‘সারা রাত নিঘুর্ম কেটেছে’: আসাদের পতনের সংবাদ যেভাবে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে
সিরিয়ার দামেস্ক থেকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ পালিয়ে যাওয়ার আগের রাত শহরটির বাসিন্দাদের জন্য ছিল এক চরম উদ্বেগের সময়। আগেই খবর এসেছিল যে, বিদ্রোহীরা তীব্র গতিতে দেশটির রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে। অবশেষে গতকাল (রবিবার) সকালে খবর ছড়িয়ে যায় যে, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়া শাসন করে আসা এই প্রেসিডেন্ট পালিয়ে গেছেন।
অসমর্থিত নানা সূত্র থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা ভিডিওতে দেখা যায়, মানুষজন রাস্তায় নেমে উল্লাস করছে। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের স্বাগত জানাচ্ছেন।
একইসাথে বিদ্রোহী কমান্ডার হাসান আবদুল ঘানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে বলেছেন, "হোমস শহর 'পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন' করা হয়েছে। দামেস্কের সেদনায়া কারাগার থেকে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।"
'হিউম্যানস অব দামেস্কাস' নামের ফেসবুক পেইজে রানিয়া কাতাফ বলেন, "গত রাতে সিরিয়ায় কেউ ঘুমায়নি। এমনকি বিদেশে থাকা সিরিয়ানরাও ঘুমাতে পারেনি। সকলেই ফোন হাতে নিয়ে চূড়ান্ত খবরের অপেক্ষা করছিল।"
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে রানিয়া কাতাফ বলেন, "আমি আনন্দে আত্মহারা ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, গত ১৩ বছর ধরে ডুবন্ত অবস্থায় ছিলাম। এখন সবাই নিশ্বাস নিতে পারছি। আমি জানি আমার চেয়ে বয়সে বড় লোকেরা আরও বেশি কিছুর মধ্যে দিয়ে পার হয়েছেন।
কিছুদিন আগেও রানিয়া কাতাফ নিজের মতামত প্রকাশ করতে ভয় পেতেন। এমনকি সরকারবিরোধী পোস্টে লাইক কিংবা লাভ রিএক্ট দিতেও তিনি শঙ্কিত ছিলেন।
দামেস্কে বসবাসকৃত সাংবাদিক ড্যানি মাক্কি গতকাল (রবিবার) সকালে উমাইয়াদ স্কয়ারে ছিলেন। যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনীর অফিসও রয়েছে।
ড্যানি বলেন, "মানুষজন আকাশে গুলি ছুড়ছিল। লোকেরা নাচছিল, ছবি তুলছিল ও কাঁদছিল।"
"আমি মিলিশিয়াদের সাথে কথা বলেছি। একজন বলেছেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন", যোগ করেন তিনি।
ঐ মিলিশিয়া বলেন, "আমি আলেপ্পোতে আক্রমণে অংশ নেইনি। কিন্তু যখন বিদ্রোহীরা দামেস্কের কাছাকাছি আসতে লাগলো, তখন অস্ত্র তুলে নেই।"
মানুষ উদ্যাপন করলেও তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপত্তাজনিত একটা উদ্বেগ রয়েছে। বিপক্ষ দলগুলির মধ্যে কোনও অন্তর্দ্বন্দ্ব যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করার মতো বিষয়ও রয়েছে।
ঐ মিলিশিয়া বলেন, "আমি যখন গাড়িতে করে দামেস্ক যাচ্ছিলাম তখন আমি সিরিয়ান আর্মিদের সাদা পোশাকে রাস্তায় দেখি। উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে তারা যাত্রা শুরু করেছে।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দামেস্কের এক বাসিন্দা বলেন, "প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার স্বাদ উপলব্ধি করেছি। অনেকটা ২০১১ সালে বিপ্লব যখন শুরু করেছিলেন তখনকার অনুভূতির মতো। এই স্বপ্নের ধারাবাহিকতা তখনই শুরু হয়েছিল।"
দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে ইয়াজান আল আমারি ডেরা নামের একটি ছোট শহরে ফোনের দোকানে ব্যবসা করেন। যে অঞ্চলটি বেসামরিক মিলিশিয়ারা ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
আমারি বিবিসিকে জানান, তিনি আজ উদ্যাপন করতে বন্ধুদের সাথে দামেস্কে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, "আমরা ঘুম থেকে উঠে আসাদের পালিয়ে যাওয়ার সংবাদটা দেখলাম। তখন আমরা বিষয়টা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি। মানুষ গুজবকে খুব ভয় পেত। কিন্তু যখন আমরা বুঝতে পারি এটা আসলেই সত্য, তখনই আমরা আমাদের গাড়ি বের করি। এখন আমরা উদ্যাপন করতে দামেস্ক যাচ্ছি।"
আমারি আরও বলেন, "মানুষের মনে হচ্ছিল তারা স্বপ্নের মধ্যে আছেন। অনেকেই কাঁদছিল। আমরা এতদিন অনেক ভয়ে ছিলাম। বহু বছর পর আজ মন খুলে কথা বলতে পারছি। এখন আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারবো।"
তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো অনেকেই শঙ্কিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লন্ডন প্রবাসী সিরিয়ান জানান, তার পরিবার দেশটির সমুদ্র উপকূলে থাকেন। তিনি বলেন, "আমরা খ্রিষ্টান পরিবার। আমার পরিবারকে হত্যা করা হবে এই শঙ্কায় আমি ভীত। সবাই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। পরিবারের লোকেরা দেশ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।"
লন্ডন প্রবাসী ঐ ব্যক্তি অভিযোগ করেন যে, মানুষ বরং ভয়ের জায়গা থেকে উদ্যাপন করছে। তিনি বলেন, "তারা ভীত হয়ে উদ্যাপন করছে কেননা সেটা না করলে তাদের হত্যা করা হবে। একদিকে আমরা সবাই খুশি যে রেজিমের পতন হয়েছে। অন্যদিকে আমরা জানি না বিকল্প সরকারের পরিণতি কেমন হবে। সর্বোপরি এই বিদ্রোহী দলটি আল-কায়েদার একটি শাখা।"
দেশের বৃহৎ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম অবশ্য আশ্বস্ত করেছেন যে, খ্রিস্টানরা নিরাপদে থাকবেন। তবে এই বক্তব্য কতটুকু পালন করা হয় সেটি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন লন্ডন প্রবাসী ঐ সিরিয়ান।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান