হাতি, মোগল আমলের গহনা, তারকাদের মেলা: ভারতীয় বিয়ের বাজার পৌঁছেছে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে!
এক সপ্তাহেরও কম সময়ে ভারতের ধনকুবের মুকেশ আম্বানির ছেলে অনন্ত আম্বানির বিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটিকে বছরের বহুল প্রতীক্ষিত বিয়ে বললেও ভুল হবে না। কেননা বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে ব্যাপক ধুমধামের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হবে। এর আগে জাঁকজমকপূর্ণ প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল বিলিওনিয়ার আম্বানি পরিবার।
তবে ভারতের বিলাসবহুল বিয়ের রীতি নতুন নয়। বরং আম্বানির মতো এতো বৃহৎ না হলেও ব্যয়বহুল বিয়ের অনুষ্ঠান দেশটিতে অহরহই হয়। আর এতে করে দেশটির অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে।
আম্বানির ছেলের বিয়ের অতিথি তালিকাও যেন চমকে ওঠার মতো। সিলিকন ভ্যালির বিলিওনিয়ার থেকে বলিউড তারকা; কে নেই এখানে! সকলের জন্যই যেন এটি একটি মিলনমেলা। এতে করে যেন বিশ্ব অর্থনীতিতে পরিবারটির ক্রমবর্ধমান আধিপত্য ফুটে উঠেছে। একইসাথে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী পরিবারটি মহারাজা কিংবা মুঘল সম্রাটদের মতো অমূল্য গহনা কিংবা রত্ন প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদের প্রতীকী প্রদর্শন করছে।
আম্বানি পরিবার ভারতীয় বিয়ের রীতিতে অতি ধনীদের জন্য যেন একটি আলাদা মানদণ্ড স্থাপন করেছে। যা বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশটির ক্রমবর্ধমান অতি-ধনীদের প্রভাবিত করবে।
বিয়ের ম্যানেজমেন্টে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান 'দ্য নট ওয়ার্ল্ডওয়াইড'-এর সিইও টিম ছি সিএনএন-কে বলেন, "ভারতের বিয়ের ইন্ডাস্ট্রিতে আম্বানি পরিবারের মতো বিয়ের অনুষ্ঠানের বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। যা ব্যবসা বৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রচার এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।"
করোনা পরবর্তী সময়ে ভারতের বিয়ের ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জেফেরিস গ্রুপের গত মাসের রিপোর্ট মতে, ভারতে এটি বর্তমানে ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার। যা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রেরও দ্বিগুণ। তবে তা চীনের চেয়ে কম।
জেফেরিসের পক্ষ থেকে বলা হয়, "মূল্যবোধ-সচেতন সমাজ হিসেবে ভারতীয়রা বিয়েতে খরচ করতে পছন্দ করে। এটি সকল অর্থনৈতিক শ্রেণিতেই দেখা যায়।"
ভারতীয় একটি বিয়েতে গড়ে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করা হয়। যা কি-না একটি পরিবারের বাৎসরিক গড় আয়ের তিনগুণ।
স্ট্যাটাস রক্ষা করার প্রয়াস
বিশ্বের যেকোনো দেশের বিয়েতেই প্রচুর পরিমাণে খরচ করা হতে পারে। তবে ভারতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে মূলত নিজের স্ট্যাটাস ধরে রাখতে ও ক্ষমতা প্রদর্শনে এমনটা করা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার বাবা-মায়েরা সাধারণত নিজের সারাজীবনের সঞ্চয়ের একটি বিরাট অংশ সন্তানদের বিয়েতে ব্যয় করে। কিন্তু এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রবণতা যেন এখন আরও বেশি পরিমাণে বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের উত্থানেরও একটি যোগসূত্র রয়েছে।
দেশটির ম্যারেজ কনসালটেন্ট সিমা তাপারিয়া নেটফ্লিক্সের ডকুসিরিজ 'ইন্ডিয়ান ম্যাচমেকিং' এর মাধ্যমে বেশ আলোচনায় এসেছেন। তিনি বলেন, "গত এক দশকে ভারতীয় বিবাহের রীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। এক্ষেত্রে ধনীরা দেশের বাইরে বড় করে বিয়ের আয়োজন করছে। সেখানে বলিউড অভিনেতা কিংবা বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে আসছেন।"
মোটওয়ানে এন্টারটেইনমেন্ট এন্ড ওয়েডিংস ২০১৮ সালে প্রিয়াংকা চোপড়া ও নিক জোনাসের বিয়ের অনুষ্ঠানে কাজ করেছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা আদিত্য মোটওয়ানে বলেন, "ভারতীয় বিয়েতে সাধারণত নেটওয়ার্ক, ক্ষমতা ও সম্পদের প্রদর্শন করা হয়। এক্ষেত্রে পরিবার জীবনভর এমনভাবেই উদযাপন করে এসেছে বলে পরিচিতদের কাছে তুলে ধরার একটা প্রবণতা দেখা যায়।"
ভারতীয় বিয়ে ঘিরে বৃহৎ অর্থনীতি
ভারতীয় বিয়ে ঘিরে বিশাল অর্থনীতি দেশটির জুয়েলারি ও যোগাযোগ ক্ষেত্রের জন্য যেন আশীর্বাদ। একটি বিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরেই চলে; থাকে নানান আনুষ্ঠানিকতা।
দ্য নট ওয়ার্ল্ডওয়াইডের হিসেব মতে, ভারতীয় বিয়েতে গড়ে ৩২৬ জন অতিথি থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেই সংখ্যা প্রায় অর্ধেক।
এই হিসেব তো সাধারণ বিয়ের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে ধনী পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে আকারটি আরও বড় হয়। ঐ বিয়েগুলোতে হাজার হাজার অতিথি থাকে। অনেক সময় পুরো বিয়েটিই হয় দেশের বাইরে বিলাসবহুল কোনো স্থানে। যেখানে দেওয়া হয় ব্যয়বহুল সব উপহার।
গত মার্চ মাসে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের শহর জামনগরে অনন্ত আম্বানির তিন দিনের প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে মার্ক জাকারবার্গ ও বিল গেটসসহ প্রায় ১২০০ জন হাই-প্রোফাইল অতিথি উপস্থিত ছিলেন।
উৎসবে-আনন্দে মিলিয়ন ডলার খরচ করা ধনীদের জন্য খুব বড় কোনো ব্যাপার নয়। আম্বানি পরিবারের ঐ প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠানে মুহূর্তকে রাঙিয়ে তুলতে প্রায় ৫,৫০০টি ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল। একইসাথে সেখানে পারফর্ম করেছেন রিহানার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্নও তারকা।
এমনকি এসব অনুষ্ঠানে অতিথিদের অদ্ভুত সব আবদারও করতে দেখা যায়। ঠিক যেমনি এক দম্পতি মন্টে কার্লো কোম্পানির কাছে সনাতন ধর্মে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হাতির ব্যবস্থা করতে বলেন।
২০২৭ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতে পারে। সেক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছে যে, দেশটির বিলাসবহুল বিয়ের অনুষ্ঠানও বাড়বে।
রিয়েল এস্টেট কনসালটেন্সি নাইট ফ্রাঙ্কের রিপোর্ট অনুসারে, আগামী পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন নেট সম্পদের ভারতীয়দের সংখ্যা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। যা একই সময়ে যে কোনও দেশের চেয়ে বেশি।
এছারাও অনুমান করা হচ্ছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ভারতীয় মধ্যবিত্ত স্তরে পৌঁছাবে। যারা কি-না দেশের ব্যয় ক্ষমতার ৮০ ভাগেরও বেশি প্রতিনিধিত্ব করবে।
ওয়েডিং প্লানিং কোম্পানি শাদী স্কোয়াডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা টিনা থারওয়ানি বলেন, "মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের আয়ও বাড়বে। যা অবশ্যই জমকালো পার্টি ও উদযাপনে ব্যয় হবে।"
রিহানা, পোশাক ও গহনা
জেফেরিসের তথ্যমতে, বিলাসবহুল ভারতীয় বিয়েতে গড়ে দুই থেকে চার লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়। যাতে থাকে বিশ্বের নানা প্রান্তের ফাইভ স্টার হোটেল, হরেক রকমের খাবার, চোখ ধাঁধানো সাজসজ্জা ও বিনোদনের জন্য নানা আয়োজন। একইসাথে বলিউডের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মানের তারকাদেরও নিয়ে আসা হয়।
তবে জেফেরিসের এই হিসেবে গহনা ও পোশাকের খরচটি যুক্ত করা হয়নি। এক্ষেত্রে ভারতের গহনার মার্কেটের অর্ধেকই কনের গহনার সাথে সংশ্লিষ্ট।
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম গহনার মার্কেট। তবে দেশটিতে হীরা ও অন্যান্য দামী গহনার কদরও বাড়ছে। যেমন, অনন্ত আম্বানির বিয়েতে মা নীতা আম্বানির পরিহিত বিলাসবহুল নেকলেস সকলের দৃষ্টি কেড়েছে।
আর খাবারের কথা তো আলাদা করে বলতেই নেই। বিলাসবহুল বিয়েতে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে বিখ্যাত সব রাঁধুনিদের নিয়ে আসা হয়। একইসাথে খাবারের উপাদানেও বিশ্বমানের স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলা হয়। এছাড়াও ভারতীয়দের অনেকে আবার নিরামিষভোজী। তাদের জন্য করা হয় আলাদা ব্যবস্থা।
থারওয়ানির ক্রিকেট তারকা ভিরাট কোহলির বিয়েতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বলেন, "আম্বানি পরিবারের মতো বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো অন্যান্য পরিসরেও প্রভাব তৈরি করছে।"
দ্য গিফট হাউজের ভ্যনিসা আলমেইদা মার্চে আম্বানি পরিবারের প্রাক-বিবাহের অনুষ্ঠানের অতিথিদের জন্য প্রায় ৮ হাজার উপহারের প্যাকেজিং ও তত্ত্বাবধান করেছিলেন। তিনি সিএনএনকে জানান, দেশের অন্যান্য প্রান্তেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
আলমেইদা বলেন, "আম্বানি পরিবার তার 'এ ক্যাটাগরিভুক্ত' অতিথিদের দামী উপহারগুলি দিয়েছিলেন। যারমধ্যে রয়েছে সিলভার ক্যান্ডেল স্টিক, পাখির ঘর, কাস্টমাইজড চামড়ার পণ্য ইত্যাদি।
এদিকে ভারতে গত এক দশকে বিয়েতে ভিডিওগ্রাফির চাহিদা বেড়েছে। কোম্পানিগুলো একটি ফিল্ম তৈরির জন্য ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত চার্জ করছে। এছাড়াও বহু দম্পতি বিয়ের আগেই ভিডিও শুট করছে। যাতে থাকছে সুদর্শন কোরিওগ্রাফি ও বলিউড মিউজিক। এমনকি বর ও কনে প্রাক-বিবাহ শুটের জন্য দেশের নানা প্রান্তে ভ্রমণ করেন।
স্থানীয় অর্থনীতি
বিয়ের ম্যানেজমেন্টে থাকা কোম্পানিগুলো জানায়, সম্প্রতি দেশের বাইরে বিলাসবহুল বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো হওয়ার রীতি শুরু হওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
গত মে মাসের শেষের দিকে আম্বানি পরিবার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের জন্য ভূমধ্যসাগরীয় ক্রুজে চার দিনের প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। যেখানে বলিউড তারকারা ছাড়াও কেটি পেরি, ব্যাকস্ট্রিট বয়েজের মতো জনপ্রিয় তারকারা উপস্থিত ছিলেন।
মোটওয়ানে বলেন, "এমন অনুষ্ঠানগুলো ঐ এলাকার আয় ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। মাত্র তিন দিনের মধ্যে সেখানে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়।"
এদিকে ভারত সরকার এখন বিলাসবহুল বিয়ে থেকে আয়ের দিকে নজর দিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের ভেতরেই ধনী পরিবারগুলোকে বিয়ে আয়োজনে উত্সাহিত করার জন্য 'ওয়েড ইন ইন্ডিয়া' ক্যাম্পেইন চালু করেছেন৷
গত মার্চ মাসে মোদি বলেন, "প্রায়ই দেশের বাইরে বিয়ের অনুষ্ঠান করে বহু অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভারতেই বিয়ের আয়োজন করলে পরিবারগুলি তিন থেকে চার দিনের জমকালো অনুষ্ঠান উপভোগের পাশাপাশি স্থানীয়দের জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান