হাসিমুখে পাসপোর্টের ছবি তুলতে পারেন না কেন
দেশ-বিদেশ ভ্রমণের জন্য আমরা করি পাসপোর্ট। এটি আমাদের নাগরিকত্ব এবং জাতীয় পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ এক নথি। কিন্তু কখনো কী ভেবে দেখেছেন – কেন আমাদের সবার পাসপোর্টগুলোয় হাস্যোজ্জ্বল ছবি থাকে না।
হাফিংটন পোস্টের মার্কিনী লেখক ক্যারোলিন বলোনিয়া এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এক প্রতিবেদনে। সম্প্রতি ক্যারোলিনের পাসপোর্ট নবায়নের প্রয়োজন হয়। যুক্তরাষ্ট্রে নবায়নের প্রক্রিয়াটি করা যায় ডাক বিভাগের মাধ্যমেও। সেখানকার এক কর্মকর্তা তাঁকে পরামর্শ দেন যে, কোনোভাবেই যেন ছবি তোলার সময় তিনি না হাসেন। ফলাফল মলীন মুখে এক ছবি। তবে এইটেই নাকি সেরা – জানালেন ডাক কর্মী।
কেন পাসপোর্টের ছবি তোলার সময় হাসা যাবে না, অথচ অন্য ছবির বেলায় তাতে সমস্যা নেই?-- এই প্রশ্নটিই তখন উঁকি দেয় তাঁর মনে। সেই সূত্রেই খোঁজখবর করে জানাচ্ছেন যে, প্রযুক্তিগত কিছু বিষয় এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাজনিত কারণেই এমনটা করার নিয়ম নেই।
হাসতে কেন মানা
যুক্তরাষ্ট্রে পাসপোর্টের ছবি তোলার সময় হাসা যাবে না– আনুষ্ঠানিকভাবে এমন বিধিনিষেধ নেই। তবে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় পাসপোর্ট ছবিতে মুখভঙ্গিমা 'নিরপেক্ষ' রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেখানে দুচোখ খোলা থাকবে, বন্ধ রাখতে হবে মুখ। ছবি যিনি তুলছেন তাঁকে সরাসরি তাকাতে হবে ক্যামেরার দিকে।
এবিষয়ে আরও জানতে হাফিংটন পোস্ট যোগাযোগ করলে ডাক বিভাগের এক মুখমাত্র বলেন, "পাসপোর্ট আবেদনকারী অবশ্যই ছবিতে হাসতে পারেন, তবে দুই চোখ খোলা ও মুখ বন্ধ রেখে তা করতে হবে।"
অর্থাৎ, আপনার 'স্বাভাবিক চেহারা'-ই যেন আসে। দাঁত কেলানো একেবারেই নিষিদ্ধ– এতে মাস্টার পর্যায়েই বাতিল হবে পাসপোর্ট আবেদন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট পাসপোর্টের 'অবিকৃত' ছবি।
বায়োমেট্রিক ফোটোগ্রাফি ও ভ্রমণ বিশেষজ্ঞ ক্যারোলিনা তুরস্কাওয়া বলেন, "বিশ্বব্যাপী বিমানবন্দর ও সীমান্ত চেকপয়েন্টগুলোয় যাত্রীদের চেহারা শনাক্তে ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার চালু হওয়া এর প্রধান কারণ।"
তিনি জানান, অনেক বিমানবন্দরেই আগত যাত্রীদের পাসপোর্ট অভিবাসন কর্মকর্তাদের বদলে কম্পিউটারের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। ছবিতে চেহারার আলাদা ভঙ্গিমা থাকলেও– মানুষ সেটা বুঝতে পারে, কিন্তু অনেক সময়েই কম্পিউটার তা পারে না। একারণেই মেশিনগুলোকে সাহায্য করতেই এভাবে ছবি তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
তুরস্কাওয়া বলেন, "আমরা যেভাবে কাজ করি, অ্যালগরিদম সেভাবে করে না। তাই আমাদের ত্রিমাত্রিক চেহারাকে দ্বিমাত্রিক ছবির সাথে মিলিয়ে নিতে ও যাত্রীর চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত করতে সফটওয়্যার অ্যালগরিদমকে কিছু হিসাবনিকাশ করতে হয়। যেমন আমাদের দুই কান, চোখ, নাক ও মুখের মধ্যে ব্যবধান মাপে। মুখ ও চোখের ব্যাসার্ধও মাপে। সেক্ষেত্রে হাসিমুখের ছবি একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে, কারণ হাসলে চেহারার মাপজোঁকের কিছু পরিবর্তন হয়।"
ফ্লাইট এলার্ট সার্ভিং 'গোয়িং' এর পর্যটন বিশেষজ্ঞ ও মুখপাত্র ক্যাটি নস্ত্রো উল্লেখ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছবিতে হাসা যাবে না এমন নিষেধাজ্ঞা দেয়নি।
"যার অর্থ হচ্ছে, স্কুলের প্রথমদিনে তোলা ছবির মতো হাস্যোজ্জ্বল করা যাবে না চেহারা। কারণ মুখ বিস্তৃত করে ও দাঁত বের করে এমন হাসির ছবি দিলে– আপনার চোখের গড়ন ও চোখের মণির রঙ মেলাতে সমস্যায় পড়বে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি, এবং কিছুক্ষেত্রে পাসপোর্ট কর্মকর্তারাও— যাদের দায়িত্বই হলো আপনার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এখন বেশিরভাগ স্থানেই ভ্রমণকারীর চেহারা শনাক্তকরণ প্রযুক্তিকে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে, বায়োমেট্রিক প্রযুক্তির বর্তমান যে অগ্রগতি– তাতে মুখভঙ্গির যেকোনো পরিবর্তন হলে শনাক্তের কাজে ব্যাঘাত হয়, সেটি ঠেকাতেই এমন নিয়ম।
বৈশ্বিক এক নিয়ম
কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই পাসপোর্টের ছবিতে হাসিমুখ না করার সর্বজনীন এক নিয়ম রয়েছে বলে জানান তুরস্কাওয়া। তিনি বলেন, একেক দেশ একেক ধরনের ও সক্ষমতার ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, সেক্ষেত্রে পাসপোর্টের ছবিতে 'নিরপেক্ষ মুখভঙ্গি'র বিষয়ে তাঁদের সংজ্ঞার ভিন্নতা থাকতে পারে। যেমন ফ্রান্সের আনুষ্ঠানিক বিধিতে 'নিরপেক্ষ মুখভঙ্গির' যে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে সেখানে ঠোঁটের কোণ কিছুটা বাকানো হলেও সমস্যা নেই।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা ভ্রমণ নথি প্রস্তুতের চর্চা ও বৈশ্বিক মানদণ্ড বেধে দেয়। এরমধ্যে পাসপোর্টের ছবিতে ব্যক্তির মুখভঙ্গি কেমন রাখতে হবে– সেবিষয়েও দিকনির্দেশনা রয়েছে।
তিনি বলেন, "মুখভঙ্গিতে অতিরঞ্জিত অভিব্যক্তির ছাপ পড়লে— পাসপোর্টধারীর পরিচয় সম্পর্কে দ্রুত নিশ্চিত হওয়া যায় না। একারণেই বিশ্ব সংস্থাটির এ নিয়মটি বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রেও অনুসরণ করা হচ্ছে।"
ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি প্রয়োগ শুরুর পরে, ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশই পাসপোর্টের ছবিতে কেমন মুখভঙ্গি থাকবে সেবিষয়ে তাঁদের দিকনির্দেশনা হালনাগাদ করেছে।
ক্যাটি নস্ত্রো বলেন, "বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণের জন্য আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার একটি মানদণ্ড হচ্ছে পাসপোর্টধারীর চেহারা দিয়ে তা শনাক্ত করা। তবে যেহেতু কম্পিউটারের চেহারা শনাক্তকরণের সক্ষমতায় কিছুক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে– সেকারণে (ছবি) নিরপেক্ষে মুখভঙ্গিকে একটি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে গণ্য করা হয়।"
তবে এসব নিয়মকানুনের যত বালাই আধুনিক সময়ে এসেই। আগে কিন্তু এত বাধাধরার বালাই ছিল না। যেমন প্রথম মহাযুদ্ধের পর ১৯২০ এর দশকে যখন আকাশপথে ভ্রমণ বেসামরিক যাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল।
ভ্রমণ-বিষয়ক ম্যাগাজিন 'দ্য পয়েন্টস গাই – এর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ম্যাডিসন ব্ল্যাঙ্কাফ্লোর বলেন, "পাসপোর্ট নিয়ে তখন এত কড়াকড়িও ছিল না। প্রথম যখন পাসপোর্ট ফোটোর প্রচলন শুরু হলো, তখন এর ব্যবহার ছিল খুব সীমিত, বলতে গেলে কোন ধরনের ছবি পাসপোর্টে থাকবে তা নিয়ে গৎবাঁধা নিয়ম ছিল না। অনলাইনে একটু অনুসন্ধান করলে– সেই সময়ের ঐতিহাসিক কিছু ছবিও পেয়ে যাবেন, যেগুলো খুবই মজার দেখতে। যেমন কোনোটায় কেউ হয়তো ঝকমকে হ্যাট পরেছেন, কেউবা বসে বাজাচ্ছেন কোনো বাদ্যযন্ত্র। তবে কালক্রমে সীমান্ত নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার কথা ভেবেই পাসপোর্টের নিয়মকানুন কঠোর করা হয়েছে।