চ্যালেঞ্জিং এই বিমানবন্দরে মাত্র ৫০ জন পাইলটের অবতরণের দক্ষতা আছে!
এয়ারবাস ৩১৯ মডেলের বিমানের ককপিটে বসে আছে এক বুদ্ধমূর্তি। সেখানে বসেই সে দেখছে, বিমানটির কীভাবে নাটকীয় বাঁক নিয়ে ভুটানের পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করছে। এ অবতরণের সময় বিমানের যাত্রীরা সিটের হাতল চেপে ধরে বসে থাকেন এবং বিমানটি মাটি স্পর্শ করলে যেন তারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। অনেকে আনন্দে হাততালিতেও ফেটে পড়েন। এটি পারো বিমানবন্দরে অবতরণ করা প্রতিটি বিমানের প্রতিদিনের চিত্র।
প্রতিদিন এ চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিমান অবতরণ করান পাইলট। এ বিমানবন্দরে অবতরণের দক্ষতা আছে এমন পাইলটের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৫০ জন। ভুটানের পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি প্রযুক্তিগত ও ভৌগোলিকগতভাবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং একটি বিমানবন্দর।
এ বিমানবন্দরটিকে ঘিরে রেখেছে ১৮ হাজার ফুট উচ্চতার দুটি পাহাড়। পাইলটরা এ ১৮ হাজার ফুট উচ্চতার দুটি পাহাড় ডিঙিয়েই ছোট্ট রানওয়েতে বিমান অবতরণ করান। এসময় পাইলটকে থাকতে হয় সবচেয়ে সচেতন, দক্ষ ও মানসিকভাবে শক্ত।
ভুটানের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা দ্রুক এয়ারের (রয়্যাল ভুটান এয়ারলাইন্স) ক্যাপ্টেন চিমি দর্জি এদের মধ্যে একজন। তিনি ২৫ বছর ধরে এ কাজ করে আসছেন। বিমানবন্দরের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি বলেন, "এটি চ্যালেঞ্জিং, তবে বিপজ্জনক নয়। এটি পাইলটদের দক্ষতার জন্য চ্যালেঞ্জিং। কারণ বিপজ্জনক হলে আমি বিমান চালাতাম না।"
পারো একটি 'সি' ক্যাটাগরির বিমানবন্দর। এর অর্থ হলো, এখানে বিমান উড়ানোর জন্য পাইলটদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এ বিমানবন্দরে পাইলটকে নিজ হাতে ম্যানুয়ালি বিমানকে অবতরণ করাতে হয়। কারণ এখানে রাডারের সাহায্য নেওয়া সম্ভব নয়। চিমি দর্জির মতে, বিমানবন্দরের চারপাশের ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে পাইলটের ভালো জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কারণ সামান্য ভুল করলেই কারও বাড়ির উপর বিমান আছড়ে পড়তে পারে।
ভুটান চীন ও ভারতের মাঝে অবস্থিত একটি ল্যান্ডলক দেশ। এর ৯৭ শতাংশ ভূমিই পর্বত দ্বারা আচ্ছাদিত। এর রাজধানী থিম্পু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,৭১০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পারোর অবস্থান সামান্য নিচে, ৭,৩৮২ ফুট উচ্চতায়।
দর্জি বলেন, "উচ্চতার কারণে এখানে বাতাস হালকা। তাই এখানে বিমানে গতি বেশি থাকে।" তিনি বলেন, "এখানে আপনার আসল গতিবেগ একই থাকবে কিন্তু মাটির বিপরীতে আপনার গতিবেগ অনেক বেশি হবে।"
ভৌগোলিক বিষয়ের পর আসে আবহাওয়া
পারোতে অবতরণের জন্য সবাইকেই খুব সকালে জেগে উঠতে হয়। কারণ বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা নিরাপত্তার জন্য দুপুরের আগেই বিমান অবতরণ করা পছন্দ করেন। কারণ দুপুরের পর বাতাসের চাপ বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে দর্জি বলেন, "আমরা দুপুরের পর বিমান চলাচল এড়াতে চেষ্টা করি। কারণ দুপুরের পর তাপের কারণে বাতাস অনেক বেশি হয়। আর তাপ বেশি হওয়ার কারণে মাটি শুষ্ক থাকে এবং উপত্যকায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী বায়ুর স্রোত তৈরি হয়। তাই সকালে বাতাস অনেক শান্ত থাকে।"
যদিও বিমান উড্ডয়নের জন্য এটি তেমন কোনো বড় সমস্যা না। তাই ভ্রমণকারীরা ভুটানে তাদের শেষ রাতে চমৎকার ঘুম দিয়ে পরদিন বিকালের ফ্লাইটে চলে যেতে পারেন। তবে পারোতে কোনো রাডার না থাকায় রাতে কোনো ফ্লাইটকে উঠতে বা নামতে দেওয়া হয়না।
আবার বর্ষাকালে বিশেষ করে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত, ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিতে হয়। কারণ এসময় বজ্রসহ ঝড় কিংবা গলফের বলের আকৃতির শিলাবৃষ্টির হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পাইলটদের কখন বিমান উড়ানো উচিত সে সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে বলে জানান চিমি দর্জি।
পারোর চ্যালেঞ্জিং অবতরণের শেষ কারণটি হলো 'পাহাড়'।
পারোর রানওয়ের দৈর্ঘ্য মাত্র ৭,৪৩১ ফুট এবং এর অবস্থান দুটি উঁচু পর্বতের মাঝে। ফলে পাইলটরা রানওয়েটি দেখতে পান কেবল অবতরণের ঠিক আগে।
ভুটানের বিমান চলাচল শিল্প
ভুটানের দক্ষিণে ভারতীয় সীমান্তের কাছের গেলেফু নতুন একটি "মাইন্ডফুলনেস সিটি" তৈরির জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
যদিও গেলেফুতে ইতিমধ্যে একটি ছোট বিমানবন্দর রয়েছে। তবে নতুন সংযোজন এর ওপরও প্রভাব ফেলবে। গেলেফু এবং পারোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো ভূ-প্রকৃতি। গেলেফু অনেক সমতল এবং এখানে বড় রানওয়ে তৈরি করার জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। তাই এখানে বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়া পাইলটরা সহজে অবতরণ করানোসহ বড় বিমানও এখানে অবতরণ করতে পারবে।
হয়ত কয়েক বছরের মধ্যে এখানে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকেও এখানে বিমান অবতরণ করতে পারবে।
এখানে বিমান চলাচল শিল্প এখনও তুলনামূলকভাবে নতুন। দ্রুক এয়ার ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপরে ১৯১৯ সালে কেএলএম, ১৯২০ সালে কান্তাস ও ১৯২৮ সালে। ডেল্টা এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ বিষয়ে চিমি দর্জি বলেন, "আমি নিজেকে নতুন ও পুরাতন প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী মনে করি।" তার মতে ভুটানে ৫০ জন লাইসেন্সপ্রাপ্ত পাইলট রয়েছে। তিনি আশা করেন, নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ সংখ্যা কয়েক বছরেই দ্বিগুণ হবে।