প্রধান প্রধান অর্থনীতিগুলোর দানে কার্পণ্য, গভীর হচ্ছে বৈশ্বিক ক্ষুধা সংকট
এ যেন সরল অথচ নির্মম এক সমীকরণ—যেখানে ত্রাণের অভাবে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত ও অনাহারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ তাদেরকে সহায়তার জন্য বিশ্বের সম্পদশালী দেশগুলোর দানকৃত অর্থের পরিমাণ কমছে।
ফলস্বরূপ জাতিসংঘ বলছে, আগামী বছর ৩০ কোটির বেশি (৩০৭ মিলিয়ন) মানুষকে মানবিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন – কিন্তু, দাতাদের থেকে সংগ্রহ করা তহবিল দিয়ে এর মধ্যে কেবল ৬০ শতাংশ মানুষকে সাহায্য করা যাবে। অর্থাৎ, আগামী বছর জাতিসংঘের খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি সহায়তা পাবে না অন্তত ১১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ।
চলতি বছরে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য ৪ হাজার ৯৬০ কোটি মার্কিন ডলার তহবিল সংগ্রহ করতে চেয়েছিল জাতিসংঘ, কিন্তু তার মাত্র ৪৬ শতাংশ সংগ্রহ নিয়েই এবছর শেষ হচ্ছে। বিশ্বসংস্থাটির নিজস্ব তথ্যেই এমন চিত্র উঠে এসেছে। এনিয়ে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো জাতিসংঘ যা চেয়েছিল–তার অর্ধেকেরও কম তহবিল পেল। তহবিলের এই সংকটে বিপাকে পড়েছে মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো; ফলে তাদের ক্ষুধার্তদের জন্য খাদ্য রেশন হ্রাস করতে হচ্ছে, একইসঙ্গে সহায়তার আওতায় আসা মানুষের সংখ্যাও কমানোর মতো নির্দয় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
যুদ্ধ, সংঘাত, বা রাজনৈতিক সংকট–বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে তীব্র খাদ্য সংকট থেকে শুরু করে দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশও, যেখানে মূল খাদ্যদ্রব্য বিতরণকারী এখন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। সংস্থাটি ৬০ লাখ সিরিয়াকে খাদ্য সহায়তা দিত। তবে চলতি বছরের শুরুতে তহবিল সংগ্রহ করা যাবে না এমন পূর্বাভাস পেয়েছিল সংস্থাটি, তাই ত্রাণ সহায়তার আওতা থেকে ১০ লাখ মানুষকে বাদ দিতে হয়েছে বলে জানান ডব্লিউএফপির অংশীদারত্ব ও সম্পদ সংগ্রহ বিষয়ক সহকারী নির্বাহী পরিচালক রানিয়া দাগাশ কামারা।
এ বছরের মার্চে সিরিয়া সফরে গিয়ে ডব্লিউএফপির কর্মীদের ত্রাণ কার্যক্রম সরেজমিনে দেখেন রানিয়া দাগেশ। সেসময় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "তাঁদের অভিযোগ ছিল, আমাদের এমন অবস্থা যে ক্ষুধার্তের খাদ্য নিয়ে সম্পূর্ণ অনাহারে থাকা মানুষকে দিতে হচ্ছে।" অর্থাৎ, যে পরিমাণ খাদ্য সংস্থাটি বরাদ্দ দিতে পারছে তা সব ক্ষুধার্ত মানুষকে সহায়তার জন্য একেবারেই অপ্রতুল। তাই বাধ্য হয়ে সবচেয়ে দুর্গত মানুষকে সহায়তা দিতে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী সংঘাত, হানাহানি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জলবায়ু সংকটের তীব্র অবনতি সব যেন একসঙ্গে দেখা দিচ্ছে। এর যেকোনো একটিই কোনো দেশ বা অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের কারণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এর মধ্যে বহুমুখী সংকট একসাথে মোকাবিলা করতে হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোকে। বর্তমান পরিস্থিতির বরাত দিয়ে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা ও জরুরি ত্রাণ সমন্বয় বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি টম ফ্লেচার বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, "ত্রাণের সবচেয়ে বেশি দরকার যাদের–কেবল তাদের জন্যেই সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানাতে আমাদের বাধ্য করা হয়েছে।"
এদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ডানপন্থীদের ক্ষমতায় উত্থান, নিজস্ব আর্থিক চাপ—ইত্যাদি কারণে প্রভাবিত হচ্ছে ধনী দেশগুলোর অনুদানের সিদ্ধান্ত। কতোটা অনুদান দেওয়া হবে বা কোনখানে তা দেওয়া হবে–এনিয়ে তারা বাছবিচার করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ দাতা দেশ জার্মানি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক – উভয় সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায়, বাজেটের সার্বিক চাপ কমানোর অংশ হিসেবে মানবিক অনুদানও কমিয়েছে জার্মানি। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যেই তা ৫০ কোটি ডলার কমানো হয়। ২০২৫ সালে মানবিক অনুদানের পরিমাণ আরও ১০০ কোটি ডলার কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে দেশটির মন্ত্রিসভা। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জার্মানিতে জাতীয় নির্বাচন, এরপরেই নবনির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যরা নতুন ব্যয় পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, আগামী বছরের জানুয়ারিতে তিনি শপথ নেবেন। দায়িত্বগ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক সহায়তার বিষয়ে ট্রাম্প ব্যাপক কাটছাঁট করতে পারেন এমন আশঙ্কা রয়েছে। সেই আশঙ্কা নিয়েই ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নেন–তা দেখার অপেক্ষায় আছে মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো।
মানবিক ত্রাণ সহায়তার বিষয়ে ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নেবেন–তা এখনও জানাননি তার উপদেষ্টারা। তবে ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক সহায়তা হ্রাস করতে চেয়েছিলেন। ট্রাম্প এরমধ্যেই এমন কিছু উপদেষ্টাকে বেঁছে নিয়েছেন–যারা বলছেন, বৈদেশিক ত্রাণ সহায়তা কমানোর সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র। গত পাঁচ বছরে মানবিক ত্রাণ সহায়তায় দেশটি দিয়েছে ৬ হাজার ৪৫০ কোটি ডলার, যা জাতিসংঘের পাওয়া এ ধরনের মোট সহায়তার প্রায় ৩৮ শতাংশ।
বেশিরভাগ মানবিক ত্রাণ সহায়তা দেয় মাত্র তিনটি দাতা—যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইউরোপীয় কমিশন। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বৈশ্বিক সংকটগুলো মোকাবিলায় জাতিসংঘ যেসব আহ্বান জানায়, তাতে সাড়া দিয়ে তারা মোট ১৭০ বিলিয়ন ডলার বা ৫৮ শতাংশই দিয়েছিল।
তবে বিশ্ব অর্থনীতির অপর তিন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি – চীন, রাশিয়া ও ভারত – একইসময়ে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা তহবিলের মাত্র ১ শতাংশ দিয়েছে। জাতিসংঘের অনুদানের তথ্যসূত্রে তা জানায় রয়টার্স।
এসব দেশ, বিশেষত চীন ও ভারত–বিপুল বিনিয়োগ পায়। সম্পদও বাড়ছে তাদের। তবু মানবিক সহায়তার বেলায় তারা কার্পণ্য করছে। যেকারণে ক্ষুধার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াই কঠিন হয়ে পড়ছে, দুর্ভিক্ষ এড়ানোর চেষ্টাও অসম্ভব হয়ে উঠছে।
বিশ্বের প্রায় ৫৯টি দেশ ও অঞ্চলের ২৮ কোটি ২০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে ছিল ২০২৩ সালে। সুদান, মিয়ানমার ও আফগানিস্তানে এমন খাদ্য সংকট নিরসনে ত্রাণের অভাবের সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় এসেছে। তবু দাতাদের টনক নড়েনি। তাছাড়া, ভারত ও চীনের মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর ত্রাণ সহায়তায় কার্পণ্য নিয়ে নাখোশ ট্রাম্পও। এনিয়ে তিনি নানান সময়ে অভিযোগ করেছেন। ট্রাম্পের সমর্থকরা 'প্রজেক্ট ২০২৫' নামের একটি উদ্যোগ নিয়েছেন, যেখানে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য বিভিন্ন নীতির প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দাতা দেশের থেকে ত্রাণ সংগ্রহ বাড়াতেও মানবিক সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানানোর কথা বলা হয়েছে। এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদানের শর্ত হিসেবে রাখতে ট্রাম্পকে পরামর্শ দিয়েছে 'প্রজেক্ট ২০২৫'।