যুগে যুগে চুলের যত্নে ‘স্নেহপূর্ণ’ তেল
হেমন্তের শুরুতে বায়ু তার গতিপথ বদলে খেলে যাচ্ছে উত্তরের জানালা দিয়ে। তাই শীতবরণের প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে মাধবীর ঘরে। কাচের বয়ামে ভরা তেল জানালার পাশে রেখেছেন তিনি।
সকালে যখন রোদ আছড়ে পড়ে, তখন বয়ামের ভেতরের নারকেল গলতে শুরু করে। নারকেল সম্পূর্ণ গলে গেলেই পিঁড়ি নিয়ে বসে পড়বেন গৃহবধূ মাধবী।
তার পুরো নাম মাধবীলতা। স্নান সেরে চুলে একটু তেল লাগানো তার প্রতিদিনের অভ্যাস, যা তিনি পেয়েছেন মা আশালতার কাছ থেকে।
ছোটবেলায় স্নান শেষে মায়ের কাছে চার ভাইবোন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতেন, আর মা চুলে নারকেল তেল মেখে সিথি করে চুল আঁচড়ে দিতেন। মায়ের কাছ থেকেই শোনা, তার নানিও একইভাবে চুলে তেল দিতেন। সেই অভ্যাস আজও মাধবী ধরে রেখেছেন।
নারকেল তেল আগে ঘরেই তৈরি হতো
নারী সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক হলো তার চুল। কালো রঙের লম্বা চুলের প্রতি নারী-পুরুষ সকলেরই আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। বলা হয়, নারীর সৌন্দর্যের অর্ধেকই থাকে তার ঘন কালো চুলে। তেল চুলে পুষ্টি যোগায়, যদিও আজকাল ডাক্তাররা এ নিয়ে ভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন।
১৯৯৯ সালে 'ইফেক্ট অব কোকোনাট ওয়েল অন প্রিভেনশন অব হেয়ার ড্যামেজ' শীর্ষক একটি গবেষণায় চুলের প্রোটিন রক্ষায় নারকেল তেলের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, নারকেল তেল চুলের প্রোটিন রক্ষায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। একইসঙ্গে চুলের কিউটিকল ফুলে যাওয়াও নারকেল তেলের মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব।
বাঙালি নারীদের জন্য চুলের যত্নে তেলের গুরুত্ব অবিস্মরণীয়। আগে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে বা বরপক্ষ দেখতে এলে মায়েরা ও দাদিরা চুলে তেল মেখে চুল বাঁধতেন।
তখনকার দিনে চুলের যত্ন বলতে নারকেল তেল আর মেহেদীর ব্যবহার হতো। এছাড়াও আমলকির তেল, ব্রাহ্মী, ভৃঙ্গরাজ, কদুর তেল, বাদাম তেল এবং সরিষার তেলেরও ব্যবহার ছিল। তবে, নারকেল তেলের ব্যবহারের পরিমাণই ছিল সবচেয়ে বেশি। এমনকি এখনো চুলের তেল বলতে এক কথায় নারকেল তেলই বোঝানো হয়।
সেই নারকেল তেল ঘরেই তৈরি হতো, কিংবা খোলা তেল কেনা যেত বাজার থেকে। এখন তো নারকেল গাছের আকাল, গাছেও আর আগের মতো ঝুনো নারকেল ঝুলে থাকে না।। ফলে নারকেল তেল এখন দামী বোতলে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
সাবিনা সুলতানার বয়স পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু তার লম্বা কালো চুল দেখলে তার বয়স কম বলে মনে হবে। চুলে তেল দেওয়া তার প্রতিদিনের কাজ। তিনি মনে করেন, এত লম্বা আর ঘন চুলের পেছনে এ নিয়মিত তেল দেওয়াই মূল কারণ।
চুলের যত্নে তিনি কদুর তেল, আমলকির তেল ব্যবহার করেন, তবে নারকেল তেলের ওপরেই বেশি নির্ভর করেন। ছোটবেলায় বাড়িতে বানানো তেল দিয়েই চুলের যত্ন নিতেন। এখন শহুরে জীবনে সেই উপায় নেই দেখে, প্রতিদিন গোসলের আগে কেনা তেল দিয়ে দশ মিনিট অপেক্ষা করেন। এ অভ্যাস তিনি আয়ত্ত করেছেন তার মায়ের কাছ থেকে।
সাবিনা বলেন, 'এভাবে তেল দিলে মাথা থেকে অতিরিক্ত তেল চলে যায়, আর যেগুলো থাকার, সেগুলো চুলের গোড়ায় ঠিকই থাকে এবং সুগন্ধও থাকে চুলে।'
যুগে-যুগে কতরকম কেশচর্চা
'রুবি দাদি জুবি দাদি' শীর্ষক একটি স্মৃতিচারণায় সাগুফতা শারমীন তানিয়া লিখেছেন, 'রুবি-জুবিদের মা যত্ন করে কেশুতপাতা, একাঙ্গী, আমলকী, জবাকুঁড়ি, মেহেদী এসব বেটে রোদে শুকিয়ে বড়ি করে মাথা ঘষার তেলে দিয়ে রাখত। সেই তেল চুলে মেখে, তারপর সর্ষের খোল আর রিঠার জলে শ্যাম্পু করে তবে তো ওইরকম চুল।'
শান্তা শ্রীমানীর 'ঠাকুরবাড়ির রূপ-কথা' বই থেকে জাহেরা শিরিন তার কুন্তলকাহন শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, 'স্নানের পর আর বিকেলে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বসে পড়ত পরিচারিকাদের সামনে।
'চুল ভালোভাবে আঁচড়ে প্রথমে পাঁচ আঙুলে ধীরে ধীরে বিলি কেটে জট ছাড়িয়ে তারপর ছোট, সরু, বড়- নানা রকম চিরুনি দিয়ে ভালো করে আঁচড়ানো হতো। বিকেলে সবাই নিয়ম করে চুল বাঁধতেন। চুলে দেওয়া হতো নানা রকম তেল। গোছা বাড়ানোর জন্য দেওয়া হতো ম্যাকাসর তেল।
'তালিকায় আরও ছিল জবাকুসুম, আমলা, লক্ষ্মীবিলাস, কেশরঞ্জন, কুন্তলীন। তা ছাড়া ঘন চুলের জন্য বাড়িতে বানানো হতো বিশেষ ধরনের তেল। তার জন্য বড় বাজার থেকে আনা হতো একরকম মসলা। চিনামাটির পাত্রে সেই মসলা, খুদে মেথি আর আধখানা করে কাটা শুকনা আমলকী নারকেল তেল মিশিয়ে রোদে দিয়ে রাখা হতো কিছুদিন।
'তেলটা ধীরে ধীরে লাল রং হয়ে যেত। মসলাটার একটা সুগন্ধ থাকত। তারপর সেই তেল ছেঁকে বোতলে ভরে নিয়মিত দেওয়া হতো চুলে। এ ছাড়া নারকেল তেলে মেথি মিশিয়েও চুলে মাখা হতো। মাখানোর পদ্ধতিও ছিল বিশেষ। চুল সরিয়ে সরিয়ে মাথায় বিলি কেটে তেল দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।'
আবার মিশরের রানী ক্লিওপ্লেট্রা কেশচর্চা করতেন না-কি ক্যাস্টর অয়েল দিয়ে। বাংলায় যাকে বলে রেড়ির তেল। সঙ্গে রোজকার যত্নে থাকত জলপাই তেল আর বাদাম তেল।
আরও পড়ুন: বাংলার বিজ্ঞাপন: জবাকুসুম থেকে 'যদি লাইগা যায়'
একটি আদর-স্নেহের সম্পর্ক, মমত্ববোধ
"সংস্কৃতে তেলকে বলে 'স্নেহ,' যার অর্থ ভালোবাসা। যখনই আপনি নিজের বা অন্য কারও চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন, আক্ষরিক বা রূপক দুইভাবেই আপনি তাকে ভালোবাসা দিচ্ছেন!" এ উক্তিটি করেছেন ২০২২ সালে প্রকাশিত 'দ্য ওয়ে অব দ্য গডেস' বইয়ের লেখক অনন্তা রিপা আজমেরা।
আসলেও তা-ই। চুলে তেল দেওয়ার সঙ্গে এ উপমহাদেশের নারীদের কেবল চুলের যত্নই নয়, আছে একটি আদর-স্নেহের সম্পর্ক, মমত্ববোধ। নানি, দাদি কিংবা মায়েরা ছোটদের চুলের পরিচর্যা করতেন। সকালের কাজ শেষে অথবা বিকেলের নরম রোদে বসে চুলে তেল দেওয়া, বিনুনি গাঁথার দৃশ্যগুলো আমাদের জন্য এখনও খুব বেশি পুরোনো হয়নি।
শ্যামলী সেন নামে একজন তার ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন, চুলের যত্নের পুরোটাই হতো পরিবারে—একে অপরের সাহায্যে। প্রতিদিন সন্ধ্যের আগে চুলে তেল দিয়ে দিতেন তার ঠাম্মি [ঠাকুর্মা]। আর সঙ্গে নিয়ে বসতেন গল্পের ঝুলি। তেল তিনি তেমন পছন্দ করতেন না, কিন্তু এ যে তেলের সঙ্গে মিশে থাকা ঠাম্মির আদর আর স্মৃতি, সেগুলোই মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায়।
যদিও চুলের যত্নের ধারণাটি এখন অনেকটাই বদলেছে, কিন্তু এখনো তো সারাসপ্তাহের ব্যস্ততার পর, ক্লান্তি দূর করতে একটু আরাম আর স্নেহের পরশ পেতে চলে যাই ঘরের সেই প্রিয় মানুষের কাছে। যার হাতের বিলি আর কুসুম গরম তেলের ছোঁয়ায় দূর হয়ে যায় শরীরের সব ক্লান্তি, মনের সব অবসাদ। কেউ কেউ এই 'হেয়ার ম্যাসেজ' নিতে সেলুনে ছুটে যান। কিন্তু আমাদের দাদি-নানিরা তো এতসব নাম দিয়ে যাননি।
তারা বরং সব কাজ সেরে, পানের বাটা আর টিনের বাটায় গরম তেল নিয়ে বসতেন একে অপরের মাথায় তেল দেওয়ার জন্য। কত গল্প, হাসি, গোপন কথা চালাচালি হতো সেই চুলে তেল দেওয়ার আসরে!
সুগন্ধী তেল ছিল বিলাসি দ্রব্য
শ্যাম্পুর দিন তখন ছিল না, ফলে সুগন্ধী তেলই ছিল বিলাসী পণ্য। অবস্থাসম্পন্ন স্ত্রীরা স্বামীর কাছে যাবার সময় চুলে মেখে যেতেন সুগন্ধী তেল।
বঙ্গদর্শন পত্রিকায় পাওয়া যায় এমন দৃশ্যগল্পে বলা হয়েছে: "তখনকার বঙ্গযুবতীরা এখনকার স্তায় খৰ্ব্বকেশা হন নাই। তখন সিন্দুরে বিষ মিশে নাই, চুল টানিয়া বাধা ফ্যাশন হয় নাই। কাজেই এক্ষণকার মত কেবল টাক ঢাকিতে ঘোমটার প্রয়োজন হইত না।
পরিচারিকা পুটুর মার পশ্চাতে বসিল, মেঘের ন্যায় পুটুর মার কেশরাশি এলাইয়া পড়িল। পরিচারিকা তাহার মধ্যে অঙ্গুলিসঞ্চালন করিতে করিতে বলিল, 'ঠাকুরাণীর কি চুল, আমাদের মহারাণীরও এরূপ নয়।'
পুটুর মা দর্পণ তুলিয়া প্রসন্ন বদনে আপনার চুল দেখিতে লাগিলেন। কেশরাশি অঙ্গুলি আন্দোলিত হইয়া আসনে খেলিতেছে। পুটুর মা ঈষৎ হাসিমুখে আপনার কেশের প্রতি কটাক্ষ করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, 'রাণীর কেশ কি আরও ছোট?'
পরিচারিকা বলিল, 'আহা! সে দুঃখের কথা আর কি বলিব! এবার প্রসব হওয়ার পর তাহার অর্ধেক চুল গিয়াছে, যাহা কিছু আছে তাহা কেবল আমাদের গুণে। কেবল চুল কেন? দেখেছেন তো রাণীর বর্ণ, যেন কাচা সোনা, তাহাও আমাদের ফলান। রাজা যে এতটুকু রাণীকে ভালবাসিতেন তাহাও আমাদের চেষ্টায়।'
পুটুর মা বললেন, 'রাজা কি এখন আর রাণীকে তত ভালবাসেন না?'
পরিচারিকা: কই আর! এ বলিয়া পরিচারিকা চক্ষুভঙ্গি করিয়া হাসিল। পুটুর মা তাহা দেখিতে পাইলে আর একথার প্রসঙ্গ করিতেন না।
পুটুর মা: রাজার ভালবাসা গেল কেন?
পরিচারিকা: তা কি জানি মা? রামি বলে আর সোহাগতৈল রাণী মাখেন না বলিয়া ভালবাসা গেল।
পুটুর মা: সোহাগ তৈল কি?
পরিচারিকা: সে একটা তেল।
পুটুর মা: তা আর মাখেন না কেন?
পরিচারিকা: কোথায় পাবেন? আমি ছাড়িয়া গেলেম আর তেল তারে কে করবে। সোহাগ তেল সকলের হাতে হয় না…'" (পাতা: বঙ্গদর্শন-ষষ্ঠ খণ্ড পৃ ৫৬০)।
এখানে সোহাগ তেল কিন্তু কোনো তেলের নাম নয়। আদরমাখা ও যত্নের সহিত তেল দেওয়াকেই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু তেল যে নারীর সৌন্দর্যের অঙ্গ এবং পুরুষের মনোযোগ আকর্ষণকারী, তার উদাহরণ পাওয়া যায়।
সুগন্ধী তেল না দিলে বিয়ে হবে না
ব্রিটিশ আমল থেকে প্রায় সত্তরের দশক পর্যন্ত সুগন্ধী তেল ছিল বউয়ের সাজের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। শুধু তেল নয়, সুগন্ধী তেল হতে হবে। যেহেতু তখন পারফিউম বা বডিস্প্রের এত ব্যবহার ছিল না, তাই সুগন্ধী তেল দিয়েই চলতো সে কাজ। বিশেষ করে হিমকবরী বা গন্ধরাজ তেল ছিল পছন্দের শীর্ষে। হিমকবরী বা গন্ধরাজ তেল যদি ছেলেপক্ষ না আনত, তবে বিয়েই হবেনা—এমন রবও নাকি ছিল!
চুল বাঁধার জন্য ব্যবহার হতো লাল, হলুদ, সবুজের মতো উজ্জ্বল রঙ্গিন সাটিনের ফিতা। তেল দিয়ে মাথা টেনে দুই বেণি করে পেছন থেকে ঘুরিয়ে চুল বাঁধা হত তখন। এ তেল লেগে নাকি নষ্টও হয়েছে অনেকের বিয়ের শাড়ি। ফলে বিয়ের দিনই সে শাড়ি শেষ! শাড়ি নষ্ট হলেও, বাসর রাতে সেই সুগন্ধী তেলই সুবাস ছড়াবে। তাই বরপক্ষকে সেই সুগন্ধী তেল অবশ্যই নিয়ে আসতে হতো আর সেই তেল মাথায় দিতেই হতো।
এদিকে ছোটোবেলায় চুলে তেল দেয় না দেখে কত মারধোর, বকুনি শুনতে হয়েছে যামিনীকে। মা, দাদি সবাই যেন পিছে লেগে থাকত চুলে তেল দেওয়ার জন্য। এখনো যামিনীর তেলের প্রতি একই অনীহা। তিনি বলেন, 'বরং কেবল গরম লাগা শুরু হয়। শরীর ঘামে। চুলের পুষ্টি তো আমাদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে। তেলের মধ্যে তো কিছু নেই। সুষম খাবার, নিয়মিত পানি, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন আর চুল পরিষ্কার রাখা—এ তো চুল ভালো থাকার নিয়ম।'
তবে ইংল্যান্ডের একটি চুল প্রতিস্থাপন সেবা কেন্দ্র ক্রিউ হেয়ার অ্যান্ড স্কিন ক্লিনিক-এর পরিচালক এবং পাবলিক হেলথ অনুষদের ফেলো ডক্টর ইনগ্রিড উইলসন বলেন, 'চুলে তেল দেওয়ার প্রধান বৈজ্ঞানিক সুবিধা হলো এটি আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।'
বাসন্তী সাহা গত পনেরো বছর ধরে চুলে তেল না দিয়েই আসছেন। একান্নবর্তী পরিবারে তাকেও কাকিমাদের হাতে তেল দেওয়ার স্মৃতি আছে। গোসলের আগে তেল দিয়ে স্নানে যেতেন, কিন্তু কমই দিয়েছেন। কারণ তেল দিলে চুল লম্বা হওয়ার যে প্রবাদ চালু আছে, তাতে তার একটুও লোভ নেই। চুল ছোটোই তার পছন্দ। আজীবন ছিলও তাই।
কিন্তু মা, কাকি, ঠাকুরমা আর বড়বোনকে দেখেছেন চুলে তেল দিতে। নারকেল তেলটাও বানানো হতো ঘরেই, কিংবা খোলা কিনতে পাওয়া যেত। যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ততোটা সচ্ছল ছিল না, তারা সরিষার তেল মাখতেন চুলে। আর সুগন্ধী তেলগুলো আসতো কলকাতা থেকে।
তিনি বলেন, "এখন যেমন হীরের গয়না, দামি দামি পারফিউম, ফরেন ট্যুর বিলাসিতা, তখন বিলাসিতা ছিল সুগন্ধী তেল আর সাবান। লোকে পরকীয়া করলে উপহার হিসেবে নারীকে দিত সাবান বা সুগন্ধী তেল। কারও স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে লোকে বলত, 'তেল সাবান তো দেয়। আর কি?'"
জনপ্রিয় সেসব তেল
উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক সমগ্র দেশজুড়ে স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল। বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের দিকে সাধারণ মানুষের রুচি ও পছন্দ ঝোঁকে। প্রসাধন সামগ্রী তখন ঘরে ঘরে সমাদৃত। তাই অনেক বাঙালি যুবক তেল, এসেন্স, আলতা, সিঁদুরের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রস্তুতি ও তার বাণিজ্যে নেমেছিলেন।
চুলের তেলের মধ্যে ছিল যেমন জবাকুসুম, কুন্তলীন, কোয়ারকার্পিন, 'সুন্দরী সোহাগ কেশ তৈল', কেতকীকুসুম তেল, আরও অনেক পরে জুঁই হাসমার্কা নারকেল তেল, সত্তরের দশকের লালবাগ কেমিক্যালসের গন্ধরাজ, নিদ্রাকুসুম বা চন্দন তেল (এগুলো আবার ঠান্ডা হতো), কোহিনূর ক্যামিকেলসের তিব্বত কদুর তেলসহ আরও অনেক।
১৮৭৮ সালে যাত্রা শুরু করেছিল জবাকুসুম কেশ তৈল। বাজারে আসার কিছুকালের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং কালক্রমে ঘরে ঘরে কেশবিলাসীনী মহিলাদের কাছে প্রসাধনের এক আদরণীয় অপরিহার্য সামগ্রী হয়ে উঠেছিল। ১৯০৩ সালে জবাকুসুম কেশ তৈল নিয়ে এক বিজ্ঞাপনী ফিল্ম তৈরী করিয়েছিলেন হীরালাল সেনকে দিয়ে, যাকে ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
তখন আরও কয়েকটি কেশ তেল বাজারে ছিল। যেমন, কবিরাজ নগেন্দ্রনাথ সেনের কেশরঞ্জন তেল। সত্যজিত রায় এঁকেছিলেন জবাকুসুমের বিজ্ঞাপন চিত্র। যারা এ তেল ব্যবহার করতেন, বিশেষ করে মেয়েরা, তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে এ তেলই ব্যবহার করতেন।
শাহানা রহমান পেশায় একজন গৃহিণী, থাকেন চট্টগ্রামের চকবাজারে। তিনি জানান, 'এ তেল পাওয়া যেত কাচের বোতলে। দামি তেল ছিল, সেইসময়েই তিনশো সাড়ে তিনশো টাকা। আমার স্বামী আমার জন্য নিয়ে আসত।'
আরেক জনপ্রিয় তেল ছিল কুন্তলীন। উনিশ শতকের শেষ দিকে নিজের সুগন্ধি চুলের তেলের নাম অনুসারে 'কুন্তলীন পুরস্কার' নামে একটি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করেন হেমেন্দ্রমোহন বসু। তিনি মূলত বিজ্ঞাপন হিসেবে এ কাজটি করেছিলেন।
পুরস্কারটি অল্পদিনের মধ্যে বাংলার উদীয়মান এবং প্রতিষ্ঠিত, উভয় সাহিত্যিক মহলেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 'কুন্তলীন' নামে একটি ম্যাগাজিনও প্রকাশিত হত। এ ম্যাগাজিনের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যকে ব্যবহার করে শিক্ষিত বাঙালি সমাজের কাছে নিজের পণ্য পৌঁছে দিতেন।
তবে লেখকদেরকে একটি শর্ত দেওয়া থাকত—গল্প লেখার সময় 'কুন্তলীন' চুলের তৈল কিংবা 'দেলখোস' শব্দগুলো এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন সেসবে বিজ্ঞাপনের গন্ধও যাতে না থাকে।
কুন্তলীন তেল মাখার রেওয়াজ ছিল ঠাকুরবাড়িতেও। এছাড়া ছিল 'কুন্তল বৃষ্য তৈল', 'কেশরঞ্জন', 'কোয়ারপিন' তেলের মতো সুগন্ধী তেলের সমাহার। এগুলো কলকাতা থেকে আসত, ফলে বন্দরঅঞ্চলগুলোতে এ তেলগুলো পাওয়া যেত সুলভমূল্যে।
যুগ বদলালেও, যত্ন কমেনি
তেলের ব্যবহার আসলে বহুবিধ কারণে। এর উপকারিতা কী বা কেমন, তারচেয়ে এটি যুগযুগ ধরে ভারতীয় রমণীদের অভ্যাস বলেই প্রচলিত হয়ে এসেছে।
চুলে তেল দিলে মাথা ঠান্ডা থাকে, চুল ঘন এবং লম্বা হয়—এ বকুনি শুনতেই শুনতে কতগুলো প্রজন্ম বড় হয়ে গেল! কিন্তু এখন চিকিৎসকদের মতে, চুলকে নরম ও ঝকঝকে করার পাশাপাশি তেলের আর কোনো কাজ নেই। চুলে তেল দিলেও, গোসলের আধা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত মাথায় রাখলেই যথেষ্ট। এরপর শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে।
চুল বা মাথার ত্বকের যত্নে এখন বর্তমান প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সিরাম। সিলিকন-বেইজড এক ধরনের লিকুইড, যা অ্যামিনো অ্যাসিড ও সিরামাইড দ্বারা তৈরি এই সিরাম চুলের বাইরে এক ধরনের আস্তরণ তৈরি করে। এটি বাইরের রোদ, দূষণ ও ধুলোবালি থেকে চুলকে সুরক্ষিত রাখে এবং চুলের আর্দ্রতা বজায় রাখে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে কাজের জন্য মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা দূষণ থেকে চুল বা মাথার ত্বককে রক্ষা করতে কিছু বিশেষ রাসায়নিকের ব্যবহার আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
এছাড়া, এই সিরামগুলো বিশেষ সূত্র মেনে, প্রত্যেকের সমস্যা অনুযায়ী আলাদাভাবে তৈরি করা হয়। তাই শুষ্ক বা অতিরিক্ত তৈলাক্ত ত্বক, খুশকি, এবং চুল পড়ার মতো সমস্যায় এই সিরাম বিশেষভাবে কার্যকর।
তবে প্রাচীন কৌশল ও উপাদানের প্রতি মানুষের আকর্ষণ এখনও অটুট। অনেক মানুষ এখনো প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে তেল তৈরি করতে পছন্দ করেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন, এটি বেশি কার্যকর ও নিরাপদ। এ বঙ্গে তেলের ব্যবহার শত শত বছর ধরে প্রচলিত।
বিভিন্ন ফ্যাটি অ্যাসিড ও প্রাকৃতিক উপাদানে ভরপুর তেল চুলের একাধিক সমস্যা উপশমে সহায়তা করে। বিশেষ করে নারকেল তেল ক্ষতিগ্রস্থ চুলের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার এবং চুলের বৃদ্ধি সাধনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এছাড়া, আমলকী, ভৃঙ্গরাজ, মেথি, তিল, এবং ব্রাহ্মীর মতো উপাদান চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং পুষ্টি সরবরাহ করে। এ কারণে এখন হারবাল বা ঘরে বানানো তেল, শ্যাম্পু, এবং হেয়ার প্যাকের বাজারও বেশ তুঙ্গে।
বাজারে ক্ষতিকারক কেমিক্যালের ভয়ে অনেকেই এখন ঝুঁকছেন আয়ুর্বেদিক ও হারবাল পণ্যে। একসময়ের জনপ্রিয় জবাকুসুম, কুন্তলীন, গন্ধরাজ, কোয়ারকার্পিনের মতো একচেটিয়া বাজার এখন আর নেই।
গ্রাম থেকে শহর, সবার চেনা সেই বিশেষ সুগন্ধী তেলের প্রতি আগের মতো চাহিদাও নেই। বরং ব্র্যান্ডের পাশাপাশি অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন তেল বাজারে উঠে আসায় এর বাজারও প্রসারিত হয়েছে।
এখন খোলা, উড়েবেড়ানো চুলেই নারীর সৌন্দর্য। দীঘল কালো লম্বা চুল আর ভারী খোঁপায় আটকে নেই আজকের মেয়েরা। লম্বা কালো চুলকে আদর্শের মানদণ্ডে না বসিয়ে ঝলমলে ও স্বাস্থ্যবান চুলই তাদের কাছে প্রিয়। তাদের মতো তাদের চুলও স্বাধীন।
তেল চুলকে অনুগত, বাধ্য ও শৃঙ্খলাপরায়ণ করে রাখত। এক তেলেই থাকত একাধিক প্রতিশ্রুতি—চুল গজানো, ঘনকালো চুল, মাথাব্যথা প্রশমন, মেয়েদের নিয়মিত ঋতুস্রাবসহ মাথা ঠান্ডা রাখার মতো নানা অঙ্গীকার।
এখন এক চুলের জন্য সিরাম, হেয়ার ওয়েল, ই-ক্যাপ্সুল, হেয়ার স্টিম, হেয়ার টনিকসহ আরও নানা কিছু পাওয়া যাচ্ছে। একেকটির একেক কাজ।
আবার চুলের ধরন ও ত্বক ও সমস্যাভেদেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন। অ্যালার্জির সমস্যার জন্য একরকম, খুশকির জন্য অন্যটি, মাথা ঠান্ডা রাখতে একরকম, তৈলাক্ত ত্বকের জন্য একরকম, শুষ্ক ত্বকের জন্য অন্যরকম।
অর্থাৎ এক তেলেই পুরো নারীজাতির স্বাস্থ্যবান চুলের অঙ্গীকার দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে নির্মাতা এবং ক্রেতা দুপক্ষই সচেতন থাকছেন।
বেছে নেওয়ার সুযোগ যেমন রয়েছে, বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগও তৈরি হচ্ছে। তবে চুলে তেল বা সিরাম যা-ই দেওয়া হোক, চুলের প্রতি এ বঙ্গের নারীদের মনোযোগ ও যত্ন কমেনি।
আগে হাতের কাছে গাছপালা, ফল, ফুল থেকে নির্যাস নিয়ে, দিনের পর দিন রোদে শুকিয়ে, জ্বাল দিয়ে, সময় নিয়ে কেশচর্চা হত। আর এখন উপার্জনক্ষম নারীরা সময় বাঁচাতে কিনে নিচ্ছেন দরকারি প্রসাধনীটি।
পালটেছে শুধু যুগ।