সব পণ্য উৎপাদনে কার্বন করারোপ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার চায় বিশ্বব্যাংক
সবুজ প্রবৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়া এবং সব ধরনের উৎপাদন কার্যক্রমে কার্বন কর আরোপের পক্ষে মত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মতামত, মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা জানতে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি।
দেশের অর্থবিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ (ইআরডি) আরো কিছু বিভাগকে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়।
এদিকে ইআরডি ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গ্রিন বা পরিবেশ-বান্ধব প্রবৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্প্রতি বাজেট সহায়তা আলোচনা শুরু হয়েছে। এই বাজেট সহায়তা কমপক্ষে ২৫০ মিলিয়ন ডলার হতে পারে।
বাজেট সহায়তার শর্ত হিসেবে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসা এবং কার্বন ট্যাক্স আরোপের বিষয়টি উঠে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিকল্প নীতি গ্রহণ করে জ্বালানি খাতে ভর্তুতি বরাদ্দ এবং কার্বন কর থেকে অর্জিত অর্থ দরিদ্র মানুষের মধ্যে পুনঃবন্টনের পরামর্শ দিয়েছে দাতা গোষ্ঠীটি।
কার্বন নিঃসরণ কমাতে ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এই ব্যবস্থায় একটি কার্বন বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে দূষণের ওপর সীমা আরোপ করা হয়।
এর আওতায় সরকার একটি দূষণ সীমা নির্ধারণ করে এবং ওই সীমা অনুসারে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ করা যাবে তা নির্ধারণ করে দেয়।
নিঃসরণকারী প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিঃসৃত প্রতি টন গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য একটি মূল্য পরিশোধ করতে হয়। এর আওতায় কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যেও অনুমোদিত নিঃসরণ সীমা লেনদেন করতে পারে। যেসব কোম্পানি কম খরচেই তাদের নিঃসরণ কমাতে পারে, তারা তাদের উদ্বৃত্ত বরাদ্দ যেসব কোম্পানিকে বেশিমূল্যে কিনতে হচ্ছে তাদের কাছে বিক্রি করে দিতে পারে।
ক্যাপ-এন্ড-ট্রেড পদ্ধতি চালু করেছে এমন দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে- ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়া। সবাই তাদের কার্বন নির্গমনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশে কঠোর সীমা নির্ধারণ করেছে।
নতুন নীতিতে স্থানান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে তা নিজস্ব বিশ্লেষণে তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ জ্বালানিতে ভর্তুকি সমন্বিতভাবে প্রত্যাহারের বিকল্প নীতি পরীক্ষায় দেখা গেছে, এতে করে মূল্য অসামঞ্জস্যতা দূর হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ অর্থনীতিতে সরকার রাজস্বের স্থানান্তরের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে। অন্য কথায়, জ্বালানি খাতের সরকারি ভর্তুকি তহবিলের পুনর্বন্টন সামগ্রিক অর্থনীতিতে সম্পদের আরও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করে।
তবে অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে জ্বালানির মূল্য ক্রমাগত বাড়ছে, এই অবস্থায় জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার দেশের অর্থনীতিকে চাপের মধ্যে ফেলবে।
"এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। মানুষের আয়ের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে, মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। এসব কারণে বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভর্তুকি স্বল্প মাত্রায় ধীরে ধীরে উঠিয়ে নেওয়া যেতে পারে," উল্লেখ করেন তিনি।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি খাতের বরাদ্দ রয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে, এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি আগের অর্থবছরের ১১,৩০০ থেকে বেড়ে ১৩,৩০০ কোটি টাকা হয়েছে।
কার্বন করের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ বলছে, "পৃথক কর এবং ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড ব্যবস্থার আওতায় সমন্বিত করের মতো বেশকিছু বিকল্প আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। উভয় ক্ষেত্রে সরকারি রাজস্ব বাড়াতে এবং দরিদ্রদের প্রতি পুনর্বন্টন কর্মসূচি সম্পাদনে করের আয় ব্যবহার করার প্রভাবের দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে।"
দরিদ্রদের মধ্যে কার্বন করের অর্থ পুনর্বন্টনের দৃশ্যপট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এতে সামাজিক সুফল লাভে সবচেয়ে ভালো পারদর্শিতা যোগ হয়।
কার্বন কর বিষয়ে মুজেরি বলেন, "এটা আরোপ করা হলে পণ্যের দাম বাড়বে। ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। এটা ধীর গতিতে সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্যে করা যেতে পারে। আবার রপ্তানি পণ্যে এখনই কার্বন ট্যাক্স আরোপ করা সম্ভব নয়, তাহলে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে যেতে পারে।"
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, "আরএমজি সেক্টরে আমাদের দেশে গ্রিন (পরিবেশ-বান্ধব) কারখানা হচ্ছে। এখন এ বিষয়ে কতটা কঠোর হওয়া যায়, সে দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। আবার এত কঠোর হলেও হবে না- যাতে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়।"
ভর্তুকির বিষয়ে তিনি বলেন, "আমাদের উদ্বেগ ভর্তুকি নিয়ে না; আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো- কত দরে আমাদের জ্বালানি কিনতে হবে। এখন যদি আরেক দফা তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ে তাহলে ভয়াবহ বিপদ হবে।"
বিজেএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ মেনে সরকার যদি জ্বালানি খাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে তাহলে উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
"এতে করে জ্বালানির মূল্য আরও চড়া হবে, ফলে আমরা রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগী সক্ষমতা হারাব," যোগ করেন তিনি।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) একটি দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগের অংশ হিসাবে বেশ কয়েকটি খাতে কার্বন কর আরোপ করতে চাইছে, যা ইইউ'র গ্রিন ডিল নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য- গার্মেন্টস ও চামড়াজাত পণ্য এর প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হলেও- ঝুঁকি তালিকায় থাকায় ভবিষ্যতে যেকোনো সময় যুক্ত হতে পারে বলে সতর্ক করছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, নিঃসরণ কমাতে এবং ইউরোপের বাজারে নিজ পণ্যের ওপর কার্বন কর এড়ানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই চীন তাদের নিজস্ব কার্বন কর চালু করেছে। ভিয়েতনাম ও ভারতসহ বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রতিযোগী দেশও এ উদ্যোগ নিয়েছে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) ইইউর কার্বন চুক্তির আলোকে কার্বন ট্যাক্স, কার্বন বাজার সৃষ্টি, বিশ্ব বাণিজ্য এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছে।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ইউরোপ প্রাথমিকভাবে ছয়টি খাতকে কার্বন করের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং এখনো আমদানি পণ্যের জন্য তা চালু করেনি। ফলে বাংলাদেশে এখনই কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই।
"তবে আমাদের তৈরি পোশাক এবং চামড়াজাত পণ্যগুলো ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে এবং যদি এটা ২০২৬ সালের পরে চালু করা হয়, তবে আমাদের পণ্যগুলো এন্ট্রি ট্যাক্সের আওতায় পড়বে। যার ফলে আমাদের তখন বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে," তিনি বলেন।