জঘন্য সব কূটনৈতিক অপমানের ইতিহাস
গত ১০ ফেব্রুয়ারি রুশ পররাষ্ট্র সচিব সের্গেই লাভরভের সঙ্গে আলোচনা করতে মস্কো উড়ে যান ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস। ওই সময় নিশ্চয় ট্রাসের মনে আশা ছিল, তার হস্তক্ষেপে ইউক্রেন সংকট নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনা কমবে। কিন্তু তার আশা পূরণ হয়নি।
আলোচনার পরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লাভরভ বলেন, ওই আলোচনা ছিল 'বধিরের সাথে বোবা'র কথা বলার শামিল।
এর আগে ২০১৫ সালে লাভরভ সৌদি আরবের কর্মকর্তাদের 'নির্বোধ' সম্বোধন করেন।
তবে অপমানকে কূটনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা ব্যক্তি তিনিই প্রথম নন। বিশ্বনেতাদের কথার লড়াইয়ের ইতিহাস বহু পুরোনো।
অটোমান সাম্রাজ্যে কথার চেয়ে কাজই অবশ্য বেশি শব্দ করত। ১৫১২ থেকে ১৫২০ সাল পর্যন্ত সুলতান সেলিম দ্য গ্রিম তার সাম্রাজ্য ও মিশরের মামলুক সালতানাতের মাঝখানের বাফার রাজ্য দুলকাদিরের ওপর নিজের বিজয় ঘোষণা করতে চাওয়ার সময় কায়রোতে একজন দূত পাঠান।
কায়রোতে পৌঁছে সুলতান সেলিমের দূত একটি ব্যাগ খুলে মামলুক সুলতানের পায়ের দিকে ছুড়ে দেন। ব্যাগের ভেতর থেকে বের হয় মামলুক সুলতানের ঘনিষ্ঠ মিত্র দুলকাদিরের শাসকের কাটা মাথা।
পরের ঘটনাপ্রবাহ খুব বন্ধুত্বপূর্ণভাবে এগোয়নি। অটোমানরা শেষ পর্যন্ত মিশর আক্রমণ করে এবং জয়লাভ করে।
১৮২৭ সালে ঘটে আরেক ভয়ানক ঘটনা। ওই বছর আলজিয়ার্সের গভর্নর ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে খেপিয়ে দেন। ফলশ্রুতিতে ১৩০ বছরেরও বেশি সময় ফরাসি উপনিবেশ হয়ে থাকতে হয় আলজিয়ার্সকে।
আধুনিক কূটনীতি আগের মতো আর শারীরিক পর্যায়ে নেই, তবে কঠিন আছে আগের মতোই। স্বৈরশাসকরা স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিরোধীদের সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেন।
১৯৯৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৪ বছর ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট ছিলেন হুগো শ্যাভেজ। জর্জ ডব্লিউ বুশকে তিনি নিয়মিত মুখের কথায় তুলোধুনো করতেন। সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্টকে তিনি প্রায়ই শয়তান বলে ডাকতেন। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনা হলো, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তিনি একবার থুতু ফেলে বলেছিলেন, 'এতে এখনও সালফারের গন্ধ রয়ে গেছে।'
বাহারি সব গালি ছিল শ্যাভেজের ঝুলিতে। ২০০৬ সালে এক টেলিভিশন ভাষণে তিনি বুশ সম্পর্কে বলেন, 'আপনি একটা নির্বোধ, আপনি একটা গাধা, মিস্টার ডেঞ্জার…আপনি একটা কাপুরুষ, খুনি, গণহত্যাকারী, মদ্যপ, মাতাল এবং মিথ্যাবাদী।'
অন্য নেতাদের অবশ্য শ্যাভেজের গালির তুবড়ি শোনার ধৈর্য খুব বেশি হতো না। ২০০৭ সালে স্পেনের রাজা অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে শ্যাভেজকে বলেছিলেন, 'আপনি চুপ করছেন না কেন?'
গালাগালি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো নেতার খ্যাতি বাড়াতে না পারলেও মানুষের নজর টানতে পারে ঠিকই। জনতুষ্টিবাদী ও কর্তৃত্ববাদীরা এটাই চান। আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মান কুড়ানোর চিন্তা না করলেও এই শাসকেরা দেশবাসীকে দেখাতে চাইতে পারেন যে বহিরাগতদের সামনে তারা শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী।
প্রায় ২০ বছর আগে জিম্বাবুয়ের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে 'শর্ট প্যান্ট পরা ছেলে' বলে ঠাট্টা করেছিলেন। এই মশকরা শুনে ইংল্যান্ডে ব্লেয়ারের বিরোধীরাও হাসাহাসি করে মুগাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছিলেন।
মুগাবের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েই বোধহয় চীনা কূটনীতিকরা কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে 'বালক' বলেছিলেন।
আরও যেসব স্বৈরশাসকদের মন ও মুখে লাগাম নেই, তাদের একজন হলেন ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। ২০১৬ সালে তিনি যখন মাদকের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযান চালাচ্ছিলেন, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নও তার ব্যাপক সমালোচনা করছিল। ওই সময় দুতার্তে ইইউর উদ্দেশে মধ্যাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছিলেন।
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে 'জড়বুদ্ধিসম্পন্ন' বলে অভিহিত করেছিলেন। এর জবাবে ট্রাম্প তাকে 'রকেট ম্যান' বলেছিলেন।
তবে তীব্র অভদ্র কূটনৈতিক আক্রমণের মুখে ভদ্রতা বজায় রাখলেও সুফল পাওয়া যায়। স্থূল মৌখিক আক্রমণের চাইতে চতুরতা অবলম্বন করলে বেশি জ্বালা ধরে।
২০১০ সালে ইসরায়েলের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বৈঠকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে একটি নিচু সোফায় বসতে দেন। তা নিয়ে দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধ দেখা দেয়।
পরবর্তীতে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনকে নিচু সোফায় বসতে দিয়ে একই ধরনের কৌশল খাটানোর চেষ্টা করে। ওই বৈঠকে এরদোয়ান এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল বসেছিলেন দুটি বড় চেয়ারে।
২০০৭ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেলকে তার কালো ল্যাব্রাডর কুকুরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। যদিও পুতিন জানতেন যে মের্কেলের কুকুরভীতি আছে। পরে পুতিন দাবি করেছিলেন, 'আমি তার জন্য ভালো কিছু করতে চেয়েছিলাম।'
এরকম কূটনৈতিক অপমান ও বাদানুবাদ যে চলতেই থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আধুনিক কূটনীতি চর্চার যে ধরন, তাতে এমন কূটনৈতিক যুদ্ধ উদ্ভবের সুযোগ এখন আরও বেশি। কূটনীতিকরা এখন মিম-এর মাধ্যমে কূটনৈতিক যুদ্ধ চালান।
২০১৮ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইসরায়েলকে 'একটি মারাত্মক ক্যান্সার টিউমার' অভিহিত করে একটি টুইট করেন। জবাবে যুক্তরাষ্ট্রস্থ ইসরাইয়েলের দূতাবাস 'মিন গার্লস' সিনেমার একটি স্ক্রিনশট টুইট করে। সিনেমাটির কাহিনি আবর্তিত গুজবপ্রিয় হাই-স্কুল শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে। ইসরায়েলি দূতাবাসের টুইটের ক্যাপশন ছিল, 'আমাকে নিয়ে তুমি এত মোহগ্রস্ত কেন?'
- সূত্র: দি ইকোনমিস্ট