ওয়ালস্ট্রিট বলছে মন্দা আসছে, ভোক্তারা বলছেন মন্দা শুরু হয়ে গেছে!
নিউইয়র্ক মহানগরের ওয়ালস্ট্রিট—পুঁজিবাজার, বিনিয়োগ ব্যাংক ও ব্রোকারেজ সংস্থার বৈশ্বিক এক কেন্দ্র। বিশ্ব অর্থনীতির হাল-হকিকত দুনিয়ার শীর্ষতম অর্থনীতি আমেরিকায় (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ওয়ালস্ট্রিট-ই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেয়। আর এখানকার বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক মাস ধরেই মন্দার পূর্বাভাস দিচ্ছেন। দিন যত যাচ্ছে মন্দা নিয়ে সতর্কবাণী ততোটাই জোরালো হচ্ছে। তবে বিশ্ব অর্থনীতির অনেক ভোক্তাই মনে করছেন, মন্দা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তারা দৈনিক জীবনযাপন আর কর্মক্ষেত্রে তারই প্রভাবের শিকার হচ্ছেন।
মন্দা সম্পর্কে ভোক্তাদের এমন পর্যবেক্ষণ গভীর ইঙ্গিতবহ। আমেরিকানরা তারই অশনি ছায়া দেখতে শুরু করেছে চারপাশে। যেমন জিনা পালমারের কথাই বলা যাক। 'শি সেলুন' নামে একটি সেলুন চালান তিনি আটলান্টা নগরীর প্রাণকেন্দ্র নর্থসাইড ড্রাইভে। সাধারণত প্রতি শুক্রবারে খদ্দেরের ভিড় থাকতো অসম্ভব। কিন্তু, গত মাস থেকেই বদলাতে শুরু করেছে চিত্র। শুক্রবারের সেই ভিড়ভাট্টা আর একেবারেই নেই। অন্যান্য দিনের কর্মব্যস্ততাও হারিয়েছে, এখন কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া সেলুনটি বেশিরভাগ সময় ফাঁকা ফাঁকাই থাকে।
জিনা জানান, খাদ্য ও জ্বালানির মতো নিত্যপণ্যের দাম চড়া। সামনেই গ্রীষ্মকালীন স্কুল ছুটি। আমার গ্রাহকদের অনেকেই অভিভাবক। তারা সন্তানদের 'সামার ক্যাম্পে' এবার কীভাবে পাঠাবেন সেই চিন্তায় মগ্ন। হয়তো সেকারণে বাড়তি খরচে লাগাম টেনেছেন।
"মানুষ যখন নিজের বাজেট নিয়ে চিন্তিত হয়, তখন প্রথমেই বাদ দেয় ব্যক্তিগত পরিচর্যা। আগে যেসব গ্রাহক প্রতি সপ্তাহে আসতেন, তাদের অনেকেই এখন দুই সপ্তাহ পর আসছেন। আর পাক্ষিক গ্রাহকেরা আসছেন পাঁচ-ছয় হপ্তা পর পর।"
আটলান্টিকের অপর পাড়ে, ৪,০০০ মাইল দূরে ইংল্যান্ডও ধুঁকছে। উত্তর ইংল্যান্ডের এক পানশালা 'বাক ইন' এর মালিক অ্যাবি মার্শাল। ক্রমে বেড়ে চলা খরচের সাথে যুঝতে হচ্ছে এই নারী উদ্যোক্তাকেও। গেল বছর পাবটি কেনেন তিনি। তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ শতাংশ, যা এখন ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে দুই অঙ্কের দিকে এগোচ্ছে।
বাধ্য হয়ে এ পর্যন্ত চারবার মেন্যুতে পরিবর্তন এনেছেন অ্যাবি। তিনবার বাড়িয়েছেন এক পাইন্ট বিয়ারের দাম।
অর্থনীতির সংজ্ঞায় পর পর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হলে, তবেই তাকে মন্দা বলা যেতে পারে। কিন্তু, অ্যাবি ও জিনার মতো ব্যক্তিদের কাছে তা অপ্রাসঙ্গিক। ভোক্তাদের ব্যয় সংকোচন তারা হাতেনাতেই প্রমাণ পাচ্ছেন। দেখছেন ব্যবসায় ভাটা।
গোল্ডম্যান স্যাক্স গ্রুপ ইনকর্পোরেশনের অর্থনীতিবিদেরা আগামী বছরে আমেরিকায় মন্দার ঝুঁকি ৩০ শতাংশ রয়েছে বলে অনুমান করছেন। একইসময়ে ৩৮ শতাংশ ঝুঁকির অনুমান করা হয়েছে ব্লুমবার্গের একটি ইকোনমিক্স মডেলে। এই সময়ের পরও মন্দার সম্ভাব্যতা থেকেই যাবে।
অনেক আমেরিকান অবশ্য মনে করেন এরমধ্যেই গতি হারিয়েছে অর্থনীতি। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মার্কিনীর বিশ্বাস অর্থনীতি একটি মন্দার মধ্যে পড়েছে। গত মাসে সিভিকসায়েন্স নামক এক সংস্থার জরিপে উঠে আসে এ জনমত।
বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি হার নির্দেশক সূচকগুলি মানুষের জনতার দুর্ভোগকে তুলে ধরে। এজন্য তাদের সমষ্টিকে 'মিজারি ইনডেক্সেস'ও বলা হয়। এই সূচক এখন প্রতিভাত করছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও অন্যান্যদের উদ্বেগকে। ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের মতে, আমেরিকায় দুর্ভোগ সূচক এখন ১২.২ শতাংশে রয়েছে, ঠিক এই মাত্রায় সূচকটির অবস্থান দেখা গিয়েছিল করোনা মহামারির শুরুর দিকে এবং ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের প্রাক্কালে।
যুক্তরাজ্যেও দুর্ভোগ সূচক উপরের দিকে অবস্থান করছে। আর্থ-সামাজিক অন্যান্য পরিমাপকও যা সমর্থন করছে। মার্কিন ভোক্তাদের প্রত্যাশা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্নে রয়েছে। ওইসিডি জোটভুক্ত উন্নত অর্থনীতিগুলোয় ভোক্তাদের আস্থা টানা ১১ মাস ধরে কমছে। ২০০৯ সালের পর এমন নিম্নাবস্থা আর দেখা যায়নি।
আলিয়াঞ্জ এসই'র প্রধান অর্থনীতিবিদ লুদভিক সাব্রান বলেন, "মানুষ আরও দরিদ্র হচ্ছে। একে সংজ্ঞার ভিত্তিতে মন্দা বলা না গেলেও, এর অনুভব ও অভিজ্ঞতা মন্দারই মতো।"
এমন হওয়ার কারণ একটাই। দুনিয়াজুড়ে প্রায় সকল পণ্য ও সেবার দাম আকাশ ছুঁতে চাইছে দিনকে দিন। বিশেষ করে তা যেন চরম সত্য খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দামে। এতে পরিবারগুলির ব্যয় সক্ষমতায় টান পড়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম ধরতে ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি, কিন্তু তারা সুদহার বাড়ানোয় তারল্য প্রবাহ কমছে, বাড়ছে ঋণ গ্রহণ ও বিনিয়োগের খরচ। ফলাফল ব্যবসাবাণিজ্যে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতেও ভাটা। জীবনযাপনের ব্যয় অনুযায়ী বেতন বাড়ছে না কর্মীরাও সে অভিযোগ তুলছেন। এই অসন্তোষে অনেক দেশেই হচ্ছে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ।
অর্থাৎ, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় চোখের পলকে ফাঁকা হচ্ছে ভোক্তার পকেট, আমজনতার শঙ্কা পরিস্থিতি আরও বাজে মোড় নিবে।
২০২২ সালের অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও এসময়ে নতুন করে চিন্তিত হওয়ার অনেক কারণ যোগ হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপের সাথে এসময়ে 'বোঝার ওপর শাকের আঁটি' হয়ে ভর করেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হারিয়ে যাওয়ার আভাস। এই বছর ছাড়িয়ে প্রবৃদ্ধির এই ঘাটতি থাকতে পারে ২০২৩ সালেও। আর তাতেই শুরু হয়েছে স্ট্যাগফ্লেশনের আলোচনা। এই ধরনের পরিস্থিতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে সাথে একেবারেই সামান্য বা শূন্য প্রবৃদ্ধির জঘন্যতম মিশ্রণ।
অথচ ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে বেশ উজ্জ্বল সম্ভাবনার আভাস দেওয়া হয়েছিল। সব ছক বদলে দিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। অনিশ্চয়তা শুধু যুদ্ধের কারণেই হচ্ছে তা নয়। কিন্তু, সুদিনের আশা একেবারেই ঝেরে ফেলতে হচ্ছে অর্থনীতিবিদদের।
গত মাসে ওইসিডি তাদের বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিয়ে দেওয়া পূর্বাভাস সাড়ে ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করেছে। আগামী বছরে বিকাশের অনুমান করছে আরও কম। বিশ্বব্যাংকও তাদের প্রক্ষেপণ কমিয়েছে। একইসাথে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত এমন হুঁশিয়ারি।
সতর্কঘণ্টা বাজছে পুঁজিবাজারেও। আমেরিকার শীর্ষ পাঁচশ কোম্পানির সার্বিক সূচক এসঅ্যান্ডপি-৫০০ জানুয়ারিতে যে উচ্চ অবস্থানে ছিল সেখান থেকে ২০ শতাংশ নিচে নেমেছে। সর্ব ইউরোপীয় কোম্পানির সূচক স্টোক্স ইউরোপ-৬০০ এর পতন হয়েছে ১৯ শতাংশ।
পুঁজিবাজারের ভয়ের বাতাবরণ বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরায়। তাই বাজার ব্যবস্থাপক সংস্থার দেওয়া সতর্কবার্তা পরিণত হতে পারে মন্দার অনুঘটক। অর্থাৎ, মন্দার শঙ্কাতে ভোক্তারা খরচ কমাবেন। ব্যবসাগুলিও খরচে লাগাম দিতে থাকবে, আর তাতে প্রবৃদ্ধি হারাতে পারে আরও দ্রুতগতিতে। এতে অর্থনীতির চাহিদা কমে গিয়ে, মন্দার ঘূর্ণিপাকে পড়বে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ অবলম্বনে