চীনের কৌশলগত প্রভাবকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে শ্রীলঙ্কার সংকট
গোতাবায়া রাজাপাকশে ও তার পরিবার ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাতে বেইজিং-এর খুশি হবার অনেক কারণ ছিল। তারও কয়েক বছর আগেই নতুন প্রেসিডেন্টের বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকশের হাত ধরে শ্রীলঙ্কা চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রক্রিয়ার অংশ হয়।
এই প্রকল্পের ফলে শ্রীলঙ্কা ভারত সাগরে চীনের জন্য শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে চিন্তা করলে এই প্রকল্প অনেক সুদূরপ্রসারী, কেননা চীন শ্রীলঙ্কার বন্দর ব্যবহার করে মালাক্কা প্রণালী ব্যবহার না করেই আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় বাণিজ্য করার সুবিধা পাচ্ছিল।
কিন্তু ২০১৫ সালে মাহিন্দা রাজাপাকশে যখন ক্ষমতাচ্যুত হলেন, তখন চীন এই সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। এরপর আবার যখন রাজাপাকশে ভ্রাতৃদ্বয় ক্ষমতায় আসে, ভারত সাগর আবার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ভেবে চীন আবার খুশি হয়। কিন্তু সেগুলোর সব এখন পাল্টে গেছে।
২০২২ সালের মে মাসে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়, মানুষজন কলম্বোর রাস্তায় বের হয়ে পড়ে, রাজাপাকশেকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে।
কলম্বোর রাজনীতিতে চলমান এই সংকট চীনের বৈদেশিক কূটনীতির জন্যও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে এটি চীনের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনার কথাও ভাবাচ্ছে সামগ্রিকভাবে। শ্রীলঙ্কার সংকটের কারণে চীনের ভারত সাগর শাসন করা এবং শ্রীলঙ্কাতে বা অন্যান্য দেশগুলোতে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে।
২০১৯ সালে রাজাপাকশে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে চৈনিক এসব অবকাঠামোর বিরুদ্ধে। চলমান অর্থনৈতিক সংকটে এসব প্রকল্পকেই দোষী করা হচ্ছে। রাজাপাকশের নিজ শহর হাম্বানটোটায় একটি সমুদ্রবন্দর বানাতে চীন ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। এই বন্দর ব্যবহার করে ছয় বছরে লোকসানই হয়েছে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এই সমুদ্রবন্দরের পাশেই ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণে বানানো হয়েছে বিমানবন্দর। কিন্তু এই বিমানবন্দর এতই অল্প ব্যবহার করা হয়েছে যে, এক পর্যায়ে এটির বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খেয়েছে কর্তৃপক্ষ। একই শহরে ১৫ মিলিয়ন ডলার খরচে একটি কনফারেন্স সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। এটিও খুব একটা ব্যবহার করা হয়না বলেই বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
চীনের এই অবকাঠামোগত বিনিয়োগ অনেক আগে থেকেই 'ঋণ ফাঁদ' নামে সমালোচিত। এসব ঘটনা থেকে শ্রীলঙ্কার চাইতেও গরীব দেশগুলো সচেতন হয়ে যাবে। শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে উর্ধ্বগামী এক দেশ ছিল যা কিনা শেষ পর্যন্ত এত অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরেও মুখ থুবড়ে পড়েছে, চীনের এই 'ঋণ ফাঁদ' তাই খুব সহজে নাইজেরিয়া, কেনিয়া ও ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলোকে অনায়াসে দেউলিয়া বানিয়ে ফেলতে পারে।
পরিস্থিতি এমন খারাপ হবার পিছনে চীনের দায়ও আছে, যা চীন অস্বীকার করতে পারবেনা। কেননা কলম্বোকে সাহায্য করার ব্যাপারে বেইজিং তার অবস্থান স্পষ্ট করছে না। শ্রীলঙ্কা চীনের কাছে ঋণ থেকে পরিত্রাণ পেতে সাহায্য চায়। চীন তার বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের সদস্য রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে এই সুবিধা দিতে অনিচ্ছুক পাছে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো এখান থেকে সুযোগ খুঁজে। তাই শেষ পর্যন্ত সাহায্যের জন্য আইএমএফ-এর শরণাপন্ন হতে হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেইজিংয়েরও হাত বাঁধা। শি জিন পিং-এর 'জিরো কোভিড' নীতির জন্য চীনের বড় বড় শহরগুলোও অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকেছে। মে ২০২২ সালের হিসাব পর্যন্ত, গত বছরের তুলনায় এ বছরের এপ্রিলে চীনের কলকারখানার উৎপাদন ২.৯ শতাংশ কমেছে। খুচরা বিক্রি কমেছে গত বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ।
চীনের এই অনুপস্থিতিতে ভারত শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়াচ্ছে। এখন পর্যন্ত নয়া দিল্লী কয়েক বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে কলম্বোকে। ভারতের প্রভাব এখন শ্রীলঙ্কায় এত বেশি যে বিক্ষুব্ধ এক ছাত্র গণমাধ্যমকে বলেছেন, তারা (ভারতীয়রা) যদি প্রেসিডেন্টের কাছে গায়ের জামাও চায়, সেটাও তাকে দেয়া লাগবে।
ইউক্রেনের ওপর পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার জন্য হয়তো বেইজিং শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু কলম্বোর এই সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাতে আখেরে ক্ষতি হবে চীনেরই বেশি। এ সংকটের কারণে ভারত সাগরে চীনের কৌশলগত প্রভাব দীর্ঘকালীন ঝুঁকির মুখে পড়া ও দেশটির বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
মূল লেখা: মোহামেদ জিসান; ফ্রিডম গ্যাজেট-এর প্রধান সম্পাদক ও ফ্লাইয়িং ব্লাইন্ড: ইন্ডিয়া'স কোয়েস্ট ফর গ্লোবাল লিডারশিপ বইয়ের লেখক
ভাষান্তর: আতিকুর রহমান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী