সহমরণ: সুখী এই দম্পতি কেন মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন
নেদারল্যান্ডসের ইয়ান ও এলস দম্পতি। বৈবাহিক জীবনে প্রায় ৫০ বছর একসঙ্গে কাটিয়েছেন তারা। আর মারাও গিয়েছেন একইসঙ্গে। তবে তাদের একসঙ্গে মৃত্যু কোনো কাকতালীয় বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে নয়, বরং ইচ্ছাকৃত।
এ দম্পতি যে পন্থায় স্বেচ্ছায় একসঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেটির নাম ডুয়ো-ইউথেনেশিয়া (একসঙ্গে মরা বা সহমরণ)। নেদারল্যান্ডসে এ উপায়ে মৃত্যু বৈধ। প্রতি বছর বহু ডাচ দম্পতি একসঙ্গে নিজেদের জীবনের ইতি টানতে এ পথ বেছে নেন। খবর বিবিসির।
অর্থাৎ দেশটিতে যদি কেউ ব্যক্তি এমন কোনো অসুখে আক্রান্ত হন, আর তার সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকে, সেক্ষেত্রে অসুস্থ ব্যক্তি চাইলে ইউথেনেশিয়া বা স্বেচ্ছায় মারা যাওয়ার অনুরোধ জানাতে পারেন।
এরপর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ওই ব্যক্তির শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক কষ্ট বা যন্ত্রণা মূল্যায়ন করেন। যদি চিকিৎসকরা মনে করেন যে অসুখটি ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা বা লক্ষণ নেই, তখন ওই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মারা যাওয়ার পথটি বেছে নিতে পারেন।
এ দম্পতি বেশ ভ্রমণপিপাসু ছিলেন। দাম্পত্য জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তারা হয়তো মোটরহোম, নয়তো বা নৌকায় ঘুরে বেরিয়ে কাটিয়েছেন। এমনকি মারা যাওয়ার তিন দিন আগেও তারা তাদের ক্যাম্পারভ্যান নিয়ে উত্তর নেদারল্যান্ডসের ফ্রিজল্যান্ডে বেড়াতে গিয়েছিলেন।
২০০৩ সালে ইয়ানের (৭০) পিঠে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। কিন্তু তার এ অসুখ পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। তাই একপর্যায়ে তাকে হতাশা পেয়ে বসে। তিনি ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেন। ধীরে ধীরে তিনি কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
অন্যদিকে এলস (৭১) ব্যস্ত ছিলেন শিক্ষকতা নিয়ে। অসুখের কারণে তার সঙ্গে প্রায়ই ইয়ান ইউথেনেশিয়া নিয়ে আলাপ করতেন। ইয়ান তার পরিবারকে জানিয়েছিলেন যে শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে তিনি বেশি দিন বাঁচতে চান না। ওই সময়ে এ দম্পতি নেদারল্যান্ডসের 'মৃত্যুর অধিকার' বিষয়ক সংস্থা এনভিভিই-তে যোগ দেন।
২০১৮ সালে এলস শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। ওই সময়ে তার ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার পরও তিনি চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে তার এ অসুখের লক্ষণগুলো আরও তীব্র হয়।
২০২২ সালের নভেম্বরে চিকিৎসক যখন এলসকে তার ডিমেনশিয়া রোগের কথা জানান, তখন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে স্বামী ও ছেলেকে রেখেই চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।
ইয়ান সে সময় বলেছিলেন, অসুখের কথা শোনার পর এলস প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
এলস যখন জানতে পারলেন তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন তিনি স্বামী ও তার ছেলের সাথে ডুয়ো-ইউথেনেশিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
২০২৩ সালে নেদারল্যান্ডসে ৯ হাজার ৬৮ জন ইউথেনেশিয়া বা স্বেচ্ছায় মারা গেছেন, যা ওই বছর দেশটিতে মোট মৃত্যুর ৫ শতাংশ। আর ডুয়ো-ইউথেনেশিয়ার ঘটনা ৩৩টি, অর্থাৎ এভাবে মারা গেছেন ৬৬ জন।
রটারডামের ইরাসমাস মেডিক্যাল সেন্টারের বার্ধক্যদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রোজমারিন ফন ব্রুছাম বলেন, 'বহু চিকিৎসক ডিমেনশিয়া রোগীর জন্য ইউথেনেশিয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান।'
ইয়ান ও এলসের বেলায়ও তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তার (জিপি) এমনটি করেছিলেন।
ইয়ান ও এলসের জিপি ইউথেনেশিয়ার বিষয়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করায় তারা সেন্টার অব এক্সপার্টাইজ অন ইউথেনেশিয়া নামের একটি ভ্রাম্যমাণ ইউথানেশিয়া ক্লিনিকের সাথে যোগাযোগ করেন।
যখন কোনো দম্পতি একসাথে মারা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন চিকিৎসকরা এটা নিশ্চিত হয়ে নেন যে দম্পতির কোনো একজনের সিদ্ধান্ত অন্যজনকে প্রভাবিত করছে কি না।
চিকিৎসক বেট কিজার এ বিষয়ে জানান, একবার তার কাছে এক দম্পতি সহমরণের জন্য এসেছিলেন। তখন তার সন্দেহ হয়েছিল যে হয়ত তাদের মধ্যে স্ত্রী নিজ ইচ্ছায় এখানে আসেননি। তাই তিনি ওই নারীর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। তখন তার সন্দেহ সত্যি হয়।
ওই নারী কিজারকে জানিয়েছিলেন যে তার অনেক অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। তার স্বামী খুবই অসুস্থ। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে মারা যাওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই।
এ কারণে ওই দম্পতির ইউথেনেশিয়ার অনুরোধ গ্রহণ করা হয়নি। পরে ওই ব্যক্তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যু হয়। তার স্ত্রী আজও বেঁচে আছেন।
ইয়ান ও এলস হয়ত তাদের ক্যাম্পারভ্যানে আরও অনেকদিন একসাথে বাঁচতে পারতেন। তবে এলস বলেছিলেন, 'না, না, না- আমি তেমনটা মনে করি না।'
আর ইয়ান বলেন, 'আমি আমার জীবন যা কাটানোর কাটিয়েছি। আমি আর ব্যথা পেতে চাই না। আমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। আমার মনে হয় এটি এখানেই শেষ করা উচিত।'
এরপর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা এলসকে জানিয়েছিলেন যে তিনি চাইলে এ বিষয়ে এখনও নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে পরে যদি তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হয়, সেক্ষেত্রে তিনি সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন।
ইয়ান বলেছিলেন, তাদের সন্তানের কাছে বাবা-মার এভাবে মরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। তাই সে প্রচণ্ড কান্না করেছিল।
ইয়ান তার ছেলেকে বলেছিলেন- 'তুমি তোমার বাবা-মাকে মরতে দিতে চাও না। তাই কাঁদছো।'
তখন তার ছেলে উত্তরে বলেছিলেন- 'ভালো সময় আসবে, ভালো পরিস্থিতি আসবে। তবে আমার জন্য নয়।'
ডিমেনশিয়া অসুখ ধরা পড়ার পর এলসও তার স্বামীর মতো করেই ভাবছিলেন। তার কাছে সমাধানের আর কোনো পথ ছিল না।
ইউথেনেশিয়ার জন্য চিকিৎসকের সাথে দেখা করার আগের দিন ইয়ান ও এলস দম্পতি তাদের ছেলে ও নাতি-নাতনির সাথে ছিলেন। তখন ইয়ান তাদের ক্যাম্পারভ্যানটির অবস্থা জানিয়েছিলেন, যাতে সেটি বিক্রি করা যায়।
ইয়ানের ছেলে বলেন, 'এরপর আমি মায়ের সাথে সমুদ্রতীরে হাঁটতে গিয়েছিলাম। বাচ্চারা খেলছিল, অনেক মজা হচ্ছিল…। এটি সত্যিই খুব অসাধারণ একটি দিন ছিল।'
তিনি আরও বলেন, `আমার মনে আছে, সন্ধ্যায় আমরা একসঙ্গে ডিনার করেছিলাম। এটি ছিল একসাথে করা আমাদের শেষ ডিনার। এ কথা ভেবেই আমার চোখে জল এসেছিল।'
দিনটি ছিল সোমবার (৩ জুন)। সেদিন সকালে এ দম্পতি স্থানীয় একটি হাসপাতালে যান। ইয়ান ও এলসের ভাই, পুত্রবধূ এবং তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিও তাদের সাথে সেখানে গিয়েছিলেন।
ইয়ানের ছেলে বলেন, 'ডাক্তাররা আসার আগে আমরা দুই ঘণ্টা একসাথে ছিলাম। আমরা একসাথে কাটানো আমাদের স্মৃতিগুলো নিয়ে আলাপ করছিলাম আর গান শুনছিলাম।'
তিনি জানান, তার মা এলস তখন ট্রাভিসের আইডলওয়াইল্ড ও তার বাবা দ্য বিটলস' এর নাও অ্যান্ড দেন গানটি শুনেছিলেন।
শেষের আধা ঘণ্টা খুবই কঠিন মুহূর্ত ছিল বলে জানান ইয়ান-এলস দম্পতির ছেলে। তিনি বলেন, 'ডাক্তার আসার পর সবকিছু যেন চোখের পলকে ঘটে গেল। ডাক্তাররা তার বাবা-মাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ (ইউথেনেশিয়ার ওষুধ) দিলেন। সে ওষুধ খাওয়ার পর এটি ছিল কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র।'
ওষুধ গ্রহণের পর ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এল ইয়ান ও এলসের চোখ। একসাথে তারা পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক