বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম চড়ছেই, এবার চালেরও!
গেল কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দামে আগুন লেগে রয়েছে। এই বাস্তবতায় এশিয়ার বিপুল মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য—চালের দামে মূল্যস্ফীতির আরও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন খাতটি পর্যবেক্ষনকারী বিশেষজ্ঞরা।
গম থেকে শুরু করে অন্যান্য দানাদার শস্য, মাংস, ভোজ্যতেলের দাম এরমধ্যেই রেকর্ড মাত্রায় চড়েছে পৃথিবীময়। এর পেছনে কাজ করেছে নানাবিধ কারণ—গেল বছর জুড়ে সার ও জালানির উদ্বাহু মূল্য থেকে শুরু করে চলতি বছরের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
এরমধ্যেই বিভিন্ন দেশ দিয়েছে বিশেষ কিছু পণ্য রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা। যেমন ভারত গমে এবং ইন্দোনেশিয়া পাম তেলে। এরমধ্যে ইন্দোনেশিয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু, গম, জই, চিনি, সূর্যমুখীর তেল, ভুট্টাসহ ইউক্রেন থেকে বিপুল খাদ্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে যুদ্ধের কারণে। বিশ্ববাজারে এই শূন্যস্থান মূল্যের দাবানলকে ছড়িয়ে দিচ্ছে দিকে দিকে।
সে আগুনই এবার চালের বাজারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরমধ্যেই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার খাদ্যমূল্য সূচকে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দর টানা পাঁচ মাস জুড়ে বেড়ে ১২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে বলে জানানো হয়। মে মাসের সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে এটি প্রকাশিত হয় গত সপ্তাহে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, চালের উৎপাদন এখনও পর্যাপ্ত। তবে ক্রমে ঊর্ধ্বমুখী গমের দাম এবং চাষবাসের উচ্চ খরচের কারণে চালের দাম বৃদ্ধির দিকে নজর রাখতে হবে।
জাপানি ব্যাংক নোমুরার প্রধান অর্থনীতিবিদ সোনাল ভার্মা বলেন, "চালের বাড়তি দাম মনিটর করতে হবে; কারণ গমের দাম বাড়ায় বিকল্প হিসেবে চালের প্রতি ঝুঁকবে মানুষ, এতে চাহিদা বাড়লে বিদ্যমান মজুদ কমবে।"
খাদ্য সুরক্ষাবাদের ঝুঁকি
জাতীয় স্বার্থ সর্বাগ্রে—খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে রপ্তানিকারক অনেক দেশ এই নীতিতে ঝুঁকছে। "এতে বৈশ্বিক পর্যায়ে নানানভাবে খাদ্যের মূল্যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে" বলে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসিকে জানিয়েছেন সোনাল।
তার মতে, পশুখাদ্য ও সারের দাম তো বাড়ছেই। তার সাথে চড়া জ্বালানিমূল্য ও পরিবহন খরচও যোগ হচ্ছে। "ফলে রপ্তানিকারক দেশগুলো আরও বেশি খাদ্য সুরক্ষাবাদী নীতি নেমে এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে।"
চলতি গ্রীষ্মে ভারতে ধানের ফলন ভালো হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে। তার সাথে বৈশ্বিক মজুদও যথেষ্ট থাকায়—চালের সংকট দেখা দেওয়ার ঝুঁকি এখনও বেশ কম বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
খাদ্য নিয়ে দুনিয়াজুড়ে দুর্দশার মূল কারণ আজ ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে গমের দামে ঊর্ধ্বমুখী মিছিল শুরু হয়। রাশিয়ার আগ্রাসনে আক্রান্ত দেশটি থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। দেশটির বন্দরগুলোয় নৌ-অবরোধও দিয়েছে রাশিয়া। সরবরাহের এ বিচ্ছিন্নতায় এক বছর আগের তুলনায় গমের দাম এখন ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
ইউক্রেনের বিভিন্ন সাইলো ও গুদামে লাখ লাখ টন দানাদার শস্য মজুদ রয়েছে। এসব রপ্তানির সুযোগ পেলে বাজারদর কমবে এমন আশা রয়েছে। তবে যুদ্ধের আঘাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, গত সপ্তাহের সোমবার ইউক্রেনের একটি খাদ্যশস্য রপ্তানি টার্মিনাল ধবংস করে দেয় রাশিয়া। এ সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথে আরও ৪ শতাংশ বেড়েছে গমের দর।
