এই বছর বেশ কয়েকটিতে সই করা লেগেছে আমার।'
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে গোটা ভারত, অসহনীয় অবস্থা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। মে মাস থেকে দিল্লিতে দৈনিক তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) ছাড়িয়ে প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। তাপদাহে যখন নাভিশ্বাস উঠছে, তারমধ্যে পানির সংকটও দেখা দিয়েছে ভারতের বিভিন্ন অংশে। পানির চাহিদা বিপুলভাবে বেড়ে গেছে।
উচ্চ আর্দ্রতা, গরম বাতাস, জলের ঘাটতি এবং উচ্চ চাহিদা এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মতো সমস্যার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তাপজনিত অসুস্থতায় অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই ভারতের লোকসভা নির্বাচন শেষ হয় গত ১ জুন। উত্তর প্রদেশ ও বিহারে শেষ ধাপের ভোটগ্রহণে দায়িত্বরত ১৮ জন কর্মকর্তা গরমজনিত অসুস্থতায় গত মাসে মারা গেছেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, দেশটির ১ মার্চ থেকে ২০ মে পর্যন্ত অন্তত ৫৬ জন হিট স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়া প্রায় ২৪,৮৪৯টি হিট স্ট্রোকের ঘটনা ঘটেছে।
হিট স্ট্রোক হলো মারাত্মক তাপজনিত অসুস্থতা। এটিকে তিনটি মূল লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়:
- উচ্চ তাপ এবং আর্দ্রতার সংস্পর্শে আসা
- শরীরের তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বা তার বেশি থাকা
- মাথা ঘোরানো, বিভ্রান্তি বা কথা জড়িয়ে যাওয়া
হিট স্ট্রোক একটি নীরব ঘাতক। সূর্যের সংস্পর্শে আসার কয়েক ঘণ্টা পরই লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে পারে। ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের তথ্য অনুযায়ী, হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর হার ৪০-৬৪ শতাংশ।
মে মাসের শেষের দিকে দিল্লির ডা. চৌহানের হাসপাতালে হিট স্ট্রোকের বিশেষ ক্লিনিক খোলার পর থেকে এ পর্যন্ত হিট স্ট্রোকে সাতজন মারা গেছেন এবং ৪০ জনেরও বেশি তাপজনিত অসুস্থতায় চিকিৎসা নিয়েছেন। রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই মূলত পুরুষ, যারা বিভিন্ন ছোট কারখানায় চরম পরিবেশে কাজ করতেন।
এটা নিশ্চিত যে, এই তাপপ্রবাহ শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ নয়: মার্চ থেকে কয়েক ডজন মানুষ তাপজনিত অসুস্থতায় মারা গেছেন, উত্তরপ্রদেশ ও উড়িষ্যা রাজ্যে জুনের গোড়ার দিকে মাত্র তিন দিনে ৫০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
তবে গ্রামীণ এলাকায় গরমের কারণে মৃত্যুর ঘটনা তেমনভাবে নথিভুক্ত না হওয়ায়– প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
আরএমএলএইচের বিশেষায়িত হিট স্ট্রোক ক্লিনিকে ডাক্তাররারা হিট স্ট্রোকের রোগীদের বাঁচাতে তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। সম্প্রতি, ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৭.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট) শরীরের তাপমাত্রা নিয়ে একজন রোগী আসেন, তিনি হিট স্ট্রোকে ভুগছিলেন।
এই উচ্চ তাপমাত্রায়, শরীর নিস্তেজ হতে শুরু করে, কোষগুলো ভেঙে যায় এবং অঙ্গ ব্যর্থতার ঝুঁকি থাকে। শরীর ঘাম বন্ধ করে দেয় এবং ত্বক ঠান্ডা এবং ক্ল্যামি হয়ে যায়।
এই উচ্চ তাপমাত্রায়, শরীর বন্ধ হতে শুরু করে, কোষগুলি ভেঙে যায় এবং অঙ্গগুলি ব্যর্থ হতে পারে। শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যাওয়ার ফলে ডিহাইড্রেশন সৃষ্টি হয়। ঘামের সঙ্গে লবণ বেরিয়ে যাওয়াতে লবণের ঘাটতি দেখা দেয়, যা শরীরকে অবসন্ন ও পরিশ্রান্ত করে তোলে।
এর ফলে অনেকের মাথাঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে মৃত্যুও হতে পারে।
ক্লিনিকে, ডাক্তাররা ওই রোগীকে ২৫০ লিটারের একটি সিরামিক টবে বরফ পানিতে ডুবিয়ে রেখেছিলেন, যেখানে তাপমাত্রা শূন্য থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। ক্লিনিকটিতে দুটি সিরামিক টব, একটি ২০০ কেজি বরফ তৈরির মেশিন, রেকটাল থার্মোমিটার, আইস বক্স এবং ইনফ্ল্যাটেবল টব রয়েছে। আরও চিকিৎসার জন্য ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে ওই রোগীর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২৫ মিনিট সময় লেগেছিল।
'দ্রুত শরীরকে ঠান্ডা করা জীবন বাঁচায়। প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান', বলেন ড. চৌহান। সামান্য বিলম্বও মারাত্মক হতে পারে, যার ফলে রোগীর রক্তক্ষরণ হতে পারে বা কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হতে পারে।
দিল্লিতে অসুস্থ হওয়া খুব সহজ। কারণ জীবন এখানে বড়ই কঠিন। শহরটির ৬ হাজার ৪০০ বস্তিতে ১০ লাখেরও বেশি পরিবার, নিম্নমানের ও ঘিঞ্জি আবাসনে বাস করে, যেখানে ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই।
