থ্রি অ্যাংলার্স: মাছের সঙ্গে বেঁধেছেন তাঁরা প্রাণ
কাহালু চলেছেন শ্রীমান বাবুল পাল। শাহ আমানত বাসের ভেতর ছয়টি দল। ২০১৬ সাল। বাবুল পালের দলে যে ছয়জন আছেন তার মধ্যে একজনের নাম জহির। দলের একজন হয়েও তিনি আলাদা, কারণ তাঁর কাজ কেবল দেখা। মাছ ধরার মহাযজ্ঞ হতে চলেছে বগুড়ার কাহালুতে। দীঘির মালিক যিনি, তাঁর পরিবহনের ব্যবসা, শাহ আমানত তাঁরই বাস।
বিকাল তিনটা হয়ে গেল কাহালু পৌঁছাতে। তারপর হলো লটারি, মাছ ধরিয়েদের কার কোথায় আসন হবে তার লটারি। এক একটা টিকিটের দাম ৮ হাজার টাকা।
বাবুল পাল অভিজ্ঞ ব্যক্তি। হুইল বড়শির পাকা ওস্তাদ হিসাবে সারাদেশেই তাঁর নাম আছে। মীরপুর ১ নম্বরে থাকেন।
জহিরও মাছ ধরেন, তবে এখনো তেমন পাকা হয়ে ওঠেননি, বিশেষ করে রিল আর রডে। মীরপুরে শাহ আলী (র.)-এর মাজারের কাছে উত্তর বিশিলে জহিরদের বাড়ি সেই দাদার আমল থেকে। বাঁশের চালির ওপর দাঁড়িয়ে বেড়ি বাঁধে মাছ ধরতেন ছোটবেলায়। আটাশির বন্যায় তো নিজের ঘুমানোর চৌকিতে বসে বসে মাছ ধরেছেন। তারপর কলেজে পড়তে গেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগও পেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই পিতৃহীন হয়ে যাওয়ায় খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তারপর ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখেছিলেন, গ্রিল বানাতে জানেন, ঠিকাদারি করেছেন এবং এখনো করেন। চাচাতো ভাই জয়নাল আবেদীনের স্যাঙাত ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। জয়নালের মাছ ধরার নেশা ছিল। চিড়িয়াখানার লেকে তাঁর সঙ্গে মাছ ধরতে গেছেন জহির অনেকদিন। তবে তখনো যাকে বলে পুরোদস্তুর অ্যাংলার (যারা ছিপ বা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে) হতে সময় লেগেছে আরো অনেক। সে গল্প শুরু করতে যেতে হচ্ছে কাহালুতে।
কাহালুতে অ্যাংলারদের বসার জায়গা নির্ধারিত হয়ে গেলে দলবল নিয়ে ছাতা মেললেন, তাঁবু পাতলেন, চেয়ার বিছালেন বাবুলদা। একটু চা পানের ব্যবস্থাও হলো। তারপর বসলেন চার ও টোপ নিয়ে। সাধারণত টোপ তৈরি হয় নারকেল বা সরিষার খৈল আর ভুট্টা ও যবের ছাতু দিয়ে। প্রয়োজনমাফিক বিভিন্ন অনুপাতে মেশান এগুলোকে।
তবে অ্যাংলারের আসল মুন্সিয়ানা চার তৈরিতে। ২০-২২ রকমের ভেষজ উপকরণ দিয়ে চার তৈরি হয়, যেমন একাঙ্গী, লতা কস্তুরি, আহবেল, তাম্বুল, ঘোরবচ, বাদাম, বুচকিদানা, মেথি, মহুয়া ফুল ইত্যাদি। এর সঙ্গে যোগ করা হতে পারে মিষ্টির গাদ, ঘিয়ের ছাচি বা মাখনের গাদ।
চার তৈরিতে মূলধন হলো অভিজ্ঞতা। মাছ ভেদেও চার হয় ভিন্ন ভিন্ন যেমন কার্প জাতীয় মাছের চার আর রাক্ষুসে (বোয়াল, আইড়) মাছের চার একরকম হয় না। উপরন্তু কার্প জাতীয় মাছগুলোর প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা করে চারে বৈচিত্র্য আনতে হয়। চারের কাজ হলো পানিতে সুগন্ধ (মাছের জন্য প্রযোজ্য) তৈরি করা, যেন মাছ আকৃষ্ট হয়। সাধারণত চার ফেলে মাছ আকৃষ্ট করার পর বড়শিতে টোপ গেঁথে মাছ ধরা হয়।
বাবুলদার দুই সহকারীর প্রধান ছিলেন জাহাঙ্গীর। সঙ্গীকে নিয়ে জাহাঙ্গীর চার ও টোপের বাটিগুলি পরপর সাজালেন। যেটার প্রয়োজন সেটার খোসা ছাড়ালেন, বড় বীজগুলো ভেঙে ছোট করতে থাকলেন। বাছাবাছির কাজও করলেন, তারপর একটির সঙ্গে আরেকটি মাখাতে থাকলেন। জহির সবই মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকলেন।
বাবুলদা একসময় বললেন, জাহাঙ্গীর প্রথমে কয়েকটা রুই ধরি, কি বলো?
জাহাঙ্গীর সম্মতি দিয়ে রুইয়ের পছন্দের চার তৈরি করতে থাকেন। তারপর প্রস্তুত হয়ে গেলে ছুড়ে দেন পানিতে, ততক্ষণে সূর্য দিনের কাজ গুছিয়ে আনতে শুরু করেছে। বাবুলদার দুই পাশে দুই সহকারী আর ঠিক পেছনে জায়গা করে নিলেন জহির। এর মধ্যে রডে (ধাতব ছিপ) রিল (হুইল) জুড়ে দেওয়া হয়েছে। রিলের খোপে সুতার (নাইলনের তৈরি মনোফিলামেন্ট) বান্ডিল পুরে দেওয়া হয়েছে। তারপর সুতার গায়ে কাছাকাছি দুটি স্টপার (মাছি বলে থাকে অনেকে) দিয়ে মাঝখানে ফাৎনা লাগানো হলো যেন সেটি ওপর-নিচ করতে না পারে। তারপর একটি ভার বা সীসা দেওয়া হয় এবং সুইভেলের গেরো বা নটের ঠিক মুখে আরেকটি স্টপার দেওয়া হয়, এরপর সুইভেলে বড়শি বা কাঁটার গোছা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বড়শির গোছা এক-দুই কাঁটার যেমন, ১২ কাঁটারও হয়। কার্প-জাতীয় (রুই, কাতল, মৃগেল) মাছ ধরার জন্য দুই কাঁটাই ব্যবহার করা হয় বেশি।
জহির দেখলেন জাহাঙ্গীর বড়শিতে টোপ গেঁথে একদলা চার সুতায়ও গেঁথে দিলেন। তারপর সুতা ছুড়ে দিলেন চার যেখানে ফেলেছেন সে জায়গাতেই। বাবুলদার সঙ্গে থেকে থেকে জাহাঙ্গীর তাঁর টেস্ট (কেমন হবে চার, টোপ হবে কেমন) বুঝে গিয়েছেন। বাবুলদা চেয়ারটা এগিয়ে আনলেন একটু্।
দীঘিজুড়ে ত্রিশজন অ্যাংলারের জন্য মাচা বাঁধা হয়েছে। সাধারণত একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব ২৫ ফুট হলে ভালো, তবে ২০ ফুটও হয়। বাবুলদা চেয়ারে বসে ঠায় তাকিয়ে আছেন ফাৎনার দিকে। কখনো কখনো চোখ মেলছেন আশপাশে এদিক-ওদিক। পানির নড়াচড়া দেখে বুঝি মাছের আনাগোনাও ধরতে পারছেন। হঠাৎ বললেন, 'বুঝলে, জহির, এটা একটা খেলা। খুব ধৈর্য রাখতে হবে তোমার। মাছরে ভালোবাসতে হবে। মাছকে খাওয়ার লোভ দেখিয়ে বেশি কাছে টানতে পারবা না বরং ভালোবেসে টানতে পারবা। মাছের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে খেলায় তুমি হারবা, নিয়ম হলো খেলায়ে খেলায়ে ধীরে-সুস্থে মহব্বত করে তাকে পাড়ে তুলতে হয়।'
জহির আসল মন্ত্র পেয়ে গেলেন। শব্দ বেশি পছন্দ করে না মাছ। তাই কথাবার্তা যা হয় সব ঠারে-ঠুরে। সূর্য ডুবতে বসেছে, কোনো হিট নেই, জহির বাবুলদার দিকে তাকিয়ে দেখেন তিনি নির্বিকার। ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে বসলেন জহিরও। হঠাৎই ফাৎনা তলিয়ে যেতে থাকল, এবার নড়ে উঠলেন বাবুলদা, বুঝলেন মাছ টোপ গিলেছে, মুহূর্তের মধ্যে বুঝেও ফেললেন মাছটি ৫ কেজি ওজনের বেশি হবে।
মাছ দৌড়াতে থাকল, সুতায় ঢিল দিলেন বাবুলদা, কিছু পরে চেপেও ধরলেন, আবার ঢিল দিলেন। এভাবে চলল বেশ কিছুক্ষণ।
বাবুলদা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলেন, সঙ্গে জহিররাও।
একটা টানটান উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। শঙ্কা আছে সবার মনেই, মাছটা শেষে আটকা পড়বে তো নাকি সুতা ছিঁড়ে পালাবে?
অবশেষে উৎরে গেলেন বাবুলদা, মাছটা হেরে গেল। বাবুলদা খুব আলগোছে এগিয়ে-পিছিয়ে ওকে নিয়ে এলেন কাছে। তারপর জাহাঙ্গীরের সহকারী নেট দিয়ে তাকে তুলে আনল ডাঙায়। সাড়ে পাঁচ কেজি ওজন ছিল মাছটার।
জহির জানতে পারলেন, সুতারও ছোট-বড় আছে, মোটা-চিকন আছে। সুতার বান্ডিলের গায়ে কত কেজি পর্যন্ত সইতে পারবে তার উল্লেখ থাকে, লেখা থাকে সুতার প্রস্থ ( দশমিক ৩৫ মিমি, দশমিক ৪৫ মিমি ইত্যাদি) আর দৈর্ঘ্য (১০০ মি. বা ১০০০ মিটার)।
নতুন করে বড়শিতে টোপ লাগানোর আগে ফাতনার গা ঘেঁষে রেডিয়াম লাগানো হলো; কারণ সন্ধ্যা লেগে গেছে। রেডিয়াম জ্বলে বলে ফাতনার ওঠা-নামা ঠাহর করা যায়।
সাড়ে নয়টা পর্যন্ত বাবুলদা গোটা পাঁচেক রুই ধরে ফেললেন। তারপর চার ফেলা হলো মৃগেল আকৃষ্ট করার জন্য। মধ্যরাত পর্যন্ত মৃগেল ধরে বাবুলদা চাইলেন কাতল ধরতে। কাতল বেশ খেলুড়ে মাছ, নাকও উঁচু তার। চারে বিশেষ করে মাখনের গাদ আর মহুয়ার ফুল মাখানো হলো। জয়ত্রি, জয়ফল মেশানো হলো টোপে। কাতলের জন্য নতুন রডও নেওয়া হলো। চার পার্ট রড আমাদের দেশে বেশি চলে। ৮, ১০ বা ১২ মিটার দীর্ঘ হয় রডগুলো। যে রড বাঁকতে পারে ভালো সে রডের চাহিদা বেশি।
কাতলের চার ছড়িয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীর টোপ গেঁথে বড়শি ছুড়ে দিলেন। বাবুলদা চুপ করে বসে পানি দেখছেন। অনেকক্ষন কোনো হিট নেই। প্রায় ঘণ্টা চলে যাচ্ছে। তারপর একটা হিট হলো। বাবুলদা খেলিয়ে খেলিয়ে পেল্লায় সাইজের একটা কাতল তুলে আনলেন। এভাবে ভোর চারটা অবধি কাতলের সঙ্গে খেলে বাবুলদা বললেন, 'আমার শরীর আর কুলাচ্ছে না জাহাঙ্গীর, আমি ঘুমাতে গেলাম, তোমরা যা খুশি করো।'
ওই রাতটাই, কাহালুর রাতটাই কাজী জহিরকে অ্যাংলার বানিয়ে দিল। মিরপুর লেক তাঁর পছন্দের একটি মাছ ধরার জায়গা। তিনি বলেছিলেন, 'এখানকার মাছগুলো মাস্টার ডিগ্রি পাশ! তারা ছলাকলা জানে অনেক। এখানে মাছ ধরে আনন্দ আছে।'
জহিরের কাছে এখন প্রায় দুই ডজন রড আছে। তাঁর ভাগ্নিরা থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। আসার সময় রড বা রিল নিয়ে আসেন মামার জন্য। একবার টিকার (টিআইসিএ, মাছ ধরার যন্ত্রপাতির চীনা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশে তাদের সোল এজেন্ট আছে, মহাখালীতে শোরুম) পক্ষ থেকে ১০ কেজি পাঙাস ধরার পুরস্কারস্বরূপ একটি রড উপহারও পেয়েছেন।
জহির জীবনে সবচেয়ে বড় মাছ ধরেছেন ২০ কেজি পাঙাস, মিরপুর লেক থেকেই। টিকেটে মাছ ধরতে দেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরবঙ্গে গেছেন কয়েকবার। মানিকগঞ্জের কালিগঙ্গা নদীর চৈলা ঘাট তার আরেকটি পছন্দের জায়গা।
জহির বলছিলেন, মাছ ধরার মজা আসলে নদীতে। ৭-৮ কেজি ওজনের বোয়াল দুই-আড়াইশ মিটারব্যাপী দৌড়ে বেড়ায়। সেটাকে বাগে আনতে গেলেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দেহ-মনে, জমে ওঠে খেলা।
