যুদ্ধের কারণে মিয়ানমারের ডাক্তার ও নার্সেরা পতিতাবৃত্তিতে জড়াতে বাধ্য হয়েছেন
সফলভাবে সাত বছর মেডিকেলে পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তার হন 'মে'। পরীক্ষায় পাশের এক মাসের মধ্যেই তিনি একটি চাকরি পান, তবে কিছুদিনের মধ্যেই তার স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে যায়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করে এবং আগে থেকেই মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি এরপর আরও ভেঙে পড়ে।
একদিকে খুব দ্রুতই দেশটিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় এবং অন্যদিকে তার মাসিক বেতন, যা আগে ৪১৫ ডলারের সমান ছিল,পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে।
এছাড়া, তার বাবা কিডনি রোগে ভুগছিলেন। সবমিলিয়ে 'মে' খুব হতাশ হয়ে পড়েন।
এরপর তার পরিচয় হয় 'ডেট গার্লস'-এর সঙ্গে, যেখান থেকে তিনি দ্বিগুণ অর্থ উপার্জনের সুযোগ পান। অর্থের পরিমাণ ছিল খুব লোভনীয়, তবে এ জন্য তাকে এমন কিছু করতে হবে, যা মেনে নেওয়া মোটেও সহজ বা সুখকর কিছু না। কারণ ভিন্ন নামে হলেও, কাজটি ছিল মূলত পতিতাবৃত্তি।
মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পতিতা হিসেবে কাজ করা ২৬ বছর বয়সী 'মে' বলেন, 'এটা মেনে নেওয়া কঠিন, ডাক্তার হওয়ার জন্য এত বছর পড়াশোনা করা সত্ত্বেও আমি এখন শুধু সংসার চালানোর জন্য এ ধরনের কাজ করছি।'
অন্যদের মতো 'মে' তার পুরো নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। কারণ তিনি কীভাবে অর্থ উপার্জন করেন তার পরিবার এখনও তা জানে না এবং মিয়ানমারে পতিতাবৃত্তি অবৈধ।
অভ্যুত্থান ও পরবর্তী গৃহযুদ্ধ মিয়ানমারের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে কারখানাগুলো পঙ্গু হয়ে যাওয়া, অসময়ের বৃষ্টিতে খামারগুলো ডুবে যাওয়া এবং চীন ও থাইল্যান্ড সীমান্তে সংঘাতের কারণে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ায় এ বছর মুদ্রাস্ফীতি ২৬ শতাংশে পৌঁছেছে।
চলতি বছর ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রা কিয়াত-এর মূল্য দুই-পঞ্চমাংশ কমেছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, মিয়ানমারের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।
এই বিপর্যয় মিয়ানমারের ডাক্তার, শিক্ষক, নার্স এবং অন্যান্য শিক্ষিত পেশাজীবী নারীদেরও পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করেছে।
এটা জানা কঠিন কতজন নারী এই পেশায় জড়িত, তবে রাস্তায় এখন অনেক বেশি পতিতাকে দেখা যায়।
সাক্ষাৎকারে ছয়জন নারী, এদের চারজন এখন পতিতাবৃত্তি করছেন এবং দুইজন মানবাধিকার কর্মী বলেছেন, এখন আরও বেশি শিক্ষিত নারী জীবিকা নির্বাহের জন্য পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অভ্যুত্থানের পর বিক্ষোভের পুরোভাগে ছিলেন নারীরা। সেসময় মিয়ানমারের গভীরে প্রোথিত পিতৃতন্ত্রের অবসান নিয়ে আশার আলো দেখা গিয়েছিল।
তবে পতিতাবৃত্তির বৃদ্ধি কয়েক দশক ধরে সামরিক বাহিনীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার নারীদের মর্যাদার ওপর আরেকটি আঘাত।
যেন এই দুর্দশার কোনো শেষ নেই। বিদ্রোহীদের কাছে অনেক এলাকা হারিয়েছে জান্তা বাহিনী, তবে এখনও মিয়ানমারের শহরগুলো তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব শহরে পতিতালয়, কারাওকে বার, নাইটক্লাব ও হোটেলে পতিতাবৃত্তি বেড়েছে।
'জার' মান্দালয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নার্স ছিলেন। এই হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দেওয়ায়, সামরিক সরকার এটি বন্ধ করে দিয়েছিল।
তারপর একজন বন্ধু তাকে টাকা উপার্জনের জন্য একটি প্রস্তাব দিয়েছিল।
তারপর থেকে ২৫ বছর বয়সী এই নারী এই পেশায় রয়েছেন।
তিনি বলেন, এটি এখন আমার অর্থ আয়ের একমাত্র উপায়।
এই হতাশা নারীদের আইন অমান্য করে পতিতাবৃত্তিতে জড়াতে বাধ্য করছে। আইন লঙ্ঘন করায় অনেক সময় পুলিশ তাদের আটক করে।
পুলিশের হাতে আটক অনেককে অনেক সময় ঘুষ দিয়ে মুক্ত করতে হয়।
প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি জনসংখ্যার দেশ মিয়ানমারে সামরিক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
কিন্তু ২০১১ সালে যখন বেসামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর তখন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্য অনুযায়ী, এখন সেই শ্রেণী ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
মান্দালয়ে চিকিৎসক সু বলেন, 'তিনি মধ্যবিত্ত ছিলেন। সিঙ্গাপুর, ভারত ও নেপালে ছুটি কাটাতে গেছেন এবং তার বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই শপিং করতে ও বাইরে খেতে যেতেন।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পর ডিম ও টুথপেস্টের মতো পণ্যের দাম তিনগুণ বেড়ে যায়। দ্রুত তার সঞ্চয় ফুড়িয়ে আসে এবং মাঝে মাঝে তাকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, মিয়ানমারে সাধারণ খাবারের দাম ১৬০ শতাংশ বেড়েছে।
২৮ বছর বয়সী সু জানান, ২০২৩ সালে অবশেষে তিনি এই কাজে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি বলেন, 'আমি একজন শিশু বিশেষজ্ঞ হতে এবং শিশুদের সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অভ্যুত্থান এবং আমার পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতির কারণে আমার আর কোনো উপায় নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি যে জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলাম তা থেকে বর্তমানের জীবন অনেক আলাদা।'
দেশটির অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা সবচেয়ে বেশি খেয়েছেন নারীরা। তারা এমনিতেই তাদের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় কম উপার্জন করে।
২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা নারী কর্মীরা গড়ে প্রায় ৫ ডলার উপার্জন করতে পারেন, যেখানে পুরুষরা একই কাজ করে ৪০ শতাংশ বেশি উপার্জন করতে পারেন।
এছাড়া, নারীদের বেকারত্বের হার পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি।
পোশাক কারখানাগুলো একসময় মিয়ানমারের গ্রামগুলোতে নারীদের লাইফলাইন ছিল এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ১৬ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এগুলোর অনেকগুলোই এখন বন্ধ হয়ে গেছে এবং অভ্যুত্থানের পর এসব কোম্পানিগুলো মিয়ানমার থেকে সরে গেছে।
২৫ বছর বয়সী সিঙ্গেল মা মিয়া বলেন, ২০২১ সালে বিক্ষোভের সময় তার স্বামী সৈন্যদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর
তিনি একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেউ তাকে চাকরি দেয়নি।
তিনি জানান, তিনি মূল্যবান সমস্ত কিছু বিক্রি করেছিলেন এবং অবশেষে তার ৩ বছর বয়সী মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পতিতাবৃত্তির দিকে ঝুঁকেছিলেন।