‘লেভ প্যালেস্টিনা’: ১৯৭০ এর দশকের যে গান যুদ্ধবিরোধী সংগীত হয়ে উঠেছে
অবসর নেওয়ার পরও জর্জ তোতারির বাড়িটি মানুষ ও মানুষের কলরবে মুখরিত। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মেয়ে আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে বসে আছেন তিনি। আর দশটা সুইডিশ অ্যাপার্টমেন্টের মতোই এই ঘরটিরও দেয়ালগুলো হালকা ধূসর। এমন কোনো চিহ্ন ঘরটিতে নেই, যা দেখে বোঝা যায় এটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন সংগীতশিল্পীর বাড়ি।
লম্বা-ধূসর চুল, চওড়া রিমলাগানো চশমা এবং জ্বলজ্বলে চোখের জর্জ তোতারি ১৯৪৬ সালে নাজারেথে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত সুইডিশ-ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টান।
তোতারি স্মৃতিচারণ করেন, তিনি যখন শিশু ছিলেন তখন তার শহরে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি এবং চেকপয়েন্ট তৈরি শুরু হয়। ১৯৬০ এর দশকের মধ্যে নাজারেথ প্রচুর ফিলিস্তিনি স্বাধিকার আন্দোলনকারীসহ বিপুল পরিমাণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। স্থানটিতে ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগত সহাবস্থান ছিল।
এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে উত্তর ইউরোপে প্রথম একটি প্রতিবাদী গান প্রকাশ করেন তোতারি। কয়েক দশক পরে গাজায় ইসরায়েলের চলামান যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে পুরোনো এই গানটি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরাইলের নৃশংস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, ফিলিস্তিন নিয়ে ১৯৭৯ সালে তোতারির গান 'লেভ প্যালেস্টিনা' নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। এবারের যুদ্ধে ৩৯ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, এর বাইরেও হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে হারিয়ে গেছে এবং এখন পর্যন্ত আনুমানিক ৯০ হাজার মানুষ আহত হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে এক ধূসর, বৃষ্টিস্নাত দিনে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভকারীরা স্টকহোমে ১৯৭০-এর দশকের তোতারির গান গেয়ে গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলা বন্ধের আহ্বান জানান।
এরপর কেউ একজন এই বিক্ষোভের একটি ভিডিওর সঙ্গে লেভ প্যালেস্টিনা গানটি দিয়ে টিকটকে আপলোড করেন। মুহূর্তে এটি ভাইরাল হয়ে যায় এবং গত অক্টোবর থেকে পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি ভিউ পেয়েছে ভিডিওটি। ভিডিওটির কমেন্ট সেকশনে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং তুরস্কের নাগরিকদের কমেন্টের বন্যা বয়ে গেছে। তারা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সুইডেনের মানুষদের গাওয়া এই গানটির প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। সেই থেকে 'লেভ প্যালেস্টিনা' সুইডেনের পথে পথে শোনা যায় এবংক্রমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বিভিন্ন ভিডিওতে এটি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সংগীতে পরিণত হয়েছে।
গত এপ্রিলে সুইডেনের স্টকহোম মেট্রোতে ফিলিস্তিনপন্থী কর্মীরা লেভ প্যালেস্টিনা গানটি গেয়েছিলেন। সেই প্রতিবাদের একটি ভিডিওতে কেফিয়াহ-পরিহিত সুইডিশভর্তি একাধিক গাড়ি দেখা যায়। এরপর থেকে তোতারির গানটি বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হয়ে যায়।
বিশ্বকে জানান দেওয়া
১৯৭২ সালে এর সূত্রপাত। সেসময় 'কোফিয়া' নামে একটি কাউন্টারকালচার ব্যান্ডের উত্থান হয়। এতে মাত্র পাঁচজন মূল শিল্পী ছিলেন- তোতারি (ব্যান্ডের গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী এবং উড নামের এক ধরনের বাদ্যযন্ত্রী), ফিলিস্তিনি পার্কিউশনিস্ট মিশেল ক্রেইট ( যার পরিবার ১৯৪৮ সালে জেরুজালেম থেকে পালিয়ে আসে) এবং বাকি তিনজন সুইডিশ নাগরিক। এরা হলেন- ক্যারিনা ওলসন (গায়ক), বেংট কার্লসন (বাঁশি বাজাতেন) এবং ম্যাটস লুদালভ (গিটার, ম্যান্ডোলিন ও ওউড বাজাতেন)। এছাড়া ফিলিস্তিনি ড্রামার এবং গায়কদলের একটি অস্থায়ী দল তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ওলসন। তিনি মঞ্চে কোফিয়াদের একটি পারফরমেন্স দেখার পর এই ব্যান্ডে যোগ দেন।
এই ব্যান্ডের নামের সাথে সাদৃশ্য রেখে 'কেফিয়াহ' নামের একধরনের স্কার্ফ পড়েন ফিলিস্তিনিরা। বুনন কৌশল এবং এতে থাকা প্রতিরোধের প্রতীকসমূহের জন্য এই স্কার্ফ দেশটিতে বহুল সমাদৃত।
১৯৭০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে সংগীত পরিবেশন করেন 'কোফিয়া' ব্যান্ড। সেই সময়ে সুইডেনের গোথেনবার্গ (ঐতিহ্যগতভাবে একটি শ্রমিক-শ্রেণীর শহর) ছিল আন্তর্জাতিক সংহতি আন্দোলনকে সমর্থনকারীদের কেন্দ্র। এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ হয়। ব্যান্ডটি বিশেষত ১৯৭০-এর দশকে সুইডেনে বামঘেঁষা, বিকল্প সংগীতপ্রেমী অতিউৎসাহী সমাজতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তবে বিদেশেই 'কোফিয়া'-র কনসার্ট সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছিল।
শাহের পতনের এক বছর পর ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তোতারি ইরানের সংগ্রামকে উৎসর্গ করে একটি গান লিখেছিলেন।
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এর সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে ইরানি বিপ্লবীরা ফিলিস্তিনের একটি গানের দল দিয়ে তেহরানে একটি অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিল। এসময় স্টকহোমভিত্তিক চিলির একটি গ্রুপের সঙ্গে 'কোফিয়া' সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী গান গায়। তারা অস্থায়ী উন্মুক্ত স্টেজে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে সেই আলোতে একটি কনসার্ট করেন।
নির্বাসিত ফিলিস্তিনি সংগীতশিল্পীদের নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ এবং 'কোফিয়া'-র উপর একটি সংক্ষিপ্ত ডকুমেন্টারির পরিচালক লুই ব্রেহোনি বলেন, 'তাদের গানের কথাগুলো ছিল অসাধারণ। আরবি লোক সংগীতের সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অ্যাকোস্টিকার সংমিশ্রণ ঘটেছিল তাদের গানে।'
তিনি আরও বলেন, পরিবর্তনের জোয়ার ওঠা সেই যুগে ইরান ও পূর্ব জার্মানির বিপ্লবী সঙ্গীতের সমন্বয়ে কোফিয়া'রা এক ধরনের 'আপোষহীনতার বার্তা এবং বাদ্যযন্ত্রের স্পন্দন' ছড়িয়ে দিয়েছিল।
