টেক্সটাইল কেমিক্যাল উৎপাদনে ২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে ১০ বহুজাতিক কোম্পানি
টেক্সটাইল বা বস্ত্র খাতে ব্যবহৃত কেমিক্যাল বর্তমানে আমদানি-নির্ভর হলেও, স্থানীয়ভাবে এর উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে ১০টি বহুজাতিক কোম্পানি।
এ শিল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার টেক্সটাইল রাসায়নিকের বাজার রয়েছে, যার মাত্র ২০ শতাংশ সরবরাহ করেন স্থানীয় উৎপাদকেরা। বাকি ৮০ শতাংশ চাহিদা প্রায় ১৫টি বহুজাতিক কোম্পানি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে।
নতুন এই বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে টেক্সটাইল রাসায়নিক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করতে যাচ্ছে। এতে করে, সুলভ মূল্যে মানসম্মত কেমিক্যাল পাওয়া যাবে।
টেক্সটাইল শিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বিনিয়োগ পুরো পোশাক শিল্পেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে; কারণ পোশাক উৎপাদনে দরকারি সুতা ও তুলা উৎপাদনে বিভিন্ন রকম কেমিকেল ব্যবহার অপরিহার্য।
বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-র অতিরিক্ত পরিচালক মনসুর আহমেদ টিবিএসকে বলেন, বিটিএমএ)-র অধীনে ৩১৭টি টেক্সটাইল মিল রয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় অন্যান্য কারখানাগুলো রয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে দরকারি কেমিক্যাল উৎপাদন করতে যাচ্ছে এটা দেশের টেক্সটাইল কারখানাগুলোর জন্য বড় সুখবর'।
'এর ফলে, সুলভ মূল্যে মানসম্মত কেমিক্যাল পাওয়া যাবে। পাশাপাশি তারা উৎপাদনে গেলে আমরা যে মূল্যে উৎপাদন করি, তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে পারবে। কারণ সরকার এরকম কারখানার জন্য নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। কেমিক্যালের ওপর ভ্যাট খরচ কম পড়বে, ফলে লোকাল ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে। এছাড়াও, আমদানি করার জন্য যে সময় ব্যয় হয়, সেটিও কমে আসবে'।
মনসুর আহমেদ আরও বলেন, টেক্সটাইল কারখানায় কেমিক্যালের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। টেক্সটাইল কারখানায় সুতা থেকে কাঁচা/অপ্রক্রিয়াজাত বস্ত্র তৈরি করা হয়। এসব অপরিপক্ক বস্ত্রকে রঙ এবং আকার দেয়ার জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হয়।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইমপোর্টার্স অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন- এর সভাপতি মাজাকাত হারুন টিবিএসকে জানান, স্থানীয়ভাবে কেমিক্যাল উৎপাদন হলে ব্যবসায়ী ও টেক্সটাইল মিলারদের জন্য সুবিধা হবে। বর্তমানে তাদের এসব রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করতে এলসি খোলার সমস্যা, পেমেন্ট সমস্যাসহ বিভিন্ন ধরনের বিপত্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। 'কিন্তু, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হলে সমস্যাগুলো দূর হবে। কিছু কেমিক্যাল আমদানিকারকের ব্যবসা হয়তো সংকুচিত হবে। কিন্তু, নতুন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সাথে ব্যবসা করতে তারা ডিলারশিপ নিতে পারবে। হয়তো নতুন অনেক উদ্যোক্তাও কেমিক্যাল ব্যবসার সাথে জড়িত হতে পারবে'।
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, বহুজাতিক ও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করছে সরকার।
তিনি বলেন, এসব কেমিক্যাল বেশিরভাগ আমদানি-নির্ভর। তাই বাংলাদেশে এগুলো উৎপাদনের জন্য সরকার বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেবে। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে তারা কারখানা স্থাপন করতে পারবে।
কে কত বিনিয়োগ করছে?
