সিরিয়ায় মাত্র ১২ দিনে আসাদের পতন ঘটানো এই বিদ্রোহী কারা?
পতন হয়েছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের। রাজধানী দামেস্ক ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি। আজ রোববার রয়টার্সকে এমনটাই জানিয়েছেন দেশটির সেনাবাহিনীর দুই সিনিয়র কর্মকর্তা।
দামেস্কে ঢুকে পড়েছে বিদ্রোহীরা। গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় আক্রমণ চালিয়ে অনেকটা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, মাত্র ১২ দিনে, আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়েছে বিদ্রোহীরা। ১৯৭১ সাল থেকে দেশটির ক্ষমতায় ছিল আসাদ পরিবার।
দুই যুগেও যা সম্ভব হয়নি, মাত্র ১২ দিনের অভিযানে সেই কাজ করে ফেলেছে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা।
মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো ও হামা-র দখল নেয় বিদ্রোহীরা। এরপর দখল নেয় আরেক গুরুত্বপূর্ণ শহর হোমস-এর। অবশেষে আজ তারা দখল নিল দামেস্কের।
জর্ডান সীমান্তের কাছে দক্ষিণ সিরিয়ার দারা অঞ্চলের প্রায় পুরোটা স্থানীয় বিদ্রোহীদের দখলে চলে গিয়েছিল আরও আগেই। এই এলাকাটি ২০১১ সালের আসাদবিরোধী অভ্যুত্থানের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত।
আকস্মিক এই আক্রমণে সিরিয়ার সামরিক বাহিনী বলতে গেলে কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি।
আসাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান পরিচালনা করছে ইসলামপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। সিরিয়ার দীর্ঘ সংঘাতময় ইতিহাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই গোষ্ঠী।
কারা এই হায়াত তাহরির আল-শাম?
এইচটিএসের যাত্রা শুরু হয় অন্য একটি নামে, ২০১১ সালে। আল-কায়েদার সরাসরি সহযোগী হিসেবে জাবহাত আল-নুসরা নামে যাত্রা শুরু করে গোষ্ঠীটি।
ইসলামিক স্টেট-এর (আইএস) নেতা আবু বকর আল-বাগদাদিও এই গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন।
এরা আসাদবিরোধী লড়াইয়ে অন্যতম কার্যকর ও ভয়ংকর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
তবে তাদের জিহাদি মতাদর্শ অনেক ক্ষেত্রেই বিপ্লবী মতাদর্শকে ছাপিয়ে যেত। ফ্রি সিরিয়া ব্যানারের আওতাধীন প্রধান বিদ্রোহী জোটের সঙ্গে মাঝে মাঝেই সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হতো তাদের।
২০১৬ সালে গোষ্ঠীটির নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জাওলানি প্রকাশ্যে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর তিনি জাবহাত আল-নুসরাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে নতুন সংগঠন গঠন করেন। সংগঠনটির নাম দেন তাহরির আল-শাম। এক বছর পর এর সঙ্গে একীভূত হয় সমমনা আরও বেশ কিছু গোষ্ঠী।
বেশ কিছু সময় ধরেই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ইদলিব প্রদেশে শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে এইচটিএস। সেখানে কার্যত তারাই স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকায় রয়েছে। যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে প্রশাসক তাদের বৈধতা আটকে গিয়েছিল।
এছাড়া আরও কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গেও অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে এইচটিএসের।
আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর থেকে এইচটিএস শুধু সিরিয়ায় শাসন তাদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই এগিয়েছে। আইএসের মতো বৃহত্তর খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেনি তারা।
সিরিয়ায় যুদ্ধ কেন?
২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দারা থেকে গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলন শুরু হয়। এই বিক্ষোভের অনুপ্রেরণা ছিল প্রতিবেশী দেশগুলোতে দমনমূলক শাসকদের বিরুদ্ধে চলমান গণঅভ্যুত্থান।
সিরিয়া সরকার এই আন্দোলন দমাতে প্রাণঘাতী পন্থা অবলম্বন করলে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পদত্যাগের দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
অস্থিরতা বাড়তে থাকে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দমনপীড়নও তীব্র হয়। আন্দোলনকারীরা প্রথমে আত্মরক্ষার জন্য, পরে সরকারি বাহিনীকে তাদের এলাকা থেকে তাড়াআতে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। আসাদ এই আন্দোলনকে 'বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাস' বলে আখ্যা দিয়ে দমন করার প্রতিশ্রুতি দেন।
এ সময় শত শত বিদ্রোহী গোষ্ঠী গজিয়ে ওঠে। বিদেশি শক্তিগুলো বিভিন্ন পক্ষকে সমর্থন নিতে শুরু করে। চরমপন্থি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল-কায়েদাও জড়িয়ে পড়ে এই সংঘাতে।
সহিংসতা দ্রুত বেড়ে গিয়ে সিরিয়াকে এক ভয়াবহ পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোও।
এই সংঘাতে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ এখন শরণার্থী অথবা বিদেশে আশ্রয়প্রার্থী।
কীভাবে হলো এই পতন?
গত চার বছর ধরে মনে হচ্ছিল, সিরিয়ার যুদ্ধ কার্যত শেষ।
দেশটির বড় শহরগুলোতে বাশার আল-আসাদের শাসন কার্যত অপ্রতিরোধ্য ছিল। তবে কিছু এলাকা ছিল তখনও তার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
পূর্বাঞ্চলের কুর্দি-অধ্যুষিত এলাকাগুলো সংঘাতের শুরু থেকেই কমবেশি সিরিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।
২০১১ সালে আসাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের সূচনা হওয়া দক্ষিণাঞ্চলে দুর্বলভাবে হলেও কিছু অস্থিরতা অব্যাহত ছিল।
বিস্তৃত সিরিয়ান মরুভূমিতে এখনও নিরাপত্তা হুমকি হয়ে আছে কিছু আইএস ফাঁড়ি।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ইদলিব প্রদেশ দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর দখলে রয়েছে। যুদ্ধের চরম পর্যায়ে এই গোষ্ঠীগুলো এখানে এসে আশ্রয় নেয়।
ইদলিবের প্রভাবশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএসই এবার প্রথমে আলেপ্পো, তারপর হোমস ও সবশেষে দামেস্কে আক্রমণ চালিয়ে দখল নিয়েছে।
ইদলিব দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়া সরকারের জন্য কঠিন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ছিল। সরকারি বাহিনী এই অঞ্চল পুনর্দখলের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও সফল হতে পারেনি।
তবে বাশারের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ২০২০ সালে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে ইদলিবে তুলনামূলক শান্তি বজায় ছিল।
ইদলিবে প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। তাদের বেশিরভাগই সিরিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে এসেছে।
আলেপ্পো ছিল বিদ্রোহীদের জন্য সবচেয়ে রক্তকয়ই যুদ্ধক্ষেত্রে। এ যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় পরাজয়গুলোর একটি হয়।
আসাদ অবশ্য তার সেনাবাহিনীর দুর্বল সরঞ্জাম ও দুর্বল মনোবলের সেনাদের দিয়ে আলেপ্পোতে ওই বিজ অর্জন করেননি। নিয়মিত সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে প্রায়ই অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হতো।
ফলে আসাদ রাশিয়ার শক্তিশালী বিমান হামলা এবং ইরানের সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ইরান মূলত হিজবুল্লাহসহ তাদের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে এই সহায়তা দিত।
তবে সম্প্রতি ইসরায়েল লেবাননে হামলা চালানোর পর হিজবুল্লাহ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি সিরিয়ায় ইরানি সামরিক কমান্ডারদের ওপর ইসরায়েলের হামলা জিহাদি ও ইদলিবের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আলেপ্পোতে আকস্মিক আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে ভূমিকা রাখে।
গত কয়েক মাস ধরে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলার ব্যাপকতা বাড়িয়েছে ইসরায়েল। এসব আক্রমণে তাদের সরবরাহ লাইন ও মিলিশিয়া কার্যক্রম ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে সিরিয়ায় সক্রিয় হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্ক অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এই সুযোগে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আকস্মিকভাবে আলেপ্পোর দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এই পদক্ষেপ আসাদের বাহিনীকে একেবারে দুর্বল অবস্থায় ফেলে দেয়। তার জেরেই একের পর এক শহরের দখল নিয়ে আজ আসাদের পতন ঘটাল এইচটিএস।