পুরুষরা বাইরে কাজ করতে গিয়ে এবং নারীরা দীর্ঘক্ষণ ধরে চুলার পাশে রান্না করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
দিল্লিতে সবুজ জায়গার অভাব। গ্রীষ্মে শহরটি একটি জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত হয়, ওপর থেকে সূর্যের উত্তাপ এবং নিচের তপ্ত মাটি জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে।
হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আরএইচএমএলে ভর্তি হওয়া এক দিনমজুরের স্ত্রী অঞ্জনা কুমারী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে তাদের ঘরের একমাত্র পাখা কাজ করছিল না। তার স্বামী, সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে এসে ঘুমাতে পারতেন না এবং পরে খিঁচুনি, বমি এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। রাতে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি।
অঞ্জনা কুমারী বলেন, "চিকিৎসকরা আমাকে বলেছেন যে কিছুদিন তিনি হাঁটাহাঁটি করতে পারবেন না এবং তার অনেক যত্নের প্রয়োজন।"
মূলত যাদের জীবিকার টানে ঘরের বাইরে থাকতে হয়, তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন। গরমের কারণে দিল্লির রাস্তার বিক্রেতাদের ওপর তাপ কীভাবে প্রভাব ফেলে সে বিষয়ে গ্রিনপিসের একটি নতুন জরিপে বেশিরভাগ উত্তরদাতা গরমের কারণে স্বাস্থ্য সমস্যার কথা জানিয়েছেন।
৭৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ বিক্রেতারা প্রধান সমস্যা হিসেবে গরমের কারণে মেজাজ খারাপ বা বিরক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, তারপরে মাথাব্যথা, পানিশূন্যতা, রোদে পোড়া, ক্লান্তি এবং মাসল ক্র্যাম্প (মাংসপেশির ব্যথাযুক্ত সংকোচন)। পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় বেশিরভাগেরই চিকিৎসা পরিষেবা নিতে সমস্যা হয়েছিল।
গুড্ডি নামের একজন আখের রস বিক্রেতা গ্রিনপিসকে বলেন, 'গরম প্রতিদিনই বাড়ছে। আমাদের খোলা আকাশের নিচে রোদের মধ্যে কাজ করতে হয়। আশেপাশে কিছু গাছপালা থাকলে ভালো হতো, তাহলে ঠান্ডা বাতাস বইত এবং আমাদের শরীরও আরাম পেত কিছু।'
'সারাদিন রোদে থাকার পর রাতে আর খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি শুধু পা ছড়িয়ে ঘুমাতে চাই', যোগ করেন তিনি।
গরমের কারণে ভারতজুড়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সেন্টার ফর র্যাপিড ইনসাইটসের (সিআরআই) নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া ৪৫ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, গত মাসে গরমে অন্তত একজন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৭ শতাংশের বেশি পরিবারের সদস্যরা পাঁচ দিনের বেশি সময় ধরে অসুস্থ ছিলেন। দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে এই প্রভাব আরও তীব্র ছিল।
মোটরসাইকেল আছে এমন ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং যানবাহন নেই এমন ২৮ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারের সদস্য পাঁচ দিনের বেশি সময় ধরে অসুস্থ ছিলেন। বিপরীতে, গাড়ি রয়েছে এমন পরিবারের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২১ দশমিক ৮ শতাংশ।
ভারতের তিন-চতুর্থাংশ শ্রমিক, তীব্র গরম পরিবেশে কাজ করেন। ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে অতিরিক্ত গরমের কারণে ২০২১ সালে ভারতীয়দের প্রায় ১৬৭.২ সম্ভাব্য কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। সিআরআই-এর ডিরেক্টর নীলাঞ্জন সরকারও উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তাপপ্রবাহে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভারত মৃত্যুর তথ্য সঠিকভাবে সংকলন না করায় বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।
ভারতের হিট অ্যাকশন প্ল্যানও ঠিকমতো কাজ করছে না বলে সমীক্ষায় ওঠে এসেছে। গ্রিনপিসের সমীক্ষা অনুযায়ী, দিল্লির ৬৮ শতাংশ বিক্রেতা তাপপ্রবাহের সম্পর্কে ধারণা রাখেন। তবু রাজনৈতিক আলোচনায় তাপপ্রবাহের বিষয়টি গুরুত্ব পায় না।
নীলাঞ্জন সরকার বলেন, 'অনেকে তাপপ্রবাহকে প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে দেখেন, যেখানে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার আছে বলে মনে করেন না। এটি ভারতের জনগণের প্রত্যাশার পারদের নিম্নমুখীতা-ই প্রতিফলিত করে।'
দিল্লির পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। ২০২২ সালে, ভারতে ২০৩ দিন তাপপ্রবাহ ছিল, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এরমধ্যে কেবল দিল্লিতেই প্রায় ১৭ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। মার্চ মাসকে আবহাওয়া দপ্তর দ্বারা ভারতের উষ্ণতম মাস হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছিল এবং ৭২ বছরের মধ্যে এপ্রিলে দিল্লিতে দ্বিতীয় উষ্ণতম এপ্রিলের সাক্ষী হয়েছিল।
সতর্ক করে ড. চৌহান বলেন, 'এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে'।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন