পুলিশি সেবা নিশ্চিতে ‘আধুনিক পুলিশের জনক’ রবার্ট পিলের ৯ মূলনীতি
১৮২৯ সালে রবার্ট পিল ব্রিটিশ সংসদে একটি আইন পাস করেন, যার মাধ্যমে লন্ডন মেট্রোপলিটন এলাকায় একটি সংগঠিত পুলিশ বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। এই উদ্যোগ ছিল অপরাধ দমন ও সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
প্রথমদিকে, ইউনিফর্মধারী পুলিশ বাহিনীর ধারণাটি অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর মনে হলেও, লন্ডন পুলিশের কার্যক্রম দ্রুতই ইংল্যান্ডসহ ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রশংসা অর্জন করে। তাদের সাফল্য নিউইয়র্ক সিটিকে অনুপ্রাণিত করে, এবং ১৮৩৩ সালে শহরটি লন্ডন মডেলের উপর ভিত্তি করে তাদের প্রথম পৌর পুলিশ বাহিনী গঠন করে।
এদিকে, ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় ব্রিটিশ সরকার। লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের সাফল্য দেখে তারা উপমহাদেশের পুলিশ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের পরিকল্পনা করে। এরই অংশ হিসেবে ১৮৪০ সালে একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সংসদে পুলিশ আইন পাস করা হয়।
এই আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের প্রতিটি প্রদেশে পৃথক পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়, যা প্রাদেশিক সরকারের অধীনে পরিচালিত হতো। প্রাদেশিক পর্যায়ে প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয় 'ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ' নামে একজন কর্মকর্তাকে, আর জেলার পুলিশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন 'সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ'।
১৮৬১ সালের এই আইন এখনো কার্যকর, এবং এটি বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের পুলিশ প্রশাসনের মূল কাঠামো হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি আজও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। রবার্ট পিলের নীতিমালা অনুযায়ী, জনগণের সমর্থন ও শ্রদ্ধা ছাড়া একটি পুলিশ বাহিনী কার্যকর হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু দেশের পুলিশ বাহিনী কি সত্যিই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে?
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে। জনমনে প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ বাহিনী কি আদৌ নিরপেক্ষ ও জনসেবামূলক থাকার আদর্শে অবিচল?
বাংলাদেশ পুলিশের নিজস্ব ওয়েবসাইটে পিলের নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হলেও, সেগুলো কার্যত কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। পিল, যিনি দুই দফায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (১৮৩৪–১৮৩৫, ১৮৪১–১৮৪৬), তার প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলো আধুনিক পুলিশি সেবার ভিত্তি তৈরি করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের কার্যক্রমে তার এই নীতিমালার সত্যিকারের প্রতিফলন কেমন, তা বিতর্কের বিষয়।
আজ (৩ ডিসেম্বর) প্রকাশিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জরিপে উঠে এসেছে, বিক্ষোভ মিছিল মোকাবিলা ও বিরোধী দলমত দমনে মাত্রারিক্ত বল প্রয়োগ করা ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের শাস্তি দাবি করেছেন ৭১.৫ শতাংশ মানুষ।
বাংলাদেশের জনগণ এমন একটি পুলিশ বাহিনীর দাবি করছে, যা রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিমুক্ত এবং আইন প্রয়োগে নিরপেক্ষ ও জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত।
এটি বোঝা যাচ্ছে যে, পিলের নীতিমালার মূল দিকগুলো — যেমন জনগণের আস্থা ও সমর্থন অর্জন এবং তাদের সেবায় দায়বদ্ধ থাকা — এখনও সময়োপযোগী। এই প্রেক্ষাপটে রবার্ট পিলের শতাব্দী প্রাচীন নীতিগুলো নতুন করে পর্যালোচনা করার সময় এসেছে।
- অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ
"পুলিশের মূল উদ্দেশ্য হলো অপরাধ দমন না করে বরং অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করা। যা সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক।"
- জনগণের অনুমোদন
"পুলিশের কার্যক্রমের সফলতা জনগণের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল। জনসাধারণের সমর্থন না পেলে পুলিশ কার্যকরভাবে তাদের কর্তব্য পালন করতে পারে না, তাই জনগণের বিশ্বাস ও সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
- জনসাধারণের সহযোগিতা
"পুলিশকে জনগণের সহায়তা পেতে হবে যাতে তারা আইন মেনে চলে, যা জনগণের সম্মান অর্জন ও বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। পুলিশকে জনগণের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, যেন তারা স্বেচ্ছায় আইন মেনে চলে এবং সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখে।"
- শক্তি প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা
"জনগণের সহায়তার পরিমাণ হ্রাস পায় যতই পুলিশকে শারীরিক শক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। যত বেশি শারীরিক শক্তি ব্যবহৃত হয়, ততই জনগণের সহযোগিতা কমে আসে, তাই পুলিশের উচিত যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধান করা।"
- নিরপেক্ষতা এবং বিচারিক সততা
"পুলিশকে কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব বা অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্রতিটি নাগরিকের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে।"
- শক্তি প্রয়োগের শর্ত
"পুলিশ শুধু আইন অনুসরণ বা শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করতে শারীরিক শক্তি ব্যবহার করবে, যখন সঠিক পরামর্শ, উপদেশ বা সতর্কতা যথেষ্ট না হয়।"
- জনসাধারণের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা
"পুলিশকে সর্বদা জনগণের সাথে এমন সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে যাতে তারা প্রমাণ করতে পারে যে পুলিশ জনগণেরই অংশ, যারা জনগণের কল্যাণে সম্পূর্ণ সময় কাজ করার জন্য অর্থের বিনিময়ে দায়িত্ব পালন করে। পুলিশ ও জনগণের সম্পর্ক কখনও বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত নয়। পুলিশের সদস্যরা জনগণেরই অংশ হিসেবে তাদের কল্যাণে কাজ করেন।"
- বিচার বিভাগের ক্ষমতা গ্রহণ না করা
"পুলিশের সকল কার্যক্রম অবশ্যই তাদের নির্ধারিত কাজের প্রতি মনোযোগী হতে হবে এবং কখনোই বিচার বিভাগের ক্ষমতা গ্রহণের মতো মনে হওয়া উচিত নয়। পুলিশ কখনোই বিচারকের ভূমিকা পালন করতে পারে না; তাদের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, বিচার করা নয়।"
- অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা না থাকলেই কার্যকারিতা
"পুলিশের কার্যকারিতা পরীক্ষার মানদণ্ড হলো অপরাধ ও বিশৃঙ্খলার অভাব, না যে পুলিশের কোনো পদক্ষেপের দৃশ্যমান প্রমাণ। পুলিশের কাজ কেবল অপরাধীদের ধরার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অপরাধের প্রকোপ কমানো এবং একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলা।"