এরমধ্যেই, চালের রপ্তানিমূল্য বাড়াতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করেছে এশিয়ার বড় দুই উৎপাদক- থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। মে মাসের শেষদিকে এ আলোচনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন থাইল্যান্ডের একজন সরকারি কর্মকর্তা।
গত ৬ জুন চারজন রপ্তানিকারক রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন যে, থাই ও ভিয়েতনামি চালের দাম বৃদ্ধির শঙ্কায় গত দুই সপ্তাহ ধরেই বেশি বেশি ভারতের চাল কিনছেন আন্তর্জাতিক ক্রেতারা।
ক্রেতাদের এই আগ্রহ ভারত সরকারকে উদ্বেগে ফেলতে পারে। আসতে পারে দেশের বাইরে বিপুল চালান চলে যাওয়া থামানোর উদ্যোগ।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো ডেভিড ল্যাবরোড বলেন, "আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভারত চাল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে—এমন দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এর আগে গম ও চিনির ক্ষেত্রেও সেদেশের সরকার একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্যানুসারে, বিশ্বের শীর্ষ দুই চাল উৎপাদক- ভারত ও চীন—মোট বৈশ্বিক উৎপাদনের অর্ধেক উৎপাদন করে। এ তালিকায় ভিয়েতনাম পঞ্চম ও থাইল্যান্ড ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে।
এর আগে গত মে মাসে নিজ দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষার যুক্তি দিয়ে গম রপ্তানি বন্ধ করে ভারত। এরপর দিনকয়েক পর চিনি রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেয়।
বিকল্প হিসেবে রপ্তানি মূল্যবৃদ্ধিকে সমাধান ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা
ডেভিড ল্যাবরোড মনে করছেন, পুরোপুরি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেয়ে রপ্তানির কিছুটা মূল্যবৃদ্ধিই কাঙ্ক্ষিত সমাধান হতে পারে।
তিনি বলেন, "যতটুকু দাম বাড়ালে কৃষকেরা ফসল উৎপাদনের বাড়তি খরচ পুষিয়ে লাভ করতে পারবেন—আমরা ততোটুকুই বাড়ানোর পক্ষে। অন্তত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার চেয়ে এটি ভালো সমাধান। সে তুলনায়, আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার চক্রবৃদ্ধি প্রভাব পড়ে। ঠিক এ কারণেই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা স্থানীয় বাজারে ফসলের দাম কমালেও আন্তর্জাতিক বাজারকে আরও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়।"
ইন্টারন্যাশনাল রাইস ইনস্টিটিউটে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধি নাফিস মিয়াহ জানান, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির চড়া দাম কৃষি উৎপাদনে বড় প্রভাব ফেলছে, আর ধান চাষে সেচের প্রয়োজনীয়তা থাকায়- সেক্ষেত্রে এ খরচও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।
"তাই এক ধরনের আলোচনা হচ্ছে। অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, বাজার যদি বাড়তি মূল্য সমর্থন করে তাহলে যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাড়তি খরচে ফসল উৎপাদন করছেন- তিনি কেন এর সুবিধা পাবেন না?"
তবে চালের এই বাড়তি দামও এশিয়ার বিপুল জনগোষ্ঠীকে আঘাত করবে- যারা এটির সবচেয়ে বড় ভোক্তা।
"তাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পূর্ব তিমুর, লাওস, কম্বোডিয়াসহ বড় জনসংখ্যার ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ- যেখানে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব রয়েছে সেখানে বাড়তি মূল্যের চাপ অসহনীয় হবে। দাম যদি বাড়তেই থাকে বা উচ্চ অবস্থানে বজায় থাকে তাহলে আপামর জনতার দুর্ভোগ চরমে পৌঁছাবে।"
- সূত্র: সিএনবিসি