চীনা মাইক্রো-ড্রামার জোয়ার: এক মিনিটের এপিসোড যেভাবে মোবাইল দর্শকদের মাতিয়ে রাখছে
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/04/rdhwkkr4dfbf3pko4fw4kclhri.jpg)
ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে এক সুসজ্জিত তরুণ অভিনেতা। হাতে ধরা একটি চিঠি মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। দৃশ্যত, কোনো দুঃসংবাদ। হঠাৎই লাইটার জ্বালিয়ে চিঠিতে আগুন ধরিয়ে দেন। তারপর সেটি ফেলে মাটিতে দেন। পুড়ে ছাই হয়ে যায় চিঠিটি। কিছুক্ষণ বিষণ্ন দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে থাকেন তিনি। ঠিক তখনই পরিচালক বলে ওঠেন, 'কাট!'
মাত্র এক মিটার দূরত্ব থেকে তিনজন ক্যামেরাম্যান দৃশ্যটি ধারণ করেন প্রায় একই কোণে। ক্যামেরাগুলো ৯০ ডিগ্রিতে সেট করা, যাতে উল্লম্বভাবে শুট করা যায় এবং মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের উপযোগী হয়। কোনো বিরতি ছাড়াই দ্রুত দৃশ্যধারণ সম্পন্ন হয়।
সকাল ৯টায় চীনের পূর্ব উপকূলীয় ঝেজিয়াং প্রদেশের হেংদিয়ানের সেটে শুটিং চলছে। এখানে দেশের বৃহত্তম ফিল্ম ও টেলিভিশন স্টুডিও অবস্থিত। প্রায় ৩০ জনের একটি দল ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করছে, পরিকল্পনা আছে মধ্যরাত পর্যন্ত থাকার। শুটিংয়ের প্রথমদিনেই তাদের লক্ষ্য সিরিজের ৫৫টি এপিসোড সম্পন্ন করা। এক থেকে দুই মিনিট দৈর্ঘ্যের এসব পর্ব চার দিন ধরে প্রচারিত হবে। সিরিজটির নাম 'চেজিং হিজ ওয়াইফ, বাট ফেইলিং'। প্রায় ৫৩ হাজার ডলার বাজেটে নির্মিত এ সিরিজের প্রধান লক্ষ্য তরুণী দর্শকদের আকৃষ্ট করা। চীনের বিকাশমান মাইক্রো-ড্রামা শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এটি।
মাইক্রো-ড্রামাগুলো দর্শকদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সংক্ষিপ্ত অথচ আকর্ষণীয় গল্প বলার মাধ্যমে এ শিল্প এক ধরনের বিপ্লব ঘটিয়েছে। মোবাইল ফোনের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত এসব মিনি-এপিসোডের দৈর্ঘ্য হয় এক থেকে তিন মিনিট। প্রতিটি পর্বে টানটান উত্তেজনা থাকে, যা দর্শকদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। পিরিয়ড ড্রামা, থ্রিলার ও রোমান্টিক গল্পের মিশ্রণে এগুলো তৈরি হয়।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/04/bjmrqtoi5negbm5vwfboozev3i.jpg)
এই মাইক্রো-ড্রামাগুলো আমাদের ব্যস্ত জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো করে নির্মাণ করা হয়। এতে করে পাতাল রেলে, বাথরুমে বা কফি ব্রেকের সময় সহজেই দেখা যায়। সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ পর্বের সিরিজগুলোর প্রথম কয়েকটি পর্ব বিনামূল্যে দেখা যায়। এরপর প্রতি পর্বের জন্য দর্শকদের নির্দিষ্ট ফি দিতে হয়। এছাড়া রয়েছে নির্দিষ্ট মূল্যের সাবস্ক্রিপশন মডেল, ভিআইপি সুবিধা ও বিজ্ঞাপনমুক্ত দেখার জন্য অতিরিক্ত ফি পরিশোধের ব্যবস্থা।
২০২০ সালে ডুয়িনসহ অন্যান্য ভিডিও অ্যাপের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই উন্মাদনা দ্রুত প্রসার লাভ করে। বর্তমানে মাইক্রো-ড্রামা শিল্পের আর্থিক প্রবৃদ্ধি আকাশচুম্বী। চায়না নেটওয়ার্ক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এই খাতে আয় বেড়ে ৬.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এটি প্রথমবারের মতো বক্স অফিস আয়কে ছাড়িয়ে গেছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/04/ds4pwprbeffaxhdktenxwvra74.jpg)
চীনের ইন্টারনেট উন্নয়নবিষয়ক পরিসংখ্যান মতে, জুনের মধ্যে মাইক্রো-ড্রামার দর্শকসংখ্যা ৫৭৬ মিলিয়নে পৌঁছেছে।
'চেজিং হিজ ওয়াইফ' সিরিজের পরিচালক ২৫ বছর বয়সি শি হেনগ্যাং। গত দুই বছরে তিনি অসংখ্য মাইক্রো-ড্রামা তৈরি করেছেন। তার মতে, এই সিরিজগুলোর সাফল্য নির্ভর করে কাহিনির গতি ও বিষয়বস্তুর ওপর।
বর্তমানে হেংদিয়ান মাইক্রো-ড্রামার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যা ভাগ্যান্বেষীদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালের মধ্যে হেংদিয়ান ওয়ার্ল্ড স্টুডিওতে প্রায় ১ হাজার ৫০০টি মাইক্রো-ড্রামা শুট হবে। রাজকীয় প্রাসাদের আদলে নির্মিত 'নিষিদ্ধ শহর'-এর বিশাল সেটসহ গোটা শহরজুড়েই গড়ে উঠেছে শুটিংয়ের অবকাঠামো। কেউ কেউ একে 'চীনের হলিউড' বলে অভিহিত করেন, যদিও এখানে জৌলুশের কিছুটা কমতি রয়েছে। এখানে পাহাড়চূড়ায় কোনো প্রাসাদ নেই, আছে কেবল ধুলোভরা রাস্তায় প্রোডাকশন কোম্পানির অফিস, শুটিং সরঞ্জাম, প্রপ ও কস্টিউম সরবরাহকারীদের দোকান।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/04/u4bdwbpu25btdbqxdlvz5n7the.jpg)
পরিচালক ইউ হংলিন মোফাং ফিল্ম প্রযোজনা সংস্থার ছোট্ট এক অফিসে প্রবেশ করেন। তার ডেস্ক স্ক্রিপ্ট ও অভিনেতাদের সিভিতে পরিপূর্ণ। কম্পিউটারের পর্দায় তিনি তার আসন্ন সিরিজের ট্রেলার দেখান, যা অ্যাক্রোবেটিক লাফ, তলোয়ার-যুদ্ধ ও বিস্ফোরণের এক বিশৃঙ্খল সংমিশ্রণ।
তিনি বলেন, 'সিরিজটির নায়ক এক নিঃসঙ্গ তলোয়ারধারী, যে তার অস্ত্র রক্ষার উদ্দেশে বিশ্বভ্রমণ করছে। রহস্য-ফ্যান্টাসি ঘরানার এই সিরিজগুলোতে কুংফু ও অতিমানবীয় শক্তিসম্পন্ন চরিত্রের প্রাধান্য থাকে, যা দর্শকদের আকর্ষণ করে।'
প্রতিটি মাইক্রো-ড্রামা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্মিত হয়। পরিচালক ইউ মনে করেন, এটি অনেকটা চলচ্চিত্র নির্মাণের মতোই। প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার ডলারের বাজেট নিয়ে নির্মিত এই সিরিজটি শীর্ষস্থানীয় মাইক্রো-ড্রামাগুলোর একটি। মোট ১২০ মিনিটের এই সিরিজে ৮০টি পর্ব রয়েছে। এটি ২৯ জানুয়ারি হংগুয়ো প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে। উল্লেখ্য, হংগুয়ো হলো টিকটকের মূল প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের ভিডিও স্ট্রিমিং অ্যাপ। বর্তমানে এর সক্রিয় ব্যবহারকারী সংখ্যা ১২০ মিলিয়ন।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/04/toupxkgobjeedabyelh223fxbm.jpg)
ইউ বলেন, 'আগে নিম্নমানের কাজ হলেও এখন পেশাদার কাজের সংখ্যা বাড়ছে। চীনের ইন্টারনেট জায়ান্টরা এর সম্ভাবনা বুঝতে পেরে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে এবং পেশাদার অভিনেতাদের সঙ্গে কাজের আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা মূলধারার সিনেমার সঙ্গে কোনো পার্থক্য রাখতে চাইছে না।'
২০২৩ সাল থেকে চীনে মাইক্রো-ড্রামা তৈরি বেড়েছে। পরিচালক ইউর প্রযোজনা সংস্থা গত দুই বছরে ৫০-৬০টি মাইক্রো-ড্রামা তৈরি করেছে। এর ফলে চীনা কোম্পানিগুলো এখন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হতে চাইছে। চীনের বাইরের কিছু প্ল্যাটফর্ম ইতিমধ্যেই অনূদিত চীনা মাইক্রো-ড্রামা প্রদর্শন করছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/04/pgtfxrrmafbu3pv6jbtuzf44zq.jpg)
বাইটড্যান্স ২০২৪ সালের শেষের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য নিজস্ব অ্যাপ 'মেলোলো' চালু করেছে। অন্যদিকে চীনা জায়ান্ট টেনসেন্ট ও বাইদুর 'রিলশর্ট' যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম মাইক্রো-ড্রামা প্ল্যাটফর্ম। চীনা প্রযোজনা সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে ইংরেজি কনটেন্ট তৈরি করছে। হেংদিয়ান স্টুডিওস আন্তর্জাতিক চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন জোট গঠন করছে।
হাংজু ও নিউ ইয়র্কভিত্তিক স্প্রিং রিলের প্রতিষ্ঠাতা উইনি ট্যাং বলেন, 'আসল প্রতিযোগিতা এখনও শুরু হয়নি।' তিনি 'ফরবিডেন ডিজায়ারস: আলফাস লাভ' নামে একটি মাইক্রো-ড্রামা তৈরি করেছেন, যা স্থানীয় অভিনেতাদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চিত্রায়িত হলেও এর পরিচালক ও প্রধান ক্রু সদস্যরা ছিলেন চীনা। কোম্পানিটির দাবি, এই সিরিজ ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/04/6ldo27ubzjcyrhw6mf7nzw6xse.jpg)
হেংডিয়ান ওয়ার্ল্ড স্টুডিওর আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের কর্মকর্তা আলেকজান্ডার হে মনে করেন, ২০২৫ সাল হবে এই খাতের জন্য এক সমৃদ্ধির বছর।