তোতারি নিজে ১৯৬৭ সালে ২০ বছর বয়সে ইসরায়েলের ছয় দিনের যুদ্ধ থেকে পালিয়ে নাজারেথ ছেড়েছিলেন। ইসরায়েল এই যুদ্ধেই পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, গোলান মালভূমি, মিশরের সিনাই উপদ্বীপ এবং গাজা উপত্যকা (যা আগে মিশরের নিয়ন্ত্রণে ছিল) দখল করেছিল। সুইডেনে তিনি এমন একটি বিশ্বের সন্ধান পেয়েছিলেন, যারা তখনও ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
তোতারি হতাশা নিয়ে স্মরণ করেন, '১৯৬৭ সালে যখন আমি এখানে আসি, তখন মানুষ ফিলিস্তিন সম্পর্কে কিছুই জানত না। তারা বলত এটি একটি মরুভূমি এবং সেখানে কোনো ফিলিস্তিনি নেই।'
এই বিষয়টিই সংগীতের মাধ্যমে স্থানীয়দের সচেতন করার মিশনে তাকে জড়ানোর প্রেরণা ছিল। তিনি সবাইকে জানাতে চেয়েছিলেন ফিলিস্তিনিদের 'অস্তিত্ব' রয়েছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে 'কোফিয়া'-রা সুইডিশ ভাষায় চারটি গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেন। সুইডিশ ভাষায় ফিলিস্তিন নিয়ে গান গাওয়া প্রথম ব্যান্ড 'কোফিয়া'। তারা প্রথাগত আরবি গান এবং শিল্পের নিয়ম ভেঙে ফেলে। সেসময়কার প্রথাগত গানগুলো শুধু ফিলিস্তিনি এবং বৃহত্তর আরব অঞ্চলের জনসাধারণের উদ্দেশে গাওয়া হতো এবং ভাষাগত কারণে শুধু তারাই এসব গানের শ্রোতা ছিলেন।
১৯৭৯ সালে প্রকাশিত 'লেভ প্যালেস্টিনা' ডেমোনস্ট্রেশনসানজেন (বা সুইডিশ ভাষায় 'বিক্ষোভের গান') নামে পরিচিত। তাদের দ্বিতীয় অ্যালবামের শেষ গান 'আর্থ অব মাই হোমল্যান্ড'- শিরোনামের গানটি তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়। সুইডেন সেসময় মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে সমর্থন করতো। তবে এই বিতর্ক কেবল সুইডেনেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
তোতারি বলেন, 'কিছু আরবও সুইডিশ ভাষায় আমার গান গাওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি।'
দীর্ঘ ৪৫ বছর পর 'লেভ প্যালেস্টাইন' তার প্রকৃত মর্যাদা পেয়েছে।
ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী জ্যান লিন্ডস্ট্রম বলেন, 'এ যুগের বেশিরভাগ পপ সংগীত একই ধরনের এবং প্রায় অরাজনৈতিক। এমন একটি সময়ে লেভ প্যালেস্টিনা একটি অনুপ্রেরণার উত্স।'
তিনি জানান, গত মে মাসে পুলিশ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ভঙ্গ করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য অনেক শিক্ষার্থীর মতো তিনিও সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থী শিবিরে অংশ নিয়েছিলেন।
লিন্ডস্ট্রোম বলেন, 'আমরা আমাদের তাঁবুতে বসে প্রতিবাদ জানাতাম। গানটি আমাদের নিজের ভাষায় হওয়ায় এর প্রতি আমাদের অনুভূতি দৃঢ়, ভাষাগত কারণে অনেক সুইডিশকে একত্র করেছে গানটি।'
জুনে শিবিরটি বন্ধ হওয়ার এক মাস পরে লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বিক্ষোভে নামে। রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মের সেই দিনটিতে সংহতি ব্যানার হাতে 'কেফিয়েহ' পরে আন্দোলনকারীরা 'লেভ প্যালেস্টাইন' গাইতে গাইতে ধীর, অবিচলিত ভঙ্গিতে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায়।
লিন্ডস্ট্রম আরও বলেন, 'এমনকি অ-সুইডিশরাও বুঝতে পারে যে এটি ইউরোপে তৈরি একটি গান এবং গানটি বিশ্বব্যাপী চলা অবিচারের প্রতিবাদ।'
