মেয়াদ শেষ হওয়ার মুহূর্তে এসে ইসরায়েলকে ‘খাবার আর লাঠি’ দুটোই দেখাচ্ছেন বাইডেন
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের শেষ মাসগুলোতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি সামরিক সহায়তা নতুনভাবে ব্যবহার করার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ইরান ও ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের লড়াইকে প্রভাবিত করতে এ সহায়তাকে তিনি একইসঙ্গে ইসরায়েলের জন্য 'চাপ ও পুরস্কার' হিসেবে ব্যবহার করতে চান।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এ কৌশল ইসরায়েলি সিদ্ধান্ত গ্রহণে ওয়াশিংটনের ভূমিকা বাড়ালেও আঞ্চলিক সংঘাত প্রতিরোধ ও গাজায় ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট মোকাবিলার মতো বাইডেনের বৃহত্তর লক্ষ্যগুলো পূরণে এটি কতটা সহায়ক হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
বাইডেন প্রশাসন রোববার ঘোষণা দিয়েছে, এটি ইসরায়েলে প্রায় ১০০ জন সৈন্য পাঠাবে, যাদের সঙ্গে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী ব্যবস্থাও থাকবে। এ ধরনের মোতায়েন খুবই বিরল। এটি এমন সময়ে ঘটছে যখন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ১ অক্টোবর তেহরানের মিসাইল হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইরানে আক্রমণের চিন্তা করছে।
একই সময়ে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে একটি চিঠি দিয়ে গাজার মানবিক পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটালে আগামী মাসে ইসরায়েলে মার্কিন সামরিক সহায়তায় কমিয়ে আনার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
প্রকাশ্যে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, আপাত-বৈপরীত্যের এ পদক্ষেপগুলো দীর্ঘদিনের মার্কিন নীতির অংশ, যার লক্ষ্য ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা এবং গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদান।
তবে, বর্তমান এবং প্রাক্তন কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেছেন যে, বাইডেন প্রশাসন বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতিকালেও এ পদক্ষেপগুলো ইসরায়েলের কৌশলে ওয়াশিংটনের অংশগ্রহণ বাড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইসরায়েল প্রায়শই মার্কিন পরামর্শকে উপেক্ষা করে বাইডেন প্রশাসনের জন্য রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করেছে।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, বাইডেন প্রশাসনের এ 'চাপ ও পুরস্কার' পদ্ধতি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, 'তারা [মার্কিন প্রশাসন] এখনও সক্রিয়ভাবে চিন্তা ও কাজ করছে।'
তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বেড়ে গেলে ইসরায়েলের জন্য মার্কিন সামরিক সহায়তা সীমিত করার সম্ভাবনা কম।
'ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ামূলক হামলার ফলে ইরান আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে এমন আশঙ্কা যখন খুব বেশি প্রবল, তখন প্রশাসন ইসরায়েলকে দেওয়া সামরিক সহায়তায় কোনো বড় ধরনের লাগাম টানবে — ব্যাপারটা আমার কাছে একদমই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না,' তিনি বলেন।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কার্বি সাংবাদিকদের বলেন, চিঠিটি 'হুমকি হিসেবে দেওয়া হয়নি', তবে ইসরায়েল বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
ওয়াশিংটনের এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা চিঠিটি পেয়েছি এবং আমাদের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এটি বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করছেন।'
বুধবার ইসরায়েল জানিয়েছে, জর্ডান থেকে উত্তর গাজায় ৫০টি সাহায্যবাহী ট্রাক পাঠানো হয়েছে। এটি মার্কিন চাহিদার সম্ভাব্য প্রাথমিক ফলাফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ত্রাণ সহায়তা বাড়ানোর সময়সীমা
ইসরায়েলের পরিসংখ্যান অনুসারে, হামাসের আক্রমণে প্রায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। এর পর থেকেই বাইডেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ৪২ হাজার জন নিহত হয়েছেন।
ডেমোক্র্যাটদের কড়া সমালোচনা সত্ত্বেও জো বাইডেন ২০০০-পাউন্ড বোমা ছাড়া ইসরায়েলে অন্য কোনো অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এপ্রিলে মার্কিন প্রশাসন গাজায় বেসামরিক লোক ও সাহায্যকর্মীদের সুরক্ষা বাড়ানোর দাবি জানায়। মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, এর ফলে সে সময় ওই অঞ্চলে ত্রাণ সহায়তা কিছুটা বেড়েছিল।
কিন্তু রোববারের চিঠিটি ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকারের কাছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে স্পষ্ট আল্টিমেটাম হিসেবে ধরা হচ্ছে। চিঠিতে ইসরায়েলকে ৩০ দিনের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা বাড়াতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩৫০টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ নিশ্চিত করার শর্ত রয়েছে।
চিঠিতে ইসরায়েলকে মার্কিন অস্ত্র সহায়তা কমানোর সম্ভাবনার দিকটি ইঙ্গিত করে সেন্টার ফর সিভিলিয়ান ইন কনফ্লিক্টের অ্যাডভোকেসি ও আইনি উপদেষ্টা জন রামিং চ্যাপেল বলেন, 'এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের দিকে ছোট্ট পদক্ষেপ।'
গাজায় মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করার জন্য নেতানিয়াহু বুধবার একটি জরুরি বৈঠক ডাকেন। আলোচনায় অংশ নেওয়া তিনজন কর্মকর্তার মতে, শীঘ্রই ত্রাণ সহায়তা বৃদ্ধি পেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলে টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স সিস্টেম (থাড) পাঠানোর সিদ্ধান্তকেও বিশ্লেষকেরা একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। এটি ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
একজন সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনকে 'প্যারাডাইম শিফট' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
'যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে নিজস্ব বাহিনী মোতায়েন করে 'যুদ্ধে যুক্ত হয়ে গেল'। এ ইসরায়েল মাত্র দুসপ্তাহ আগে ইরানের ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয়েছে,' বলেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যে এখন সবাই অপেক্ষা করছে ইরানের হামলার ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়া দেখার। বাইডেন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য কোনো হামলার বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন এবং জ্বালানি স্থাপনায় আঘাত হানার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ সেন্টারের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্পের পরিচালক টমাস কারাকো বলেন, 'এটি সম্ভবত ইসরায়েলকে সীমাবদ্ধ রাখার একটি কৌশল, যাতে তারা বড় আকারের হামলা থেকে বিরত থাকে।'
তিনি আরও বলেন, 'জানেন তো, মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের সম্পদ পাঠানোর সময় কিছু শর্ত জুড়েই দিতে হয়।'
থাড মোতায়েনের বিনিময়ে ইসরায়েল ইরানের তেল বা পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার কোনো চুক্তিতে রাজি হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেয়নি হোয়াইট হাউস।
মার্কিন প্রশাসনের হাতে সময় ক্রমশ কমে আসছে।
বাইডেনের ইসরায়েলকে দেওয়া ৩০ দিন আগামী ৫ নভেম্বরের মার্কিন নির্বাচনের পর শেষ হবে। ফলে নেতানিয়াহু এ শর্তের কতটুকু মানবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাবেন। বিশেষ করে যদি নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ মিত্র ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমান ডেমোক্র্যাট ভাইস প্রেসিডেন্ট, ও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করেন।
'নেতানিয়াহু মনে করেন তিনি এখন একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন, এবং তার ধারণা সঠিকও হতে পারেন। আগামী কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে এমন একজন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসতে পারেন যিনি নেতানিয়াহুর পছন্দের মানুষ,' বলেন ডেভিড মিলার।