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)-র সূত্রমতে, ইতোমধ্যে চারটি বহুজাতিক কোম্পানি এসব কেমিক্যাল উৎপাদনে কারখানা করার জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে। আরো পাঁচটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বিনিয়োগের প্রস্তাব বিডার কাছে জমা দিয়েছে।
এদের মধ্যে বাংলাদেশের বাজারে সবচেয়ে বড় টেক্সটাইল কেমিক্যাল সরবরাহকারী জার্মানি-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রুডলফ জিএমবিএইচ– প্রায় ৩৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫ একর জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে বলে জানিয়েছে বেজা।
রুডলফ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৌমিত্র গাঙ্গুলি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগামী মার্চ মাসে কেমিক্যাল উৎপাদনের কারখানা নির্মাণকাজ শুরু হবে। আগামী বছরের জুন মাস নাগাদ উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে'।
সৌমিত্র জানান, রুডলফ বর্তমানে জার্মানি থেকে টেক্সটাইল কেমিক্যাল সরবরাহ করে। তবে স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের মাধ্যমে কোম্পানিটি বাংলাদেশের বাজারে উৎপাদক হিসেবে নেতৃত্ব দিতে চায়। কারখানা কার্যক্রম শুরু করলে শতাধিক জনবলের নতুন কর্মসংস্থান হবে এবং এসব ব্যবসার সাথে বিপুল পরিমাণ জনবল জড়িত হবে।
তিনি আরও বলেন, 'নতুন কারখানাটি ব্র্যান্ড/খুচরা বিক্রেতা এবং তাদের সরবরাহ চেইন অংশীদারদের জন্য একটি নিরাপদ এবং স্বচ্ছ পরিপূর্ণ অংশীদার হিসাবে রুডলফের বিশ্বব্যাপী পরিষেবাগুলির অংশ হবে'।
রুডলফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং রুডলফ বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান অলিভার কুসত্রেলে বলেন, 'বস্ত্রখাতে অনন্য উদ্ভাবন থাকায় রুডলফকে এই শিল্পের একটি প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। অগ্রগামী চেতনা এবং ঐতিহ্যের সাথে অগ্রসরকারী প্রযুক্তির মেলবন্ধন এবং বিশেষায়িত দক্ষ কর্মীদল আজ আমাদের কোম্পানির কর্মকাণ্ডকে সংজ্ঞায়িত করে চলেছে'।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে দেশের টেক্সটাইল রাসায়নিক বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ দখলে রেখে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে রুডলফ।
বিডা সূত্রে জানা গেছে, জাপান-ভিত্তিক নিক্কা কেমিক্যাল লিমিটেড নারারণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে তিন একর জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে। প্রায় ২০০ কোটি টাকা প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
জার্মানি-ভিত্তিক সিএইচটি গ্রুপ মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এমইজেড) প্রায় চার একর জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে। তারাও প্রায় ২০০ কোটি টাকা প্রাথমিক বিনিয়োগ করবে।
মুন্সিগঞ্জের আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চলে তিন একর জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে হান্টসম্যান (সিঙ্গাপুর) পিটিই। এই প্রতিষ্ঠানটিও প্রাথমিকভাবে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, চলতি বছরের মে মাস নাগাদ তাদের কারখানা নির্মাণ কাজ শুরু হবে। আর আগামী বছরের শেষ নাগাদ এটি উৎপাদনে যেতে পারবে।
আরও ছয়টি কোম্পানি– সুইসকালার (সুইজারল্যান্ড), মের্ক (জার্মানি), আক্রোমা (সুইজারল্যান্ড), কুয়ুং-ইন সিন্থেটিক কর্পোরেশন (দ. কোরিয়া), নোভোজাইমস (ডেনমার্ক) এবং গ্লোবাল কেমিক্যালস কো. লিমিটেড (চীন)- প্রায় এক হাজার ৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা দিয়েছে বলে জানায় বিডার সূত্রগুলো।