রপ্তানি খাতে বিলিয়ন ডলারের টাওয়েল শিল্পের যাত্রা শুরু হলো যেভাবে
স্বাধীনতার আগে ফেনী, চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ডসহ আশপাশের অঞ্চলের মানুষের খ্যাতি ছিল টাওয়েল উৎপাদনে। এখানকার শ্রমিকরা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে গিয়ে টাওয়েল উৎপাদনকারী কারখানায় কাজ করতেন। দক্ষ শ্রমিক হিসেবে তাদের সুনাম ছিল বেশ। স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে চট্টগ্রামে ১৯৮০ সালের পরে চট্টগ্রামে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড) প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে সরকার। তখন থেকেই পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক রইস খান টাওয়েল কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৮৪ সালে দেশের প্রথম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন চট্টগ্রাম ইপিজেডে যাত্রা শুরু করে রইস খানের টাওয়েল উৎপাদনকারী কারখানা সোনার কটন মিলস বিডি লিমিটেড। এটিই ইপিজেডের প্রথম টাওয়েল কারখানা। রইস খানের হাত ধরে শুরু হয় টাওয়েল উৎপাদন এবং রপ্তানি।
৩৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করা বাবার এই কারখানার হাল এখনো ধরে রেখেছেন ছেলে শারিক খান। চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করে বাবার ইচ্ছায় কারখানার হাল ধরেন তিনি।
সেই থেকে প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশেই স্থায়ী নিবাস গেড়েছেন তিনি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করছেন শারিক। সম্প্রতি সোনার কটন মিলসে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেন শারিক খান। চট্টগ্রাম ইপিজেডের সবচেয়ে পুরাতন এই কারখানার চড়াই-উতরাইসহ চার দশক ধরে টিকে থাকার গল্প শুনিয়েছেন তিনি।
শারিক খান বলেন, "স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলাদেশে নিয়মিত যাতায়াত করতেন আমার বাবা। আমাদের আত্মীয়স্বজনও ছিলেন। বাবা বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন। তিনি এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখেছেন। তাই বিনিয়োগ করেছেন।"
মূলত টেক্সটাইল খাতে বিশ্বজোড়া সুনাম রয়েছে পাকিস্তানের। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বিদেশি হিসেবে পাকিস্তানি নাগরিকরাও টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন, বলেন তিনি।
দেশের প্রথম টাওয়েল উৎপাদক সোনার কটনের প্রতিষ্ঠাতা রইস খান ১৯৬০ এর দশক থেকে টেক্সটাইল খাতে সম্পৃক্ত ছিলেন। টেক্সটাইল খাতের জায়ান্ট ফ্রাঙ্কো ফেরি করপোরেশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। একসময় তিনি প্রতিষ্ঠানটির পুরো টেক্সটাইল খাত প্রধান হিসেবে নিয়োজিত হন। এই অভিজ্ঞতা তাকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের দিকে টেনেছে।
"আমার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, বিশ্ববাজারে টেক্সটাইল খাতের জায়ান্ট হিসেবে উত্থান হবে বাংলাদেশের। তিনি এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। ফ্রাঙ্কো ফেরি করপোরেশনের প্রধান মিস্টার ফেরির সঙ্গে আমরা বাবা বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে পরামর্শ করেছিলেন। তিনিও বাবাকে অভয় দিয়েছিলেন। তিনিই আমাদের প্রথম ক্লায়েন্ট ছিলেন। আর তখন মার্কিন কংগ্রেস কোট প্রথা চালু করেছিল। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন কেজি টাওয়েল নিতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য টাওয়েল শিল্প দাঁড়াতে পেরেছে," বলেন শারিক খান।
৯১'র সাইক্লোনে প্রথম ধাক্কা
১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেডে কারখানা প্রতিষ্ঠার পর সোনার কটন মিলস বিডি লিমিটেড পুরোপুরি উৎপাদনে যায় ১৯৮৭ সালে। এর মাত্র চার বছর পর বড় বিপর্যয় নেমে আসে প্রতিষ্ঠানটিতে। ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারখানাটি। সব ধরনের যন্ত্রপাতি পানিতে ডুবে যায়। লবণ পানির কারণে যন্ত্রপাতিগুলো সব অকেজো হয়ে যায়। সেই ছাপ এখনো রয়ে গেছে। সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, কারখানাটির প্রায় ১১ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত দেয়ালে রং বা পলেস্তারা থাকে না। লবণ পানিতে ডুবে থাকার পর থেকে এই দেয়ালে রং ধরে না। সেই ক্ষতির কারণে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রায় সাত বছর বন্ধ থাকার পর আবারো উৎপাদনে যায় সোনার কটন।
