পূর্ব জার্মানি যেভাবে 'অভঙ্গুর' কাচের গ্লাস তৈরি করেছিল
পানীয়ের গ্লাসটির নীচের অংশে সরু কিন্তু উপরের দিকে প্রসারিত। আকারের এই ভিন্নতার ফলে গ্লাসটিকে সহজেই হাত দিয়ে শক্তভাবে ধরা যায়। বলছিলাম 'সুপারফেস্ট' নামের গ্লাসের কথা; যা শিল্প-সমৃদ্ধ কিন্তু সম্পদে কিছুটা দারিদ্র সমাজতান্ত্রিক জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে উদ্ভাবিত হয়েছিল। সুপারফেস্ট গ্লাসগুলো সাধারণ পানীয়ের গ্লাসের তুলনায় পাঁচগুণ দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে ডিজাইন করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি এক পর্যায়ে ১০ গুণ বেশি টেকসই হয়েছিল।
পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পতনের পর গ্লাসটির তৈরিকৃত কোম্পানিটিও দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ডিজাইনাররা আরও বেশি পরিবেশ-বান্ধব ও টেকসই উৎপাদন পদ্ধতির গ্লাসের খোঁজ করছেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে উত্পাদিত সুপারফেস্ট গ্লাসগুলোর চাহিদা তাই আগের চেয়ে বেশি। প্রায় ৩৫ ইউরোতে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে এগুলো বিক্রি হচ্ছে। কিছু ডিজাইনার এখন আগের এই প্রযুক্তিকে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনতে চান।
হোমওয়্যার ডিজাইনের ক্ষেত্রে পানীয়ের গ্লাসগুলিকে অনেকটা উপেক্ষিত করা হয়। কেননা যখন এগুলো শিল্পগুণসমৃদ্ধ হয়, তখন সেটি বিবেচনায় মূল্য নির্ধারণ করা হয়। যেমন, একটি ভিন্নধর্মী ওয়াইন গ্লাস নিলামে ভালো অর্থ আনবে; কিন্তু সাধারণ পানির গ্লাসের ক্ষেত্রে সেটি হবে না।
সুপারফেস্ট গ্লাসের ক্ষেত্রে নির্মাতাদের পরিচয় অজ্ঞাতনামা রাখার পেছনেও রাজনৈতিক কারণ ছিল। কেননা তৎকালীন শাসনব্যবস্থা কিছু তৈরির ক্ষেত্রে সংহতি ও ঐক্যের বাণী প্রচার করেছিল। সেই মতাদর্শে ব্যক্তির প্রতিভা ও যোগ্যতার চেয়ে সমষ্টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হতো।
সোভিয়েত সময়কালে প্রতিটি বার, ক্যান্টিন ও গৃহস্থালিতে সুপারফেস্ট গ্লাসের ব্যবহার ছিল। তবে খুব কম লোকই পল বিটনার, ফ্রিটজ কেউচেল কিংবা টিলো পোয়েৎজের নাম শুনেছিল, যারা কি-না গ্লাসটি তৈরির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।
যুগান্তকারী প্রযুক্তিটি ১৯৭০-এর দশকে ড্রেসডেনের কাছে অজৈব রসায়নের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউটের গ্লাস স্ট্রাকচার রিসার্চ বিভাগে তৈরি হয়েছিল। সেখানকার ম্যাটেরিয়াল বিজ্ঞানীরা জানতেন যে, কাচ ভেঙে যাওয়ার পেছনে সাধারণত উপাদানটির পৃষ্ঠের মাইক্রোস্কোপিক ফাটল দায়ী; যা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময় তৈরি হয়। এক্ষেত্রে তারা কাচের পৃষ্ঠের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে। তারা গ্লাসে থাকা ছোট সোডিয়াম আয়নগুলিকে বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত পটাসিয়াম আয়ন দিয়ে প্রতিস্থাপন করে। পটাসিয়াম আয়নগুলির আরও বেশি স্থান দখল করে, পাশে থাকা পরমাণুতে জোরে চাপ দেয় এবং এতে করে মাইক্রোস্কোপিক ফাটল প্রশমিত হয়।
ঐ সময়ের শাসনামলের শিল্প নকশা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক হোহেন বলেছেন, "এমন একটি গ্লাস তৈরি করার জন্য প্রচুর পরিমাণে প্রযুক্তিগত কাজ করতে হয়েছিল।" তা সত্ত্বেও এটি পূর্ব জার্মানি পতনের এক বছর পর ১৯৯০ সালে বিশেষায়িত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
মূলত দুই জার্মানি এক হয়ে যাওয়ার পর ডিজাইনের কারণে সুপারফেস্ট গ্লাসের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মদ্যপানকারীরা নানা নকশার সজ্জিত গ্লাসেই বিয়ার পান করতে পছন্দ করতেন।
হোহনে বলেছেন, "সুপারফেস্ট গ্লাস সেখানকার সাথে যায় না। এটির নকশা ঐসব স্থানের জন্য মানানসই নয়।"
কিন্তু গ্লাসটির জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বিরোধিতা। এটির ভঙ্গুরতা অনেক কম হওয়ায় নতুন করে গ্লাস কেনার প্রবণতা কমে যেতে থাকে। যাতে করে দোকানিদের বিক্রি ও মুনাফা কমে যায়।
আজ অত্যন্ত টেকসই এই গ্লাস শুধুমাত্র সেকেন্ডহ্যান্ড কেনা যায়। কিন্তু বার্লিনের একটি স্টার্টআপ এগুলো নতুন করে তৈরির করার চেষ্টা করছে। যেহেতু টেকসই জিনিসপত্রের চাহিদা বেড়েছে, কোম্পানি সোলবোটলস মনে করে যে, গ্রাহকরা চড়া দামে টেকসই পণ্য কিনতে প্রস্তুত।
কোম্পানি প্রতিষ্ঠাতা পল কুফার ও জর্জ টার্ন উদ্যোগটি বাস্তবায়নে ২৫২,১৩৯ ইউরো ক্রাউডফান্ডিং যোগাড় করেছেন। যা সুপারফেস্টের আয়ন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আংশিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সোলবোটলসের ক্রাউডফান্ডিং প্রচারাভিযানের সাথে যুক্ত স্টিভ কোহলার বলেন, "প্লাস্টিকের তুলনায় কাচ এমন একটি উপাদান যা প্রায় যতবার খুশি পুনর্ব্যবহৃত করা যেতে পারে। এটি স্বচ্ছ কিন্তু এর অসুবিধা হচ্ছে এটি ভেঙে যায়।"
তবে প্রকৃত সুপারফেস্ট গ্লাসের সমস্যা হল এটির নির্মাতারা পরিবর্তিত অ্যালুমিনো বা বোরোসিলিকেট গ্লাস দিয়ে কাজ করেছেন। যা সোডা-লাইম গ্লাসের মতো রিসাইকেল করা সহজ নয়। সুতরাং সোলবোটলসের কাছে চ্যালেঞ্জ হল এমন কাঁচ তৈরি করা যা টেকসই ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য উভয়ই হয়।