একা একা আর নয়; ডেটিং, বিয়ে ও সন্তান জন্মদানে ‘সিঙ্গেলদের’ যেভাবে উৎসাহ দিচ্ছে চীন
জন্মহার কমায়, নতুন মুখে অভাবে ভুগছে চীন। বয়স্ক জনসংখ্যা বাড়ার এক সংকটের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ এই অর্থনীতি। তাই যারা এখনো জীবনসঙ্গী বেঁছে নেননি, তাঁদের ডেটিং, বিয়ে ও সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করতে দেশজুড়ে প্রচারণাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে চীনের কর্তৃপক্ষ।
এরমধ্যেই চীনের স্থানীয় সরকারগুলো বিবাহিত নারীদের তাঁদের সন্তান জন্মদানের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাতে বলছে, এবং দম্পতিদের একের অধিক সন্তান নিতে উৎসাহ দিতে নগদ অর্থও দিচ্ছে।
'সিঙ্গেল' শিক্ষার্থীদের জন্য কথিত লাভ কোর্স চালু করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবার সন্তানের বাবা-মা হলে রাষ্ট্রের দেওয়া নানা্ন সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করেও নিয়মিত প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত দৈনিকগুলোতে।
চীনে এরমধ্যেই জন্মহারের চেয়ে বেড়ে গেছে মৃত্যুর হার। ভবিষ্যতে নতুন কর্মীর সংখ্যা নিয়ে তাই উদ্বেগ বেড়েই চলেছে, বুড়িয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর চাপ অর্থনীতির চাকাতেও জং ধরাবে এমন শঙ্কাও উঁকি দিচ্ছে। তাই জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবেই– চীনের স্থানীয় বা প্রাদেশিক সরকারগুলোর ওপর চাপ রয়েছে জন্মহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনবহুল দেশের এই সংকট ভবিষ্যতে বহুমাত্রিক রূপ নিতে পারে। স্থানীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চীনের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেন জেপিং বলেন, "চীনের জনসংখ্যায় তিনটি বড় প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এগুলো হলো: বুড়িয়ে যাওয়া, নিম্ন জন্মহার ও নিম্ন বিয়ের হার। অর্থাৎ, শিশুর সংখ্যা এখন কম, আর বয়স্কদের সংখ্যা বাড়তি। এত দ্রুত গতিতে ও ব্যাপকভাবে– চীনের জনসংখ্যার বুড়িয়ে যাওয়ার এই ঘটনা নজিরবিহীন।"
এই অবস্থায়, সন্তান লালনপালনে উৎসাহ দিতে নেওয়া হয়েছে প্রণোদনার উদ্যোগ। সন্তান প্রতিপালনের খরচের চাপ কমাতে দম্পতিদের জন্য কর হ্রাস ও ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেইজিং। দ্য স্টেট কাউন্সিল হিসেবে পরিচিত চীনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গত অক্টোবরে 'জন্মদান-বান্ধব সমাজ' তৈরির এক খসড়া পরিকল্পনা তৈরির কথা জানিয়েছে। চীনের মন্থর হয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকার যে বিপুল অংকের প্রণোদনা প্যাকেজের উদ্যোগ নিয়েছে– তার অধীনে এই উদ্যোগের মাধ্যমেও সামাজিক সহায়তা থাকবে। বর্তমানে পরিকল্পনাটির নানা খুঁটিনাটি দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কেন্দ্র সরকারের এই তোড়জোরের মধ্যে স্থানীয় সরকারগুলোর কর্মকর্তাদের ফোনকল পাচ্ছেন ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা বিবাহিত নারীরা। তাঁদের কাছে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে। বিষয়টি তুলে ধরে সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ পোস্টও করেছেন। কয়েকজনের সাথে কথা বলেও এবিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।
বিবাহিত এই নারীদের কাউকে কাউকে তাঁরা গর্ভধারণের উপযুক্ত কিনা সেজন্য শারীরিক পরীক্ষা করাতে বলা হয়েছিল। একের অধিক সন্তান নিলে নানা রকম ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাবও পান কেউ কেউ। কারণ, চীনে জনসংখ্যা প্রতিস্থাপন হারে পৌঁছাতে হলে দম্পতিদের ২.১ এ অনুপাতে সন্তান নিতে হবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে ঝেঝিয়াংয়ের এক বাসিন্দা এফটিকে জানান, কর্মকর্তারা দ্বিতীয় সন্তান নিলে এক লাখ ইউয়ান (বা ১৪ হাজার ডলার) দেওয়ার প্রস্তাব দেন তাঁর এলাকার এক নারীকে। তিনি বলেন, 'এবিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট কোনো নীতি নেই, তবে আপনি যদি ভর্তুকি পেতে চান– তাহলে সহজেই তাঁর বন্দোবস্ত করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে – সন্তান লালনপালনের জন্য ভর্তুকি নির্ধারণ করছে স্থানীয় সরকারগুলো।'
শিশু জন্মদানের নানা সুবিধার কথা তুলে ধরে গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি চলছে ব্যক্তি-পর্যায়ে এই ধরনের তদ্বির। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র -পিপলস ডেইলি ও লাইফ টাইমসে কিছু স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মন্তব্য তুলে ধরা হয়, যারা দাবি করেন যে সন্তান জন্ম দেওয়া মায়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, এমনকী ক্যান্সারসহ কিছু রোগ প্রতিরোধেও তা সহায়তা করে।
এবছরের ডিসেম্বরে আরেক কদম এগিয়েছে এই উদ্যোগ। চীন সরকার কেউ 'সিঙ্গেল' থাকুক তা চাইছে না। এমনকী সঙ্গীহীন শিক্ষার্থীদের জুটি বাধার উৎসাহ দিতে 'বিয়ে ও প্রেম শিক্ষা কোর্স' চালু করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের এক নিবন্ধে।
এতে বলা হয়, 'শিক্ষার্থীদের প্রেমে পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থান' তবে পড়াশোনার চাপ বেশি হওয়ায় ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই কোনো সম্পর্কে জড়াতে চান না বলে এক জরিপে উঠে এসেছে। এই অবস্থায়, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রেম-ভালোবাসার তাত্ত্বিক শিক্ষা ও বাস্তব জীবনের প্রেমের ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ-সহকারে কোর্স চালু করা যায়। এতে 'বিয়ে ও ভালোবাসা সম্পর্কে নিয়মতান্ত্রিক জ্ঞান' বাড়বে বলেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।