৫ দিনে থ্রেডস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ মিলিয়নের উপরে, চ্যাটজিপিটিকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে!
মার্কিন সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি টুইটার বছরের পর বছর না হলেও অন্তত মাসের পর মাস ধরে অব্যবস্থাপনা, কর্মী ছাঁটাই, সেবাদানে বিঘ্ন এবং শীর্ষ বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে প্রত্যাখানের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপ, মেটার থ্রেডসই টুইটারের জন্য সবচেয়ে বড় অঘটন হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গ সোমবার (১০ জুলাই) জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহে থ্রেডস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। চালু হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে এই অ্যাপটি ব্যাপক সাড়া পেয়েছে নেটিজেনদের কাছ থেকে। অন্য যেকোনো সোশ্যাল নেটওয়ার্কের তুলনায় সবচেয়ে দ্রুত এত বেশি ইউজারকে আকৃষ্ট করতে পারাটা থ্রেডস এর এক বিস্ময়কর কীর্তিই বলা যায়। এই গতিতে এগিয়ে গেলে খুব দ্রুত এই প্ল্যাটফর্মটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা টুইটারের অডিয়েন্সকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
থ্রেডস লঞ্চ হওয়ার পর থেকেই একের পর এক রেকর্ড গড়ে চলেছে। চালু হওয়ার মাত্র পাঁচদিনের মধ্যে ১০০ মিলিয়নের বেশি সাইন-আপ হওয়ায় এটি দ্রুত-বর্ধনশীল অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চ্যাটজিপিটিকেও পেছনে ফেলেছে। ইউবিএস স্টাডি অনুযায়ী, ওপেনএআই'র মালিকানাধীন চ্যাটজিপিটি লঞ্চ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে এই রেকর্ড গড়েছিল গত জানুয়ারিতে। কিন্তু জাকারবার্গের থ্রেডস সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
এদিকে গত কয়েকদিনের মধ্যে টুইটার ব্যবহারের মাত্রা হ্রাস পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক ইন্টারনেট ট্রাফিক বিশ্লেষক। মেটা যে টুইটারের ব্যবসার ওপর হুমকি তৈরি করেছে যা এই ফলাফল দেখে বোঝা যায় এবং টুইটার এই ক্ষতি রোধ করবে কিভাবে বা আদৌ রোধ করতে পারবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ইন্টারনেট ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানি ক্লাউডফ্লেয়ার এবং ওয়েব অ্যানালিটিকস প্রতিষ্ঠান সিমিলারওয়েব এর ডেটা অনুযায়ী, গত কয়েক মাস ধরেই টুইটার ট্রাফিক ছিল নিম্নগামী। কিন্তু সম্প্রতি কয়েকদিনে তা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে উভয় প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে বোঝা যায় যে থ্রেডসের প্রতি লোকজনের বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং গণহারে ইউজাররা ইলন মাস্কের টুইটার ছেড়ে জাকারবার্গ পরিচালিত প্ল্যাটফর্মটিতে সাইন-আপ করছেন।
এ বিষয়ে টুইটার তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
রবিবার ক্লাউডফ্লেয়ার এর সিইও ম্যাথিউ প্রিন্স একটি চার্ট শেয়ার করেন যেখানে তাদের ট্র্যাক করা অন্যান্য ওয়েবসাইটের সাথে টুইটারের জনপ্রিয়তার তুলনা দেখানো হয়েছে। প্রিন্স এই চার্টটি পোস্ট করে বলেন, 'টুইটারের ট্রাফিক কমে যাচ্ছে।'
চার্টে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এই তালিকায় টুইটারের অবস্থান ছিল ৩২তম এবং পরের মাসে তা ৩৪তম অবস্থানে নেমে আসে। বসন্তের অনেকটা সময়জুড়েই টুইটারের অবস্থান ৩৫তম ও ৩৭তম'র মধ্যে ওঠানামা করেছে। কিন্তু জুলাইয়ের শুরুর দিকে টুইটারের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমতে থাকে এবং এটি ৪০তম অবস্থানে নেমে যায়।
সিমিলারওয়েব সোমবার সিএনএনকে জানায় যে তারা টুইটার ট্রাফিকে 'কম্পেয়ারেবল ট্রেন্ড' লক্ষ্য করেছে।
"থ্রেডস সহজলভ্য হওয়ার প্রথম দুই দিন, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে টুইটারে ওয়েব ট্রাফিক এর আগের সপ্তাহের একই সময়ের তুলনায় ৫% কম ছিল এবং ২০২২ সালের ৬ ও ৭ জুলাইয়ের তুলনায় ১১% কম ছিল", বলেন সিমিলারওয়েব এর একজন সিনিয়র ইনসাইটস ম্যানেজার ডেভিড কার।
তিনি আরও বলেন, "আমরা কিছুদিন ধরেই রিপোর্ট করছি যে গত বছরের তুলনায় টুইটারের জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছে- জুন মাসে ট্রাফিক ছিল ৪% কম- কিন্তু থ্রেডসের আগমন মনে হচ্ছে টুইটারের জন্য আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।"
স্ট্যানফোর্ড ইন্টারনেট অবজারভেটরি'র পরিচালক অ্যালেক্স স্টামোস গেল শনিবার বলেন, তিনি একই পোস্ট টুইটার, থ্রেডস এবং মাস্টোডনে অডিয়েন্সের সঙ্গে শেয়ার করার ২৩ ঘণ্টার মধ্যে সেগুলো কোন প্ল্যাটফর্মে কেমন পারফর্ম করেছে তার একটি 'অবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা' চালিয়েছেন।
স্টামোস যে কন্টেন্ট উল্লিখিত প্ল্যাটফর্মগুলোতে শেয়ার করেছিলেন তাতে দেখা গেছে, লাইক ও রিপ্লাইয়ের ভিত্তিতে টুইটারের চাইতে থ্রেডসে এগুলোর এনগেজমেন্ট অপেক্ষাকৃত বেশি; যদিও নতুন প্ল্যাটফর্মটিতে তার রিচ ছিল কম।
স্টামোসের টুইটারে ১০০,০০০ অনুসারী রয়েছে, কিন্তু থ্রেডসে তার অনুসারীর সংখ্যা এর মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ। স্টামোস জানান, নন-টুইটার প্ল্যাটফর্মগুলোতে তার পোস্টের রিপ্লাইগুলোর মানও ছিল বেশি।
এর আগে ফেসবুক-এ প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করা স্টামোস বলেন, "আমার দৃষ্টিকোণ থেকে, গুরুত্বপূর্ণ টেক কনভারসেশনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টুইটারের জায়গা এখানেই শেষ।"
টুইটারের প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু বিকল্প নয়
থ্রেডসের ব্যাপক ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পেছনে কাজ করছে নতুন ইউজারদের সাইন-আপ করাতে ইনস্টাগ্রামকে 'স্প্রিংবোর্ড' হিসেবে ব্যবহার করা, সেইসঙ্গে রয়েছে টুইটার নিয়ে ইউজারদের অসন্তুষ্টি।
থ্রেডস যাত্রা শুরু করেছিল কয়েকজন তারকাকে নিয়ে, যারা তাদের একাউন্ট থেকে এই প্ল্যাটফর্মকে জনপ্রিয় করে তুলতে কাজ করেছেন। কিন্তু এরপরে কিম কার্দাশিয়ান ও জেফ বেজোসের মতো হাই-প্রোফাইল ইউজাররাও এখানে যুক্ত হন। ইলন মাস্কের প্রাইভেট জেটের গতিবিধির ওপর নজর রাখে এমন একটি অ্যাকাউন্ট টুইটারে নিষিদ্ধ করার পর সেটিকে থ্রেডসে যুক্ত হতে দেখা গেছে।
এক্সিওস জানিয়েছে, একশো জনেরও বেশি মার্কিন আইনপ্রণেতা থ্রেডসে সাইন-আপ করেছেন গত সপ্তাহে; যদিও উল্লেখযোগ্য বিশ্বনেতাদের এখনও এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে দেখা যায়নি।
জাকারবার্গ এবং ইনস্টাগ্রামের প্রধান অ্যাডাম মোসেরি জোর দিয়ে বলেছেন যে, থ্রেডস টুইটারের একটি বিকল্পের চাইতেও বেশি কিছু এবং এই অ্যাপটি টুইটারের গতানুগতিক ইউজার বেজের বাইরেও অডিয়েন্সকে আকৃষ্ট করতে চায়। এর মানে থ্রেডস সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কন্টেন্ট বা সংবাদকে প্রচার করবে না, বলেন মোসেরি। তার ভাষ্যে, এই বিষয়গুলো তুলে ধরতে চাইলে যে যাচাই-বাছাই, নেতিবাচকতা বা প্রতিষ্ঠানের ওপর যে ঝুঁকি চলে আসে তা নেওয়ার মতো উপযুক্ত এগুলো নয়।
রাজনীতি ও সংবাদ নিয়ে মোসেরির এমন বক্তব্যের পর উক্ত বিষয়গুলোকে থ্রেডস কিভাবে গ্রহণ করছে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ এর প্রশংসা করেছেন যে এই প্ল্যাটফর্মটি হয়তো গড়পরতা ইউজারদের জন্য বেশি সহজলভ্য হবে, যে ইউজাররা হয়তো আগে কখনো টুইটারকে আপন করে নিতে পারেননি। অন্যদিকে কেউ কেউ বলেছেন, মোসেরি যেসব বিষয়কে অরাজনৈতিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেমন- সঙ্গীত, ফ্যাশন ও বিনোদন... এগুলো নিজেরাই সংবাদের উৎস এবং সহজাতভাবে এগুলোও রাজনৈতিক হতে পারে।
যদিও মেটার নির্বাহীরা থ্রেডস ও টুইটারের মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং থ্রেডসের দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়া স্রেফ মাস্ক ও জাকারবার্গের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ তীব্রতর করেছে। মেটার বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ এনে মামলার হুমকিও দিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্ম টু্ইটার।
বরাবরই উগ্র আচরণ ও উস্কানিমূলক মন্তব্যের জন্য পরিচিত ইলন মাস্ক রবিবার জাকারবার্গের সঙ্গে অপমানসূচক একটি তুলনার প্রসঙ্গ টেনে এই বিরোধকে আরও উস্কে দিয়েছেন। তবে জাকারবার্গ সরাসরি সেই অপমানের জবাব দেননি।
কিন্তু জনৈক থ্রেডস ইউজার যখন পোস্ট করে দেখান যে টুইটারের ট্রেন্ডিং টপিকস ট্যাবে থ্রেডসের কথা যুক্ত হয়নি, এর জবাবে ব্যঙ্গাত্বক হাসি-কান্নার ইমোজিসহ 'উদ্বেগজনক' লিখে রিপ্লাই দেন জাকারবার্গ। আর মাস্ক এবং জাকারবার্গের বদ্ধ খাঁচায় লড়াইয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে তো ইতোমধ্যেই চর্চা চলছে।