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকবার এই গানটিকে অ্যান্টি সেমেটিক (ইহুদিবিদ্বেষী) বলে অভিযোগ তুলেছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে সুইডিশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে জোটবদ্ধ একটি রাজনৈতিক যুব দল মালমোতে মে দিবসের মিছিলের সময় 'লেভ প্যালেস্টাইন' গেয়েছিল।
সুইডেনের অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী মারিয়া স্টেনারগার্ড গত নভেম্বরে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ক্রিস্টিয়ানস্টাডে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ এনে একটি বিক্ষোভের ক্লিপ এক্স-এ (পূর্বে টুইটার) পোস্ট করেছেন।
সুইডেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টেফান লোফভেনও পার্লামেন্টে বলেছিলেন, এই গানটি ইসরায়েলি রাষ্ট্রের বিরোধিতার একটি 'অগ্রহণযোগ্য অভিব্যক্তি'।
এই অভিযোগ শুনে তোতারি বিস্মিত হন।
তিনি বলেন, 'আমি অ্যান্টি সেমেটিক হতে পারি না ... কারণ আমি নিজেই সেমেটিক।'
তোতারি বলেন, 'আরবরা নিজেরাই সেমিটিক জাতি। এছাড়া আমি মুসলিম বা খ্রিস্টানদেরও বিরুদ্ধাচারণ করতে পারি না, কারণ উভয়ই আমার গোত্রেরই। তাই অ্যান্টি সেমেটিক হওয়া মানে আমার নিজের সত্তার বিরুদ্ধে যাওয়া।'
ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক
১৯৭০-এর দশকে প্রগতিশীল সুইডিশদের একটি অংশ 'কোফিয়া'কে সোচ্চারভাবে সমর্থন করেছিল। অনেক ইহুদিও এই গোষ্ঠীর সমর্থক ছিলেন।
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা তোতারির চোখে এখনও দ্রোহ রয়েছে। তিনি সংগীতের শক্তিকে প্রতিরোধের একটি হাতিয়ার হিসেবে মনে করেন।
ইউরোপের প্রতিবাদী সংগীতে 'কোফিয়া'-র প্রভাব নিয়ে তৈরি ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি সিনেমার শুরুতে লেখক ব্রেহনি লিখেছিলেন, 'লেভ প্যালেস্টাইন' গানটি বিক্ষোভের উদ্দীপনা সৃষ্টির পাশাপাশি 'কোফিয়া'র পুনরাবৃত্তিমূলক সুরগুলো 'তুরাথির মাকাম ঐতিহ্যের (ফিলিস্তিনি গানের ঐতিহ্য) ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। '
তিনি বলেন, কেউ কেউ প্রশ্ন করেন যে সিনেমায় এই 'গানটি দিয়ে আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? জবাবে আমি বলি প্রত্যেক মানুষের কাছে গানটির অর্থ ভিন্ন। আমি কী মনে করি গানটি শুধু তাই প্রকাশ করে না, এর অর্থ প্রতিটি মানুষ তার নিজের মতো করে অনুভব করবে। তারা তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়ে গানের কথার অর্থ করবে। কারো কাছে এটি ভালোবাসার গান, আবার কারো কাছে এটি একটি সংগ্রাম।'
তোতারি জানান, তার কাছে এটি মানুষের কথা। তিনি একটি খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, ফিলিস্তিনে তিনি মুসলিম ও ইহুদিদের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়েছেন। এরপর আসে সেই সময় যখন তিনি নিজ দেশে পরাধীন হয়ে থেকেছেন এবং দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরপর সুইডেনে এসে তিনি আবার সেই সহাবস্থান দেখতে পান।
৫০ বছর আগে অনেক সুইডিশ তাকে যে উদারতা দেখিয়েছিলেন তা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'এখানকার মানুষদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই।'
