৩০ বছর আগে ২০২৫ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল টিভি প্রোগ্রাম টুমরোস ওয়ার্ল্ড, কতটুকু সত্য হলো?
মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরেকটি বছর, বিদায় জানাল ২০২৪। নতুন আশায়, নতুন স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববাসী স্বাগত জানিয়েছে ২০২৫ সালকে।
নতুন বছরের প্রথম দিনে, যখন বিশ্ব নতুন সম্ভাবনা এবং পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তখন ফিরে দেখা যাক ৩০ বছর আগে টুমরো'স ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামের ভবিষ্যদ্বাণীকে। ১৯৯৫ সালে, বিবিসির এই টেলিভিশন প্রোগ্রাম ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বড় পরিবর্তনের আশা প্রকাশ করেছিল, এবং তাদের অনুমান ছিল ২০২৫ সালের পৃথিবীটি হবে একদম ভিন্ন।
এখন, এই নতুন বছরের সূচনায়, প্রশ্ন উঠছে—টুমরো'স ওয়ার্ল্ডের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো কতটুকু সত্যি হয়েছে? পৃথিবী সত্যিই কি সেই ভাবে বদলে গেছে, যেমনটি তারা ৩০ বছর আগে অনুমান করেছিল?
সাইবার স্পেস দাঙ্গা
১৯৯৫ সালে, যখন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছিল, টুমরো'স ওয়ার্ল্ড ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে এটি বড় বিপদ ডেকে আনবে। তারা বলেছিল যে ২০০০ সালের মধ্যে বড় বড় ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকগুলো ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেবে, একটি 'সুপারনেট' তৈরি করবে এবং এর প্রবেশাধিকার সীমিত করবে। এর ফলে হ্যাকিং, ভাইরাস এবং এমনকি দাঙ্গাও হতে পারে।
ফলাফল: বড় ধরনের দাঙ্গা না হলেও ইন্টারনেট এখনও অনেকাংশে উন্মুক্ত রয়েছে। তবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, হ্যাকারদের কর্মকাণ্ড অনেক মানুষের জন্য দুর্ভোগ ডেকে এনেছে।
অ্যাস্টেরয়েড মাইনিং ও স্পেস জাঙ্ক জেল
টুমরো'স ওয়ার্ল্ড ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে মহাকাশে খনন একটি লাভজনক শিল্পে পরিণত হবে, যেখানে কোম্পানিগুলো পৃথিবীর কাছে থাকা অ্যাস্টেরয়েড থেকে মূল্যবান ধাতু উত্তোলন করবে।
এছাড়া, তারা বলেছিল যে স্পেস জাঙ্ক (মহাকাশের আবর্জনা) এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে যে মহাকাশযাত্রীদের জন্য এটি বিপদজনক হয়ে উঠবে। এর সমাধান হবে একটি বিশাল ফোম জেল।
ফলাফল: স্পেস জাঙ্ক এখনো একটি বড় সমস্যা, তবে সেই 'ফোম জেল' আজও বাস্তবে রূপ নেয়নি। মহাকাশের খননও এখনো একটি শিল্পে পরিণত হয়নি, তবে ভবিষ্যতে এটি সম্ভব হতে পারে।
সুপার সার্জন এবং রোবট
টুমরো'স ওয়ার্ল্ড ২০০৪ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে একটি আইন পাস হবে, যার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের হাসপাতালগুলো সার্জনদের সফলতার হার প্রকাশ করবে। সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ভালো সার্জনরা এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়বেন যে তাদের রোগীদের কাছে যাওয়া লাগবে না। এর বদলে, রোগীদের হোলোগ্রাম সার্জনের কাছে পাঠানো হবে, এবং সার্জন "স্প্যাশিয়াল গ্লোভস" দিয়ে অপারেশন করবেন। রোগীর কাছে, একটি রোবট সার্জনের সব কাজ ঠিক মতো করে দেখাবে।
ফলাফল: তারা পুরোপুরি ঠিক বলেনি, তবে এখনো রোবট সার্জারিতে সহায়তা করছে। দূরবর্তী সার্জারির ধারণা এখনও এগিয়ে যাচ্ছে, তবে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
ভাসমান মাথাসহ স্মার্ট স্পিকার
প্রোগ্রামে দেখা যায়, ভবিষ্যত সময়ে এক পুরুষ, তার স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে লন্ডনের মতো আধুনিক শহরে বাস করছে। পুরুষ ব্যক্তিটির মাথায় একটি ভিআর (ভার্চুয়াল রিয়েলিটি) হেডসেট ।
এক পর্যায়ে, একটি নারীর ভাসমান মাথা 'স্মার্ট স্পিকার' থেকে বের হয়ে তাকে জানায়, তার 'ইন্দো ডিজনি' ছুটির এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এরপর, তিনি তাকে 'বেঙ্গালুরু' যাওয়ার পরামর্শ দেন, যেখানে পৌঁছাতে মাত্র ৪০ মিনিট লাগবে।
ফলাফল: যদিও অত্যন্ত দ্রুত যাতায়াত এখনও সম্ভব হয়নি, তবে হোলোগ্রাম, স্মার্ট স্পিকার এবং ভিআর হেডসেট এখন বাস্তব।
মাইক্রোচিপ দিয়ে ব্যাংকিং
প্রোগ্রামে ভবিষ্যতের ব্যাংকিং ব্যবস্থার একটি দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। একজন নারী ব্যাংকে গিয়ে অভিযোগ করেন যে এখানে কোনো মানুষ নেই, এবং এরপর ১০০ 'ইউরো মার্ক' তুলে নেন। ব্যাংকটি তার হাতের মাইক্রোচিপ স্ক্যান করে তাকে টাকা দেয়।
ফলাফল: ব্যাংকিং আজকাল অনেক বেশি স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে। যদিও মানুষের শরীরে মাইক্রোচিপ ব্যবহার করে পেমেন্ট করা সম্ভব হয়েছে, তবে অন্যান্য প্রযুক্তি, বিশেষ করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং ফেস স্ক্যানিং অনেক বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্মৃতিচারণ
গার্ডেনার্স' ওয়ার্ল্ডের পরিচিত উপস্থাপক মন্টি ডন ৩০ বছর আগে টুমরো'স ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামের এক পর্বে অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বহুতল কৃষি সুবিধার মাধ্যমে ব্রিটেনের বনাঞ্চল পুনর্গঠন হবে এবং বাদামী ভাল্লুকের মতো নানা প্রাণী ফিরবে।
এখন, সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ছিল অত্যন্ত আশাবাদী এবং কিছুটা অবাস্তব। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, আজকের তরুণরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি অনেক বেশি সচেতন, এবং ২০৫৫ সালের মধ্যে মানুষ আরও বেশি নিজেদের খাদ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করবে।
তিনি আরও জানান, টুমরো'স ওয়ার্ল্ড পৃথিবীকে মানুষ নিজের ক্ষমতা দিয়ে উন্নত করার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, কিন্তু আমরা এখন বুঝতে পারছি যে, মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে কাজ না করে, মাঝে মাঝে সেটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আরেক উপস্থাপক ভিভিয়ান প্যারি চিকিৎসা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'আমার মুখে আঠা দিয়ে চশমা লাগানো হয়েছিল, আর গরমের কারণে তা গলে গিয়ে আমার মুখে পড়ছিল, আমি নড়াচড়া করতে পারছিলাম না।
ভিভিয়ান ২০১৩ সাল থেকে জেনোমিকস ইংল্যান্ড এর সঙ্গে যুক্ত আছেন, এবং তিনি বলেন, ১৯৯৫ সালে করা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী, বিশেষ করে জেনেটিক সিকোয়েন্সিং, এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে তিনি একটি গবেষণা প্রকল্পে কাজ করছেন, যা জেনেটিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় সাহায্য করবে।
২০৫৫-এ পৃথিবী কেমন হবে?
ফিউচারিস্ট ট্রেসি ফলোজ মনে করেন ১৯৯৫ সালের টুমরো'স ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম অনেক কিছু সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, তবে তারা দুটি বড় বিষয় মিস করেছিল- বড় প্রযুক্তির বিস্তার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
তিনি বিশ্বাস করেন, ২০৫৫ সালের মধ্যে অনেক মানুষ প্রযুক্তি ও মস্তিষ্কের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকবে। এর ফলে, আমরা চিন্তা করে একে অপরের সাথে ধারণা শেয়ার করতে পারব।
টম চিজরাইট মনে করেন পরবর্তী ৩০ বছরে মেটিরিয়াল সায়েন্স এবং বায়োইঞ্জিনিয়ারিং সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রযুক্তি হবে। মেটিরিয়াল সায়েন্সের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী ও হালকা ডিভাইস তৈরি করা সম্ভব হবে, যা বিশ্ব পরিবর্তন করতে পারে। বায়োইঞ্জিনিয়ারিং, যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, চিকিৎসা এবং পৃথিবীর বড় সমস্যা যেমন পরিবেশ দূষণ, পরিস্কার পানি ও খাদ্য উৎপাদনের উন্নতি করতে পারে।
তাহলে, আপনি কী মনে করেন, আগামী ৩০ বছরে পৃথিবী কেমন হবে?
আপনার যাই উত্তর হোক, প্রফেসর স্টিফেন হকিংয়ের কথা মনে রাখা ভালো, যেটি তিনি ৩০ বছর আগে টুমরো'স ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামে বলেছিলেন:
'এই পরিবর্তনগুলোর কিছু খুব আকর্ষণীয়, আর কিছু ভয়াবহ হতে পারে। একটাই নিশ্চিত, পৃথিবী অনেক বদলে যাবে, এবং হয়তো আমরা যা আশা করছি তা হবে না।'