গরম পানি দিয়ে গোসল চুল ও ত্বকের জন্য কি ক্ষতিকর হতে পারে?
গরম পানি দিয়ে গোসল করলে যে আরাম পাওয়া যায়, তা আসলে লুকানোর কিছু নেই। মুহূর্তেই শরীরের ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে এই উষ্ণ গোসল। তাছাড়া গেঁটে ব্যথায়ও আরাম মেলে এ গোসলে। আবার মেজাজ ঠান্ডা করতে ও ভালো ঘুমের জন্য কিন্তু গরম পানির গোসলের জুড়ি নেই।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডার্মাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ভিক্টোরিয়া বারবোসা তাই বলেন, "গরম পানিতে গোসল করার কিছু উপকারিতা আছে, তাই আমি বিষয়টি উপেক্ষা করতে চাই না।" কিন্তু তিনি সাবধানও করেন। তিনি বলেন, "গরম পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বকের কিন্তু কোনো উপকার হয়না।"
ডার্মাটোলজিস্টরা জানিয়েছেন, "গরম পানি ত্বক এবং চুলের উপর কেমন প্রভাব ফেলে তা নিয়ে গবেষণা কম হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত গরম পানিতে গোসল করা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। কারণ অতিরিক্ত গরম পানি ত্বকের তেল এবং আর্দ্রতা সরিয়ে ত্বককে আরও শুষ্ক করে তুলতে পারে।
ড. বারবোসা বলেন, "শখ করে মাসে কয়েকদিন গরম পানিতে গোসল করা যেতে পারে কিন্তু প্রতিদিনের অভ্যাস হিসেবে গড়ে তোলা উচিত নয়।"
গরম পানি ত্বকের ওপর কী প্রভাব ফেলে?
ত্বকের স্বাস্থ্য নিয়ে গোসলের ওপর করা গবেষণায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কী ধরণের সাবান-শ্যাম্পু ব্যবহার করা হয়েছে তা-ই দেখা হয়েছে। তবে গোসলে পানির তাপমাত্রা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে গবেষণা খুব সীমিত, বলে জানান মিশিগান মেডিসিনের ডার্মাটোলজির ক্লিনিক্যাল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ব্লেয়ার জেনকিন্স।
ডার্মাটোলজিস্টরা বলছেন, "গরম পানি বিশেষ করে সাবান মিশ্রিত গরম পানি যার মধ্যে সুগন্ধি বা ক্ষতিকর উপাদান আছে, সেগুলো ত্বকের বাইরের স্তরকে নষ্ট করে ফেলে। ত্বকের এ বাইরের স্তরটি স্কিন ব্যারিয়ার নামে পরিচিত।"
বোস্টনের একজন ডার্মাটোলজিস্ট ড. পাওলা বেকার বলেন, "স্কিন ব্যারিয়ার ত্বকের মৃত কোষ দ্বারা তৈরি। এ কোষগুলো সিরামাইড, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং কোলেস্টেরলের মতো চর্বিযুক্ত পদার্থের একটি ঘন ম্যাট্রিক্স দ্বারা গঠিত। এই পদার্থগুলোকে লিপিড বলা হয়। এ লিপিড ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং বাইরের অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর উপাদান থেকে ত্বককে রক্ষা করে।"
ড. বেকার বলেন, "স্কিন ব্যারিয়ারের ওপর একটি পাতলা স্তর রয়েছে। এ স্তরটি অ্যাসিড ম্যান্টল নামে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে অ্যামিনো অ্যাসিড। ত্বকের ঘামে থাকা অ্যাসিড ও ত্বকের তৈলাক্ত পদার্থ দিয়ে তৈরি সিবাম আর্দ্রতাকে ধরে রাখে। চুলের ফলিকলের কাছাকাছি থাকা গ্রন্থি থেকে এ তৈলাক্ত পদার্থ বের হয়ে ত্বককে শক্তিশালী রাখে এবং ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করে।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরম পানিতে গোসল করলে ত্বকের এ সিবাম সরে যায় এবং ত্বককে শুষ্ক করে ফেলে। এছাড়া স্কিন ব্যারিয়ারের লিপিডগুলোর গঠনও নষ্ট হতে পারে। স্পেনের গ্রানাডার ভার্জেন ডি লাস নিয়েভেস ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণার লেখক ড. ত্রিনিদাদ মোন্তেরো-ভিলচেজ বলেন, বেশি গরম পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বকের ব্যারিয়ার আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে এবং ত্বকের আর্দ্রতা সহজে বেরিয়ে পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্করা যখন তাদের হাত একবার গরম পানিতে আরেকবার ঠান্ডা পানিতে ডুবিয়েছিলেন, তখন গরম পানি ত্বকের ক্ষতি করেছে বেশি। কারণ গরম পানি ত্বকের আর্দ্রতা বেশি শুষে নিয়েছে, ব্যারিয়ার দুর্বল করে দিয়েছে এবং এতে ত্বক লালচে হয়েগেছে। তাছাড়া গরম পানি ত্বকের পিএইচ মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়।
ড. বারবোসা জানান, গরম পানি ত্বককে আরও টানটান ও শুষ্ক করে তোলে।
গরম পানি চুলের ওপর কী প্রভাব ফেলে?
ত্বকের মতো গরম পানি চুলকেও শুষ্ক করে তুলতে পারে। তবে এ বিষয়ে গবেষণা আরও কম হয়েছে। অ্যারিজোনার মায়ো ক্লিনিকের ডার্মাটোলজির সহকারী অধ্যাপক বলেন ড. এলিকা হস বলেন, "আমাদের ত্বকের প্রায় সব জায়গায় সিবাম নিঃসরণকারী গ্রন্থি থাকলেও, মুখ এবং মাথার ত্বকে এই গ্রন্থির সংখ্যা অনেক বেশি। আর এ সিবাম বের হয়ে চুলের বাইরের স্তরটিকে আবৃত করে রাখে। কিন্তু চুল গরম পানি দিয়ে ধুলে সেই সিবাম চলে যেতে পারে।"
এ বিষয়ে চিকিৎসক ড. জেনকিন্স বলেন, "রোগীরা যখন শুষ্ক ও ভঙ্গুর চুলের সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসেন, তাদের আমি প্রায় তার গোসলের রুটিন সম্পর্কে জানতে চাই। কারণ হয়ত তার রুটিনে পরিবর্তন এনেই তার সমস্যা দূর করা সম্ভব।"
ত্বক ও চুল সুস্থ রাখার সেরা উপায় কী?
যদি আপনার চুল বা ত্বক শুষ্ক থাকে কিংবা একজিমা বা সোরিয়াসিসের মতো সমস্যা থাকে, তাহলে চাইলে সপ্তাহে একদিন আপনি কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন। কারণ ঘন ঘন গরম পানি দিয়ে গোসল করলে এ ধরনের সমস্যা আরও বেড়ে যাবে এবং ত্বক কিংবা চুলের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
অপরদিকে আপনার ত্বক বা চুল যদি তৈলাক্ত হয় তাহলে আপনি চাইলে ঘন ঘন গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন বলে জানান ড. জেনকিন্স। তবে কুসুম গরম পানিতে গোসল শেষ করার পরামর্শ দেন ড. জেনকিন্স। ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের ডার্মাটোলজির অ্যাডজাঙ্ক্ট অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. ব্রিটানি ক্রেইগলো পরামর্শ দেন, "গোসলের সময়ও সংক্ষিপ্ত করা উচিত। আর সবচেয়ে আদর্শ সময় হলো পাঁচ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে গোসল শেষ করা।"
ড. ক্রেইগলো আরও বলেন, "গোসলের সময় মৃদু এবং সুগন্ধিহীন ক্লিনজার ব্যবহার করা উচিত। কারণ কিছু ক্লিনজার ও শ্যাম্পুতে সোডিয়াম লরিল সালফেটের মতো উপাদান থাকে যার দীর্ঘ ব্যবহারে ত্বকের ব্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া প্রতিদিন চুলে ধোয়ার পরিবর্তে প্রয়োজনে শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। যেমন: ব্যায়াম করার পর কিংবা চুল বেশি তৈলাক্ত মনে হলে শ্যাম্পু করতে পারেন।"
এদিকে ড. বারবোসা পরামর্শ দিয়েছেন, গোসলের পর ত্বক ভেজা থাকা অবস্থায়ই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত। তবে ময়েশ্চারাইজার হিসেবে লোশনের পরিবর্তে ওয়েন্টমেন্ট বা ক্রিম জাতীয় উপাদান ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ এগুলো লোশনের চাইতে বেশি ভালো কাজ করে। আর অবশ্যই কোনো ময়েশ্চারাইজার কেনার সময় তাতে সিরামাইড, গ্লিসারিন বা পেট্রোলিয়াম জেলির মতো উপাদান আছে কিনা তা দেখে নেওয়া উচিত।
তবে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এবং সে বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাই ড. জেনকিন্স বলেন, "কিছু মানুষ সবসময়ই গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন এবং তাদের কখনই কোনো সমস্যা হয় না।"