তিনি এখন ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিশ্বজুড়ে মানুষের বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠা এবং ইউরোপজুড়ে মানুষের অবস্থান পরিবর্তনের এই জোয়ারে হারানো আশা খুঁজে পান। গত মে মাসে স্পেন ও নরওয়ের পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডও রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ফিলিস্তিনকে। তিনটি ইউরোপীয় দেশ এখন ১৯৬৭-এর পূর্ববর্তী সীমানা মেনে নেওয়ার জন্য অন্যান্য দেশগুলোর প্রতি চাপ দিচ্ছে এবং বলছে এই স্বীকৃতিই শান্তি নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়৷
সুইডেন ২০১৪ সাল থেকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ২০১৫ সাল থেকে স্টকহোমে ফিলিস্তিনি দূতাবাস স্থাপন করেছে। তবে সুইডেনের বর্তমান ডানপন্থি সরকার ইসরাইলকে কট্টর সমর্থন দিয়ে আসছে।
'যতদিন ঘৃণা থাকবে, ততদিন কোনো আশা নেই'
তোতারি আশাবাদী, তবে তিনি আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন না।
তিনি জানান, কয়েক দশক ধরে তিনি অনেক প্রতিবাদ আন্দোলন আসতে এবং যেতে দেখেছেন। তাই তিনি আশঙ্কা করছেন, বর্তমান বৈশ্বিক বিক্ষোভের গতি ও শক্তিও হ্রাস পেতে শুরু করবে।
তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, 'স্বতঃস্ফূর্ত কাজগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না।'
তাই তিনি বিক্ষোভকারীদের 'রাজপথের শক্তিকে' কাজে লাগিয়ে নাগরিক সমাজ, সরকার এবং শিল্প-সাহিত্যসহ ফিলিস্তিনের প্রতিটি খাতকে পুনর্নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, শুধু এই একটি কাজ ফিলিস্তিনিদের পুনর্জীবনের আশা জিইয়ে রাখতে পারে।
তোতারির লেখা শত শত গান এখনও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।
তিনি বলেছেন, তিনি সৃজনশীল সমাজ চান, যে সমাজ বাদ্যযন্ত্রের প্রতিরোধকে সমর্থন এবং উৎসাহিত করে।
তিনি এমন একটি দিনের জন্য অপেক্ষা করেন যখন পৃথিবী থেকে সমস্ত ঘৃণা দূর হয়ে যাবে।
তোতারি বলেন, 'যতদিন ঘৃণা থাকবে ততদিন কোনো আশা নেই। আমাদের ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা; পরমাণু বোমা নয়। ঘৃণাই সবচেয়ে বড় শত্রু।'
তিনি বলেন, 'হয়ত আমি মারা যাওয়ার পর আজকের তরুণরা দেখতে পারবে আমি কী করেছি এবং তা থেকে কিছু কিছু তারা হয়ত গ্রহণও করবে। সবচেয়ে বড় কথা মানুষ মারা যাওয়ার পরে আরও বিখ্যাত হয়।'
আপাতত লাইমলাইট থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন তোতারি। তিনি তার গোথেনবার্গের বাড়িতে বসে বলেন, 'আমার গান যখন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তখন নিজেকে ছোট মনে হয়। আমি যদি নিজেকে বিখ্যাত মনে করি তবে আমি গান গাইতে পারি না।'
তোতারির ইনবক্স সারা বিশ্বের তরুণদের পাঠানো বার্তায় পূর্ণ। ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসার অনেক আগে গঠিত এই ব্যান্ডটির সাথে তারা 'যুক্ত হতে চায়'।
তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে চায় এমন মানুষদের একত্র করার জন্যই গানগুলো তৈরি করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয় 'লেভ প্যালেস্টাইন' সব নিপীড়িত মানুষের কথা; তারা অমুসলিম বা ফিলিস্তিনের বাইরের মানুষ কি না তা কোনো ব্যাপার না। এটা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য। এই উপলব্ধিটি আমাকে খুব আনন্দ দেয়।'