দুইশ বছরের কাজী বাড়িতে হেরিটেজ লাঞ্চ, ব্রেকফাস্ট আর ডিনার!
পুরোনোর মাঝে নিজের শেকড়কে যারা খুঁজে ফেরেন তাদের জন্য পুরোনো বাড়ি মানেই এক রহস্যময় গুপ্ত ভাণ্ডার। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেসব বাড়ির দেয়ালের কারুকাজ, জানলার কপাট, বারান্দার গ্রিলও যেন ইতিহাস বলে যায়। কিন্তু কাছ থেকে সেসব ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার সুযোগ এ দেশে খুব কমই মেলে।
পাশের দেশ ভারতে এখন হেরিটেজ হোটেলের ধারণা বেশ জনপ্রিয়। এধরনের হেরিটেজ হোটেল বা হেরিটেজ হোমের ভেতর ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ঘুরে দেখার পাশাপাশি আছে থাকা-খাওয়ার রাজকীয় সুবিধা। বর্তমানে থেকেও ঐতিহ্যের ঘ্রাণ নিয়ে আসা যায় সেখান থেকে।
ঐতিহ্যপ্রেমীদের কথা চিন্তা করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনায় এমন হেরিটেজ হোমের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঐতিহ্য সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা সংস্থা আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা তাইমুর ইসলাম। তার সাথে কথা বলেই জানতে পারি কাজী বাড়ি হেরিটেজ এস্টেটের কথা। পুরান ঢাকার কাজী আব্দুর রউফ রোডে অবস্থিত কয়েক শত বছর পুরোনো সেই বাড়িতে আপাতত থাকার ব্যবস্থা না হলেও বাড়ির ভেতরে ঘুরে দেখা ও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন আছে।
গুগল ম্যাপের নির্দেশনা মেনে আর এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে বাহাদুর শাহ পার্ক ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম কাজী বাড়ির খোঁজে। প্রথমে কবি কাজী নজরুল সরকারি কলেজ, এরপর কলেজের পেছনে কাজী আবদুর রউফ সড়ক ধরে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে একটি কালো লোহার গেটের সামনে দাঁড়ালাম। বাইরে থেকে দেখলে কোনো বিশেষত্ব চোখে পড়ে না। কয়েক শত বছরের ইতিহাসের আঁচ পাওয়া তো দূরের কথা পুরো বাড়িটার আকৃতিও বোঝা যায় না বাইরে দাঁড়িয়ে।
বংশানুক্রমে বাড়িটির দেখভালের দায়িত্বে আছেন কাজী এহসান উল আলীম এবং কাজী সাদ উল্লাহ হিল আলীম। কাজী বাড়ি হেরিটেজ এস্টেটের আয়োজক কাজী সাদ। তার সাথে কথা বলেই দিনক্ষণ ঠিক করে এসেছিলাম। ভেতরে ঢুকতেই দেখা হলো তার সাথে। বাড়ির অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা গল্প তিনি জানিয়েছিলেন আপ্যায়নের ফাঁকে।
ধর্ম প্রচারের জন্য ভারত ভূখণ্ডে এসেছিলেন তারা
কাজী বাড়ি নামকরণ করা হয় ১৮৯২ সালে। যখন কাজী আব্দুর রউফ ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে 'শহর কাজী' হিসেবে নিযুক্ত হন। তার দায়িত্ব ছিল মুসলিম আইনে সব মামলা মোকাদ্দমার বিচার করা। তখন থেকেই মুসলিম কোর্ট হিসেবে বাড়িটিকে কাজী বাড়ি নামে ডাকতো সকলেই। কিন্তু তার আগে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে কাজী আব্দুর রউফ তাহলে কে? এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা কি তাহলে আব্দুর রউফ? না, মোটেই তা নয়। এই বাড়ির বুনিয়াদ স্থাপিত হয় আরও আগে। সে-ই মোগল যুগে...।
অনেকে বলেন এই বাড়ির পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন আরব দেশ থেকে, আবার অনেকে বলেন মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিলেন তারা। এই নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও, কাজী সাদ উল্লাহ হিল আলীম বলেন, "আমার কাছে কিছু পারিবারিক কয়েন ছিল। যেগুলো দিয়ে আমি ছোটোবেলায় খেলতাম। ঐ কয়েনগুলোর মধ্যে কোনোটায় মদীনা শরীফের ছবি ছিল, কোনোটায় মসজিদের ছবি ছিল। কিছু পার্সিয়ান কয়েন ছিল, সুলতান মাহমুদ গাজনীর সময়কার কিছু কয়েন, মোগল আমলের চারকোণা কয়েন, রূপোর কয়েনও ছিল। সে থেকে আন্দাজ করতে পারলাম যে, এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা হয়তো ঐসব দেশ থেকেই এসেছিলেন।"
ধর্মপ্রচারের কাজেই তার পূর্বপুরুষেরা এই এলাকায় এসেছিলেন বলে জানান সাদ। পীর বংশ ছিল তাদের। আশেপাশের এলাকার অধিবাসীরা ছিলেন এই পীরদের মুরিদ। কয়েক শতাব্দী আগে জঙ্গল পরিস্কার করে এখানে মসজিদ নির্মাণ করে ধর্ম প্রচার শুরু করেন বাড়ির পীর সাহেব সৈয়দ আহমেদ বখস। সে সময়েই গোড়াপত্তন হয় এই পরিবারের। পীর বংশেরই পরবর্তী প্রজন্ম কাজী আব্দুর রউফ।
কাজী বাড়ির ইতিহাসের একটি শক্ত অবস্থান জুড়ে আছে মসজিদটি
ধর্মের বিষয়টি যে এখানে বেশ মূখ্য তা স্পষ্ট হয়েছিল বাড়ির ভেতরে প্রবেশের সময়েই। বাড়ির নিচতলায় একদিকে কাগজিদের কাজ চলছে, অন্যদিকে কিছু পরিবারের বাস। নিচে কিছু ব্যায়ামের সরঞ্জামও চোখে পড়ে। তারই একপাশে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে তিনটি কবর। তিনটি কবরই ফার্সি ভাষায় ক্যালিগ্রাফি করা। বোঝা যায়, একসময় বেশ আধিপত্যের সঙ্গেই টিকে ছিলো এই বাড়ির মানুষেরা। ক্যালিগ্রাফিগুলো জানান দিচ্ছে এই বাড়ির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অন্যান্য বাড়ি থেকে কোথায় আলাদা।
কিন্তু জলাজঙ্গলে জৌলুস হারানো উঠান দেখেই বোঝা যায় বাড়ির ঐতিহ্যতে বেশ ভাটা পড়েছে। প্রাচীন নকশায় নির্মিত কাজী বাড়ির মসজিদটি সে তুলনায় বেশ যত্নে আছে। মসজিদটির দিকে একপলক তাকালেই বোঝা যাবে এর নির্মাণশৈলী, স্থাপত্যশৈলী আর নকশা কতটা বৈচিত্র্যময়। সাদ জানান, তখনকার দিনের আর্কিটেকচারাল ডিজাইন অনুসারে মসজিদের উপরে চিনি টুকরা বা প্লেট ভেঙ্গে করা ছোট ছোট গ্লাসের টুকরা দিয়ে নকশা করা হয়েছে। এর সাথে আছে কিছু মোগল আমলের কাঠামো। মসজিদের ভেতরে আছে কষ্টি পাথরের শিলালিপি।
কাজী বাড়ির ইতিহাসের একটি শক্ত অবস্থান জুড়ে আছে এই মসজিদটি। এটি সংস্কার করে এর ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মৌলভী কাজী আব্দুল রউফ, তার ছেলে মৌলভী রহিম বখসসহ বাড়ির অন্যান্য উত্তরসূরী।
সদর দরজার উপরে খোদাই করে লেখা আছে স্বপ্নাদেশের কথা!
কথিত আছে, স্বপ্নে মসজিদ সংস্কার করার নির্দেশ পেয়েছিলেন কাজী আব্দুর রউফ। এরপরই তিনি কাজী বাড়ির সেই মসজিদটি সংস্কার করেছিলেন। মসজিদের সদর দরজার উপরেও খোদাই করে লেখা আছে তার এই স্বপ্নাদেশের কথা।
ব্রিটিশ আমলে মুসলিমদের নিরাপত্তার শঙ্কায় ঢাকায় জুম্মার নামাজ পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মৌলভী রহিম বক্স (কাজী আব্দুর রউফের বাবা) তখন এর প্রতিবাদ জানান। তিনি কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজ যুক্তির পক্ষে ফতোয়া এনে নিজ বাড়ির মসজিদেই শুরু করেন জুম্মার নামাজ যা এখনো জারি রয়েছে। পারিবরিক মসজিদ হলেও এলাকাবাসী এখানে নামাজ পড়তে আসে। সম্ভ্রান্ত বংশের অনেকের বিয়েও পড়ানো হতো এই মসজিদে।
বর্তমানের এই স্থাপনাটি ১৮২০ সালে তৈরি করেন কাজী মির্জা এলাহী বখস
তিনি ছিলেন সাদের ৫ম পূর্বপুরুষ, যাঁর তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে জড়িত ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহে। বিপ্লবী হিসেবে যাদের একজনকে শাস্তি স্বরূপ কামানের গোলার সঙ্গে বেঁধে উড়িয়ে দেয়া হয়। আরেকজনকে নির্বাসিত করা হয় কালাপানি কারাগারে।
মসজিদের সাথে লাগোয়া কারুকার্য খচিত সাদা দোতলা বাড়ি। বাড়ির অনেকগুলো দিক, অনেকগুলো দরজা আর সিঁড়ি। প্রথমবার গিয়ে রাস্তা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। ভবনের একেবারে বাইরের টানা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে পেয়ারা গাছ ঘেরা ছোট একটি খোলা জায়গা। একপাশের দেয়ালে সেগুন কাঠের নকশাকৃত দরজা-জানালা, সাথে রোমান আর অ্যারাবিক কারুকাজের ছড়াছড়ি যে কারো নজর কাড়তে বাধ্য। দরজাগুলো দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে বিশাল একটা পড়ার ঘর। দুটি দেয়ালের নিচ থেকে উপর পর্যন্ত বইয়ের তাক। সাদ জানান, তার বাবা কাজী আব্দুল আলীমের ছিল প্রায় ছয় হাজার বইয়ের সংগ্রহ।
পড়ার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ঘরটি বিশাল বড়। একটি বিছানা, একটি পালঙ্ক, পুরোনো দিনের আরও কিছু আসবাবপত্র। তার পাশের ঘরে ডাইনিং টেবিল পাতা অতিথিদের খাবার ঘর, আর সামনেই সোফা, শো কেস আর গ্রামোফোনে সাজানো বসার ঘর। বসার ঘর আর খাবার ঘরের সাথে লাগোয়া টানা বারান্দায় আলো-ছায়ার খেলা।
পুরো বাড়ির দেয়াল জুড়েই রয়েছে তলোয়ার, বিভিন্ন ঝাড়বাতি আর পুরনো যুগের সব আর্ট, এন্টিক সামগ্রী আর পুরোনো আসবাবপত্র। বাড়ির বাইরের দিকটা যতটা হেয়ালী মনে হয়েছে, ভেতরটা কিন্তু মোটেই তেমন নয়। সবকিছু সযত্নে রাখা।
বাড়ির যে ঘরগুলো এখন পর্যটনের জন্য ব্যবহার করা হয়, সেই পুরোটা জুড়ে ছিল সে আমলে কাছারি ঘর বা এজলাস ঘর। এটি মূলত বাড়ির বাহিরমহল। বাড়ির অন্দরমহল এখন বন্ধ পড়ে থাকে। বেশিরভাগই দখলদারদের কাছে আবদ্ধ। দোতলার অন্দরমহলের বারান্দা ঘুরে দেখা যায় দেয়ালের সুনিপুণ কারুকার্য।
পূর্বপুরুষের নামে রাস্তার নাম, কাজী আব্দুর রউফ রোড
আগেই বলা হয়েছে এই বাড়ির নামকরণ করা হয় আব্দুর রউফের 'শহর কাজী' হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর। পরবর্তীতে তার নামেই এলাকার রাস্তার নাম হয়, কাজী আব্দুর রউফ রোড। সুতরাং এ বাড়ির ইতিহাসে রউফ সাহেবের অবদান অপরিসীম। কিন্তু মজার কথা হলো, এই কাজী আব্দুর রউফের আগে তার পূর্বপুরুষদের নাম ছিল সব 'মির্জা' পদবী দিয়ে। যেটা আমরা মির্জা এলাহী বখসের নামের সঙ্গে দেখতে পাই। কিন্তু তাদের আগমন পারস্য অঞ্চল হওয়ায় তারা ছিলেন শিয়া ধর্মাবলম্বী। যার ফলে, এখানে এসে তাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। তাই পরবর্তীতে এই নাম পালটে ফেলতে হয়। অর্থাৎ শিয়া থেকে তারা সুন্নী হয়ে যান। আর এই পদবী পরিবর্তনটি হলো কাজী আদুর রউফের নাম ধরেই।
১৮৯১ সালে কাজী সাহেব ঢাকা মাদ্রাসা থেকে পাশ করেছিলেন। তখনকার দিনে বংশ এবং ঘরানা অনুযায়ী সরকারি চাকরি দেওয়া হতো। আব্দুর রউফ তাই ব্রিটিশদের অধীনে 'শহর কাজী' হিসেবে নিযুক্ত হলেন। তার বিচারাধীন এলাকা ছিল ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সোনারগাঁওসহ একটি বৃহৎ অঞ্চল। তখনকার দিনে মুসলিমরা ইংরেজি কোর্টে যেত না, কারণ সেখানে খ্রিস্টানদের আইনুযায়ী সব চলে। তাই মুসলিমদের সকল ধরনের সমস্যা নিয়ে কোর্ট কাছারি বসতো এই বাড়ির এজলাস ঘরেই।
শিল্পী গওহরজানও নাকি এসেছিলেন এই বাড়িতে
পীর বংশের মানুষ হয়েও আবদুর রউফ ছিলেন একজন আধুনিক এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির মানুষ। কোনো ধর্মান্ধতা বা গোঁড়ামো তার ছিল না। যেভাবে তিনি ধর্মীয় দিক সামলেছেন, সেভাবে সামলেছেন ইংরেজদের। তাই তৎকালীন ছোটোলাট থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবারই পা পড়েছে এই বাড়ির মাটিতে। বাড়িতে প্রায়ই বড় বড় উৎসবের আয়োজন হত। শিল্পী গওহরজানও নাকি ১৮৯০ সালে একবার এই কাজী বাড়ির এক জলসা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। উনিশ শতকে ঢাকার নবাব আব্দুল গণির দরবারে যেসব বিখ্যাত বাঈজীরা নাচ গান করতেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এই গওহরজান বাঈজী।
নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে পদচারণার ক্ষেত্রেও আছে কাজী বাড়ির অবদান
বাংলাদেশের অন্যতম ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক এবং লেখক ছিলেন কাজী বাড়ির অন্যতম বংশধর কাজী আবদুল আলীম। বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষাকেন্দ্র বিকেএসপি'র (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন তিনি। ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে 'জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার'; ১৯৯৩ সালে 'স্বাধীনতা পদক' এবং ২০০৪ সালে 'ইউনেস্কো এ্যাওয়ার্ড'-এ ভূষিত হন কাজী আব্দুল আলীম।
নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে পদচারণার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। তার বোন কাজী জাহেদা, কাজী নাসিমা ও কাজী শামীমাকে তিনিই ক্রীড়াঙ্গণে নিয়ে আসেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গনে যাদের মুখ ছিল শীর্ষ অবস্থানে।
'হেরিটেজ লাঞ্চ, ব্রেকফাস্ট এন্ড ডিনার সার্ভিস'
পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় ২০০ মিটার দূরত্বে স্থাপত্য নিদর্শন আর ইতিহাসের সম্মিলনে ১৯৯ বছরের পুরনো এই কাজী বাড়িতে ঐতিহ্যপ্রিয় দেশি-বিদেশিদের জন্য আছে 'হেরিটেজ লাঞ্চ, ব্রেকফাস্ট এন্ড ডিনার সার্ভিস'। ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিক, কয়েকটি কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা ইতোমধ্যে ভ্রমণ করেছেন এই বাড়িটিতে। জেনেছেন মোগল-ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সময়ের রাজনীতি এবং ক্রীড়ায় বাক বদলের ইতিহাসের সঙ্গে কাজী বাড়ির সম্পৃক্ততার গল্প। ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ শিল্প আর এন্টিক আসবাবপত্রের মাঝে সময় কাটিয়েছেন তারা। খাবারের ক্ষেত্রে কখনো তাদের জন্য থেকেছে পোলাও কোরমা, আবার কখনো একদমই মাছে ভাতে ভর্তা বাঙালির খাবার।
বাঙালির পারিবারিক আপ্যায়নের আবহ ও পুরান ঢাকার বাহারি খাবারের ঘরোয়া স্বাদ নিয়ে এ আয়োজনে গত কয়েক বছরে অংশ নিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফরাসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতসহ মিশনগুলোর কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। বিদেশি এবং দেশিদের জন্য খাবারে কিছুটা পার্থক্য আছে। সাদ চেষ্টা করেন, বিদেশিদের জন্য আঞ্চলিক কিছু খাবারের আয়োজন করতে। বর্তমানে দুপুরের খাবারে জনপ্রতি খরচ হয় ৮০০ টাকা, সকালের নাস্তায় খরচ হয় ২৫০ টাকা। কাজী বাড়ির আতিথিয়তা গ্রহণ করতে চাইলে একদিন আগেই কাজী সাদ উল্লাহ হিল আলীমের সাথে যোগাযোগ করে নিতে হবে৷ তাদের ফেসবুক পেজ ''Qazi Bari Heritage Estate" এ জানা যাবে বিস্তারিত।
কাজী বাড়ি যেন এক অতিথি সেবার বাড়ি
বাড়িতে ঢোকার পর থেকে বের হয়ে আসা পর্যন্ত কখনোই মনে হবেনা, এটি কোনো হোটেল। মনে হবে যেন, নিজ আত্মীয়ের বাসা। বাড়ির প্রতিটা জিনিস ঘুরে দেখে আর কাজী সাদের বর্ণনা শুনে দেয়ালের নকশা থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে নিজেকে খুব আপন অনুভব হয়। আয়োজক সাদের পরম আতিথেয়তার কারণেই সম্ভব হয় তা। নিজের টাকায় খরচ করেও চড়ুইভাতির আয়োজনের স্বাদ পাওয়া যায় এখানে। বাড়ির ছাদে অতিথিদের জন্য বার-বি-কিউ আর পিকনিকের ব্যবস্থাও আছে।
খাবারের জন্য শুধু পোলাও-কোরমা বা ভর্তা-ভাতই নয়, চাইলে নিজেদের পছন্দের খাবারের চাহিদা আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া যায়। যদিও প্রফেশনাল কোনো বাবুর্চি নেই, তবু সাদের চেষ্টা থাকে অতিথিদের যথাযথ তৃপ্তি দেওয়ার। এছাড়া সামনে পরিকল্পনা আছে ব্যতিক্রমী কিছু ভিন্ন ধারার খাবারের আয়োজন রাখার। যাতে দেশি হোক, বিদেশি হোক, সকলেই খেয়ে তৃপ্তি পায়।
আগস্ট থেকে এখানে থাকছে রাতে কাটানোর সুযোগ
চলতি বছরের আগস্ট থেকে এখানে রাতে থাকার আয়োজন করছেন সাদ। তিনি জানান, দর্শক এবং পুরান ঢাকাপ্রেমীদের জন্য তিনি সকালে আর দুপুরে খাওয়া ছাড়াও রাতে থাকার ব্যবস্থা করছেন। যাতে প্রাচীন এসব স্থাপত্যপ্রেমীরা সারাদিনের জন্য এসে খেয়ে, সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরে, রাতটাও কাটিয়ে দিতে পারে এই নবাবী কায়দাতেই। সেই সাথে, চাইলে রাতের বেলা মোমবাতি জ্বালিয়ে ভূতুড়ে গল্প করারও আয়োজন থাকবে!
'আমাদের পরিবারটি প্রায় পাঁচশ বছরের এক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত'
নিজের শেকড়টাকে জানার জন্য চাকরি ছেড়ে পূর্বপুরুষের পাঁচশো বছরের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন কাজী সাদ উল্লাহ হিল আলীম। পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে একটি বইয়ের খসড়াও তৈরি করেছেন তিনি। সাদের দাবি, সেই বইয়ে এমন কিছু বিতর্কিত ইতিহাস আছে যা সমালোচনার ঝড় তুলবে। কিন্তু নিজের ইতিহাস, নিজের ঐতিহ্যকে জানতে তিনি একচুল পরিমাণ ছাড় দিতেও রাজি নন। তিনি চান, কাজী বাড়ি শুধু একটি খাবার হোটেল না হয়ে, ইতিহাসকে জানার, দেখার, অনুভব করার জায়গা হোক। যেন সেই মোগল আমল থেকে তাদের পারিবারিক যে ইতিহাস আর ঐতিহ্য, তা যেন মুছে না যায়!
ঢাকায় হেরিটেজ হোটেল হিসেবে এটিই প্রথম নয়, এর আগে আরবান স্টাডি গ্রুপের সহাযোগিতায় পুরান ঢাকার নূর বকস রোডের দুই শতাধিক বছরের পুরনো 'জমিদার সাহেব বাড়িতে' চালু হয়েছে 'লাঞ্চ এট ইমরান'স হেরিটেজ হোম'। বর্তমানে ঢাকায় এই দুইটি হেরিটেজ হোটলেই রয়েছে।
গেটের ভেতরে ঢোকার পর থেকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত যেভাবে আপ্যায়ন এবং আন্তরিকতার মোড়কে অতিথিদের সেবা দিয়ে যান সাদ, তাতে সত্যিই কোনো হোটেল নয়, বরং মনে হবে কোনো নিকট আত্মীয়ের বাসা।
কাজী আব্দুল আলীমের দুই ছেলে কাজী এহসান এবং কাজী সাদ উল্লাহ বর্তমানে এই বাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নিজেদের ইতিহাস, গৌরব আর অর্জনের গল্পই এখন নতুন করে দেশি-বিদেশিদের সামনে তুলে ধরছেন কাজী এহসান এবং কাজী সাদ। সাদ বলেন, 'আমাদের পরিবারটি প্রায় পাঁচশ বছরের একটা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। শুধু এই বাড়ি বা পরিবার নয়, এর সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত ঢাকার আদি ইতিহাস।'