২০০৭-০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দায় বিশাল ক্ষতি
২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সোনার কটন। প্রতিষ্ঠানটির এমডি শারিক খান বলেন, "সেসময় আমাদের প্রায় ৫ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছিল। এই ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি। টিকে থাকতে ২০১১ সালে জাহাঙ্গীর আলম নামে এক স্থানীয় ব্যবসায়ী নিয়োগ দিয়েছিলাম।"
সোনার কটনের হাত ধরে শুরু হওয়া হোম টেক্সটাইল ও টেরিটাওয়েল শিল্পে বাংলাদেশের রপ্তানি বছরে এখন ১১৬৬ দশমিক ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে এক দশকে বিশ্ববাজারে অনেক উত্থান-পতনও ছিল এই খাতের। করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য সচেতনার প্রভাবে এই পণ্যের চাহিদা আবার বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ১১০টি প্রতিষ্ঠান হোম টেক্সটাইল ও টেরিটাওয়েল পণ্য উৎপাদন করছে। এতে প্রায় ৬৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। দেশে এই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০১১-১২ অর্থবছরে এই খাতে মোট রপ্তানি আয় ছিল ৯৯৮ দশমিক ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপর থেকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় কমতে শুরু করে দেশের রপ্তানি আয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমে দাঁড়ায় ৮৪৬ দশমিক ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৯২১ দশমিক ০৩ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১১৬৬ দশমিক ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায় রপ্তানি আয়। এই পণ্যের আন্তর্জাতিক আকার প্রায় ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
করোনায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সোনার কটনও
শুরুতে সোনার কটনের কারখানাতে প্রায় ৪৫০-৫০০ শ্রমিক ছিল। বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ১৭৫ জন। শুরু থেকে সব ধরণের কিচেন টাওয়েল উৎপাদন করছে কারখানাটি।
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটির (বেপজা) তথ্যমতে, ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে সোনার কটন। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ৮৩ হাজার ৭৭২ মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা পৌঁছায় ১ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ দশমিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনা মহামারিতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আয় ১ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।
প্রতিষ্ঠানটির এমডি শারিক খান নতুন করে আশার আলো দেখছেন।
"আমাদের কিছু বায়ার অ্যামাজনসহ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রি করছেন। তাই অর্ডার ফ্লোও বেড়ে গেছে। আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার কেজি প্রতিমাসে। এই সক্ষমতার পুরোটাই কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করছি। এরপরও চাহিদা রয়েছে। কারখানাটির সক্ষমতা বাড়ানো হবে। এছাড়া ময়মনসিংহে নতুন কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে উৎপাদন দ্বিগুণে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে," তিনি বলেন।
বাবার ইচ্ছায় চিকিৎসক ছেলে এখন টেক্সটাইল খাতের ব্যবসায়ী
২০০২ সালে সোনার কটন মিলসের হাল ধরেন শারিক খান। ব্যবসা দেখভালের জন্য মার্কিন মুল্লুক ছেড়ে স্থায়ীভাবে পরিবার নিয়ে থাকছেন চট্টগ্রামে। শারিক খান বলেন, "বাবা খুব অসুস্থ হয়ে যান। তার ইচ্ছায় ব্যবসায়ের হাল ধরি। পাকিস্তানের মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করি। এরপর বাবা বললেন, এই কারখানা থেকে তোমার পড়াশোনার খরচ দিয়েছি। তুমি এর হাল ধরো। এরপর আমিও লেগে পড়ি। এখনো আছি। ২০১২ সালে তিনি মারা যান।"
"প্রথম যেদিন কারখানায় আসি, সেদিন বাবা বলেছিলেন, কারখানা বুঝতে হলে আগে উৎপাদন ইউনিটে যাও। উৎপাদন ইউনিটের কাজ বুঝলেই তুমি ব্যবসা বুঝবে। আমি টানা ছয় মাস উৎপাদন ইউনিটের কাজ বোঝার চেষ্টা করি। এরপর অফিসের ডেস্কে বসি", যোগ করেন শারিক খান।