গুলেন-বারি সিনড্রোম: ক্রিপিং প্যারালাইসিসের প্রাদুর্ভাবের মুখে ভারত
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/12/guillain-barre.jpg)
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় পুনে শহরে একদিন এক স্কুলশিক্ষক লক্ষ্য করলেন, তার ছয় বছর বয়সি ছেলে হোমওয়ার্ক নিয়ে বেশ বিচলিত।
সেদিনের এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি বলেছিলেন, 'আমি কিছু শব্দ মুছে দিয়ে ওকে (ছেলে) সেগুলো আবার লিখতে বলি। তখন প্রথমে আমার মনে হয়েছিল হয়ত এতে ওর খুব রাগ হয়েছে। আর এ কারণেই ঠিকভাবে পেন্সিল ধরতে পারছে না।'
তবে ঠিকভাবে পেন্সিল ধরতে না পারাটা যে তার ছেলের একটি অসুখের প্রাথমিক লক্ষণ, সেটি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি ওই শিক্ষক। খবর বিবিসির।
আর এ রোগের নাম গুলেন-বারি সিনড্রোম বা জিবিএস। চিকিৎসকদের ভাষায় এটি একটি বিরল রোগ। এ রোগে দেহের ইমিউন সিস্টেম তথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্নায়ু কোষকে আক্রমণ করে। ফলে পেশী দুর্বলতা ও প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে।
ওই শিক্ষকের ছেলের বেলায়ও এমনটাই ঘটেছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই তার ছেলে হাত-পা নাড়াচাড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চলে চিকিৎসা। সেখানে দিন দিন ছেলেটির শারীরিক অবস্থার অবনতিই হতে থাকে। ধীরে ধীরে সে কোনো কিছু গেলা, কথা বলা এবং শেষ পর্যন্ত নিঃশ্বাস নেওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফলে। পরে ভেন্টিলেটর সাপোর্টের মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়।
এখন সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে।
সরকারি হিসাবে, জানুয়ারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত পুনেতে ১৬০ জনের জিবিএস-এ আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়াও এ রোগে পাঁচজন মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে ৪৮ জন রোগী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে, ২১ জন ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রয়েছেন। আর ৩৮ জনকে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এ রোগের প্রথম লক্ষণ হাত-পায়ের ঝিঁঝিঁ বা অসাড়তা। তারপর পেশী দুর্বলতা ও (হাত-পা) নাড়াচাড়ার সময় অস্থিসন্ধি অর্থাৎ হাড়ের জোড়ায় অসুবিধা দেখা দেয়। দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণগুলো বৃদ্ধি পায়। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও রোগের পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে এ রোগে মৃত্যুর হার ৩ থেকে ১৩ শতাংশ।
পুনেতে সম্প্রতি এ রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণ ক্যাম্পিলোব্যাক্টার জিজুনি নামের একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া। মূলত খাবারের মাধ্যমে এ ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়। ১৯৯০-এর দশকে চীনের প্রত্যন্ত এলাকায় সর্বপ্রথম এ ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে জিবিএস রোগের সম্পর্ক ধরা পড়ে। ওই সময় সেখানে মুরগির মধ্যে এ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ছিল সাধারণ বিষয়। আর প্রতি বর্ষাকালে শিশুরা যখন হাঁস-মুরগির বিষ্ঠায় দূষিত হওয়া পানিতে খেলত, তখন এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিত।
ভারতে জিবিএস একেবারেই নতুন কোনো ঘটনা নয়। ব্যাঙ্গালোরভিত্তিক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেসের (এনআইএমএইচএএনএস) মনোজিত দেবনাথ ও মধু নাগাপ্পা ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ১৫০ জিবিএস রোগীর ওপর গবেষণা করেছেন।
গবেষণায় ৭৯ শতাংশ রোগীর দেহে ইতিপূর্বে সংক্রমিত হওয়ার প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন ক্যাম্পিলোব্যাক্টার পজিটিভ। আর ৬৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা একইসময়ে একাধিক ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসে সংক্রমিত।
অতি সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ব্যাকটেরিয়াজনিত অসুখের প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালের প্রথম সাত মাসে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে ২০০টিরও বেশি সন্দেহজনক জিবিএস রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে চারজন মারা গেছেন। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর অসুখ ছিল ক্যাম্পিলোব্যাক্টারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/12/capture.jpg)
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভালো, সেসব দেশে ক্যাম্পিলোব্যাক্টারের কারণে জিবিএস আক্রান্তের ঘটনা খুব কম দেখা গেছে। তবে এসব দেশে জিবিএস-এ আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ বায়ুবাহিত সংক্রমণ অর্থাৎ বায়ুর মাধ্যমে ছড়ানো ব্যাকটেরিয়া। এছাড়া ভাইরাসের কারণেও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দেখা গেছে। যেমন- ২০১৫ সালে ব্রাজিলে বহু মানুষ জিকা ভাইরাস থেকে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক হিউ উইলিসন বলেন, 'ক্যাম্পিলোব্যাক্টার পরিবেশে সর্বদাই বিদ্যমান। মানুষও প্রায়ই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।'
ক্যাম্পিলোব্যাক্টারের একটি নির্দিষ্ট স্ট্রেইন আছে, যার বাইরের স্তর চিনির আবরণযুক্ত। তবে বিরল কিছু ক্ষেত্রে এটির আণবিক গঠনের সঙ্গে মানবদেহের স্নায়ু কোষের আবরণের মিল দেখা যায়।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, প্রায় ১০০টির মধ্যে একটি ক্যাম্পিলোব্যাক্টার স্ট্রেইন জিবিএস-এর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। যেসব মানুষ এমন স্ট্রেইন দ্বারা সংক্রমিত হন, তাদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে একজন জিবিএস-এ আক্রান্ত হন। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে জিবিএস-এ আক্রান্ত হওয়ার সার্বিক ঝুঁকি মোটামুটি প্রতি ১০ হাজারে একজন।
এখন পর্যন্ত সেভাবে জিবিএস-এর কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার হয়নি, যা এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা অবনতির অন্যতম কারণ।
জিবিএস-এ আক্রান্ত হলে মানবদেহ ক্যাম্পিলোব্যাক্টারের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা পরে স্নায়ুকে আক্রমণ করে। চিকিৎসকরা এ রোগের তীব্রতা কমাতে 'প্লাজমা এক্সচেঞ্জ' পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এ পদ্ধতিতে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ থেকে রক্ত থেকে ফিল্টারের মাধ্যমে ক্ষতিকারক অ্যান্টিবডি বের করে আনেন।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/12/b60b8c60-dfcb-11ef-bd1b-d536627785f2.jpg)
আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো জিবিএস নির্ণয়ে কোনো একক বা নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। চিকিৎসকরা মূলত রোগীর উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে এটি নির্ণয় করে থাকেন। এ রোগ প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতের মতোই। এ রোগে যেসব উপসর্গ দেখা যায়, সেসব লক্ষণ বা উপসর্গ পোলিও, বিভিন্ন ভাইরাস বা বিরল স্নায়বিক রোগেও দেখা দিতে পারে।
জিবিএস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ, রোগের ধরন বিশ্লেষণ করে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দল পুনেতে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা ৬০ হাজারেও বেশি বাড়ির তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং পর্যবেক্ষণ করেছেন। পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা ১৬০টি জায়গা থেকে পানির নমুনাও সংগ্রহ করেছেন। সেইসঙ্গে মানুষকে ফোটানো পানি ও সতেজ খাবার খেতে এবং বাসি কিংবা ভালোভাবে রান্না না করা মুরগি ও ছাগলের মাংস খেতে নিষেধ করেছেন।
যদিও বিশ্বজুড়ে জিবিএস আক্রান্তের বেশিরভাগ ঘটনার পেছনে ভালোভাবে রান্না না করা মুরগির মাংস খাওয়া দায়ী। তবে পানি থেকেও এ রোগ ছড়াতে পারে। এছাড়াও স্ট্রিট ফুড তৈরির কাজে দূষিত পানির ব্যবহারের ফলে খুব সহজেই এ ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে পারে।
পুনেতে একটি নির্দিষ্ট ক্যাম্পিলোব্যাক্টার স্ট্রেইন ছড়াচ্ছে। এতে বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন।
তবে এটি পানি দূষণের কারণে ঘটছে, নাকি সংক্রমিত মুরগির মাংস খাওয়ার কারণে হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সেখানকার স্বাস্থ্যবিভাগ।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক