ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার আগেই বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফিরতে বলল যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ জানুয়ারির শপথ গ্রহণ সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদেশি শিক্ষার্থীদের ছুটি সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত দেশে ফিরে আসার পরামর্শ দিচ্ছে।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবছরে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ লাখের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। এরই মধ্যে ট্রাম্প কঠোর অভিবাসন নীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের ওপর আগের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়ানোর এবং "যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ও ইহুদি-বিরোধী বিদেশি" শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের পরিকল্পনা করেছেন।
বিদেশি শিক্ষার্থীরা সাধারণত নন ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় [অভিবাসী নয়, এমন ভিসা] যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেন। তবে এই ভিসা তাদের সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য বৈধতা দেয় না। ট্রাম্পের এই নীতির ফলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ বছর নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করা ভারতের প্রমথ প্রতাপ মিশ্র এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, "আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সময়টা ভয়ানক।" উল্লেখ্য, গত শিক্ষাবর্ষে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ২৭ হাজারের বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ।
নিউ ইয়র্ক থেকে শুরু করে ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীরা শীতকালীন ছুটির আগে পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটতে পারে এবং কেউ কেউ পড়াশোনা শেষ করতে পারবে না বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদেশি শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ভ্রমণ স্থগিত রাখতে বা সংক্ষিপ্ত করার পরামর্শ দিয়েছে। করনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল লার্নিং অফিস থেকে জানানো হয়েছে, বিদেশে ভ্রমণে যাওয়া শিক্ষার্থীরা যেন ২১ জানুয়ারির আগে ক্যাম্পাসে ফিরে আসে। যেকোনো ভ্রমণ পরিকল্পনা সংশোধনের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য বিলম্বের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
গত মাসের শেষ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, " (ট্রাম্পের) শপথ গ্রহণের পরপরই একটি ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে পারে।"
সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞায় ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে– কিরগিজস্তান, নাইজেরিয়া, মিয়ানমার, সুদান, তানজানিয়া, ইরান, লিবিয়া, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইয়েমেন এবং সোমালিয়ার মতো দেশগুলো। এর সঙ্গে চীন ও ভারতসহ নতুন দেশও যুক্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াতে (ইউএসসি) গত শিক্ষাবর্ষে ১৭ হাজারের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের একটি ইমেইলে জানিয়েছে, শপথের এক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসতে।
প্রশাসন বলেছে, "এক বা একাধিক নির্বাহী আদেশ ভ্রমণ এবং ভিসা প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে।" ক্যালিফোর্নিয়ায় সর্বাধিক সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বর্তমানে ইউএসসি-তে পড়াশোনা করছেন।
যেসব শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন, বিশেষত যেসব দেশ যুদ্ধ, অস্থিরতা বা কঠোর অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে, তাদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞার ভয় অনেক বেশি। সংশ্লিষ্ট দেশের শিক্ষার্থীরা এখন ভ্রমণ পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগ দিচ্ছেন।
ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার আন্তর্জাতিক পরিষেবা বিভাগ বলেছে, "যদি এমন আদেশ জারি হয়, তবে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ এড়ানোর নিরাপদ উপায় হলো ২০২৫-এর ১৩ জানুয়ারির আগে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা।"
ট্রাম্পের "গণ নির্বাসন" পরিকল্পনা শুধু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে নয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শঙ্কা তৈরি করছে। তবে তিনি বলেছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ থেকে স্নাতক করবে, তাদের "স্বয়ংক্রিয়ভাবে" গ্রিন কার্ড দেওয়া হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বহু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেতে পারে।
তবে জুন মাসে এক প্রচারণার মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, এটি শুধু "সর্বাধিক দক্ষ স্নাতকদের" জন্য প্রযোজ্য হবে এবং "কমিউনিস্ট, চরমপন্থি, আমেরিকা বিরোধী এবং যারা সরকারি সাহায্য চান" তাদের বাদ দেওয়া হবে। ট্রাম্প এরপর আর এই বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলেস-এর (ইউসিএলএ) অভিবাসন আইন কেন্দ্র শিক্ষার্থীদের জানিয়েছে, "বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বিচার বিভাগীয় পরোয়ানা বা আইনগত প্রয়োজন ছাড়া অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করবে না।" এছাড়া, "ক্যাম্পাস পুলিশ সাধারণত ফেডারেল অভিবাসন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যৌথ কার্যক্রমে অংশ নেয় না।"
'আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই অনিশ্চিত'
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ হয়। এ সময় ট্রাম্প ঘোষণা করেন, "উগ্র মার্কিন-বিরোধী এবং ইহুদি-বিরোধী" বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করে তাদের দেশে ফেরত পাঠাবেন। তিনি "প্রো-প্যালেস্টাইন" বিক্ষোভের সমালোচনা করেন এবং "প্রো-জিহাদি বিক্ষোভ" বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন।
ট্রাম্প মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা পুনরায় চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। আগের নিষেধাজ্ঞায় ইরান, লিবিয়া, ইরাক, সুদান, সোমালিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেন অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে তা কিছু আফ্রিকান দেশেও বাড়ানো হয়। বাইডেন ২০২১ সালে ক্ষমতায় এসে এই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করেন।
ট্রাম্প আরও বলেন, "সব অভিবাসীদের কঠোর আদর্শিক যাচাই" করবেন এবং "বিপজ্জনক পাগল, বিদ্বেষী, কুসংস্কারী ও উন্মাদদের" যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বন্ধ করবেন।
তবে ট্রাম্প "প্রজেক্ট ২০২৫" পরিকল্পনা থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। এই পরিকল্পনা ফেডারেল ইমিগ্রেশন অভিযান চালাতে "সংবেদনশীল এলাকা" যেমন স্কুল ও ক্যাম্পাসের সুরক্ষার অবসান ঘটানোর প্রস্তাব দেয়।
ব্রাজিলের সাংবাদিকতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থী গ্যাব্রিয়েল বলেন, "আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই অনিশ্চিত।" তিনি বলেন, "আমি মুসলিমপ্রধান দেশ বা চীন থেকে আসিনি, তাই অন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মতো এতটা বিপদে নেই। তবে ট্রাম্পের 'আদর্শিক যাচাই' নিয়ে আমি চিন্তিত।"
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করে বলেছে, "আমরা অভিবাসন সংক্রান্ত যেকোনো প্রস্তাব বা পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছি, যা আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।"
'সেমিস্টার শুরুর আগে সময় পরিকল্পনা করুন'
নিউ ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কঠোর অভিবাসন নীতির আশঙ্কায় শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিদেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মীদের নতুন প্রশাসনের কার্যক্রম শুরুর আগেই ক্যাম্পাসে ফেরার পরামর্শ দিয়েছে।
এমআইটি শিক্ষার্থীদের গুজব বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নিতে বলেছে।
"পড়াশোনা, গবেষণা ও কাজের" ন্যূনতম ব্যাঘাত যাতে না ঘটে, সেজন্য ৬ জানুয়ারিরের মধ্যে ক্যাম্পাসে ফেরার সুপারিশ করেছে নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অফিস বিদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের পরামর্শ দিয়েছে, "সেমিস্টার শুরুর আগে, জানুয়ারির মার্টিন লুথার কিং ছুটির আগে সময় পরিকল্পনা করুন," যাতে কোনো ব্যাঘাত বা দেরি এড়িয়ে চলা যায়।
ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আমেরিকান পলিসির নির্বাহী পরিচালক স্টুয়ার্ট অ্যান্ডারসন বলেছেন, "দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসনে কী হতে পারে, তা অনুমান করতে প্রথম প্রশাসনের নীতি দেখাই যথেষ্ট। সেই সময় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রবেশ সীমিত করার চেষ্টা দেখা গেছে।"