তবে নৌকায় বসে আর পাড়ে বসে মাছ ধরার কৌশল ও যন্ত্রপাতি কিন্তু আলাদা। ফাৎনারই কিন্তু অনেক রকম আছে। আবার টোপও হয় কয়েক রকমের, তবে মিষ্টি আর পচা টোপই বেশি চলে।
কাজী জহির জানালেন, বাংলাদেশে অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা মাছ ধরতে পছন্দ করেন। শিল্পীদের মধ্যে সৈয়দ আব্দুল হাদী একজন বিশিষ্ট অ্যাংলার, চিত্রনায়ক রিয়াজও মাছ ধরতে পছন্দ করেন। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার ব্রেট লিও ভালো অ্যাংলার। ফেসবুকে বাংলাদেশ সৌখিন মৎস্য শিকারী নামের যে গ্রুপ আছে তার সদস্য সংখ্যা ৭৭ হাজার, এর একজন অ্যাডমিন কাজী জহির। এখন তার বয়স ৫৭।
বাবার থেকে পেয়েছেন ডা. শাহরিয়ার
'ধলেশ্বরীর পাড়ে আমাদের বাড়ি। উদলা গায়ে নদীতে ঝাঁপানোর সেই বাল্যবেলা থেকেই বড়শি আমার সঙ্গী। বাবার ছিল মাছ ধরার শখ। শুনেছি দাদাও মৎস্য শিকারি ছিলেন। বাবার বড়শি ছিল অনেক, সেসঙ্গে ছিল ইলিশ ধরার জাল।
'ধলেশ্বরীতে তখন ইলিশ পাওয়া যেত। বাবা বড়শির জন্য উপযোগী বাঁশের খোঁজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। সোজা কিন্তু নমনীয় এবং পোক্ত বাঁশ পেলে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। তারপর দুই-আড়াই মাস ভিজিয়ে রাখতেন পানিতে। এরপর রোদে শুকাতেন কয়েকদিন, তারপর ধানের খড়ে অল্প আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করতেন আর তাতে সেঁকতেন বংশদণ্ড। তারপর আবার তেল মাখিয়ে কয়েকদিন রোদে শুকাতেন সেই বাঁশ। মোটামুটি চার-পাঁচ মাসের এক যজ্ঞ ছিল বাবার বড়শি বা ছিপ বানানোর কর্মসূচি।
'বাবা নদীর পাড় ধরেও ঘুরে বেড়াতেন, দেখতেন মাছের আবাস। আমার মেজো ভাইয়ের মাছ ধরার নেশা আছে। বাবার ছিল মাছ ধরার দল। মাসে দু-চারবার তো বের হতেনই। মাছ ধরা শেষ হলে বড়শি ঘাড়ে ঝুলিয়ে বাড়ির পথ ধরতেন। তখন তার পিছনে ছোট একটা মিছিল দেখতাম। কোনো কোনো দিন এমন বড় মাছ পেতেন যে বাঁশে ঝুলিয়ে আনতে হতো। বাবা নিজে মাছ কাটতেন, আমার মা সিলভারের হাঁড়ি নিয়ে আসতেন। বাবা সন্তানদের এক বেলার জন্য প্রয়োজনীয় মাছটুকু রেখে বাকিটা গ্রামবাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দিত,ন।' বলছিলেন ডা. একেএম শাহরিয়ার কামাল।
ডা. শাহরিয়ার মীর্জাপুরের যমুনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রেসিডেন্ট সার্জন। টাঙ্গাইলের নাগরপুরের পাঁচতারা গ্রামে তাদের বাড়ি। মিরপুর ২ নম্বরে নিজের ফ্ল্যাটে একমাত্র কন্যা মৃত্তিকাকে নিয়ে তাদের তিনজনের সংসার। বাবা ছিলেন পল্লী চিকিৎসক।
শাহরিয়ারের বয়স যখন পাঁচ মোটে, তখন একবার বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন হাটে। হঠাৎ কী ভেবে বাবা বলেছিলেন, তোমাকে কিন্তু ডাক্তার হতে হবে। তারপর প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ার সময় বড় ভাই তাঁকে ঢাকায় এনে মনিপুরী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন ছুটিতে বাড়ি গেলে মাছ ধরার ফুরসত মিলত।
সেকালে মাছ ধরা কোনো ব্যয়বহুল ব্যাপার ছিল না। বাবা ঘরের আটা-ময়দা গোলা আর আম নয়তো লিচু গাছ থেকে পিঁপড়ার বাসা জোগাড় করে বাঁশ-বড়শি দিয়ে বড় বড় মাছ ধরেছেন।
তবে রংপুর মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর আর ফুরসত মেলেনি শাহরিয়ারের। ছিয়ানব্বই সালে পাশ করে কিশোরগঞ্জে জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজে প্রভাষকের কাজ নিলেন। সেখানে ছিল সুখের দিন। পড়িয়ে আর মাছ ধরেই কাটিয়েছেন চার বছর। পরে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করতে ঢাকায় আসেন ২০০০ সালে। আরো চার বছর আবার পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলেন। তবে মাসে এক-দুবার রমনা, চিড়িয়াখানা, ধানমন্ডি বা সংসদ ভবনের লেকে মাছ ধরতেন। পড়া শেষ করে ২০০৫ সাল থেকে তিনি হয়ে উঠলেন সত্যিকারের অ্যাংলার। চলে গেলেন মীর্জাপুরে। কাছেই বংশাই নদী।
লেখক : ঢাকায় তো কাজ নিতে পারতেন। শহর থেকে দূরে চলে গেলেন কেন?
ডা. শাহরিয়ার: আমি পেরিফেরিতেই কাজ নিতে চেয়েছি সবসময়। মীর্জাপুর হাসপাতালে নাগরপুর থেকেও অনেকে আসে চিকিৎসা নিতে।
লেখক : মাছ ধরে কী করেন?
ডা. শাহরিয়ার: বেশিরভাগই ছেড়ে দিই। বলতে পারেন আশি ভাগ মাছই ছেড়ে দিই। পৃথিবীর অন্য দেশের অ্যাংলারদের মন্ত্রও তাই—ক্যাচ অ্যান্ড রিলিজ।
লেখক: তাহলে মাছ ধরে লাভ কী?
ডা. শাহরিয়ার: এটা গেইম। একটা খেলা। আমি পরিমাণে অনেক মাছ ধরতে চাই না, বরং বড় মাছ সারা দিনে চার-পাঁচটা ধরতে চাই। এটা একটা খেলা বিটুইন মি অ্যান্ড ফিশ।
লেখক: তাহলে যে কম্পিটিশন হয় মাছ ধরার? সেখানে তো কোয়ান্টিটি একটা বিচার্য বিষয়।
ডা. শাহরিয়ার: পরিমাণে বেশি ধরতে পারার মধ্যেও কৃতিত্ব আছে। তবে সেটাকে মুখ্য জ্ঞান করলে ক্ষতিই বেশি। এর ফলে যেমন টিকেটের দাম বেড়ে গেছে, আবার ফিশিং অ্যাপারেটাসের দামও বেড়ে গেছে। যদি এটাকে 'ক্যাচ অ্যান্ড রিলিজ' পর্যায়ে রাখা যায়, তবে খেলার আনন্দটা বেশি মিলবে। আর যদি কোয়ান্টিটি বিচার্য হয় তবে কৃতিত্ব বেশি জাহির করা যাবে, খেলার আনন্দটা হারিয়ে যাবে। কোয়ান্টিটি বিচার্য হওয়ায় দেখুন কেমিক্যালের ব্যবহার বাড়ছে, বিপর্যয় ঘটছে পানির, আবার মাছও নিরাসক্ত হয়ে পড়ছে। কৃত্রিমতা যত বাড়বে তত খেলার মজাটা হারিয়ে যাবে।
লেখক : আনন্দ কীভাবে পাওয়া যায়, একটু বুঝিয়ে বলুন।
ডা. শাহরিয়ার: আনন্দ শুরু হয় একদম শুরু থেকে। সামনে ৫ আগস্ট আমরা ময়মনসিংহের ফুলপুরে মাছ ধরতে যাব। বিকালে শুরু হয়ে টানা ২৪ ঘণ্টা খেলা হবে। আমি কিন্তু ভাবতে শুরু করেছি এই এখন থেকেই (২৫ জুলাই)। বারবার গুগলে গিয়ে দীঘিটার ছবি দেখছি আর প্ল্যান করছি। ভাবছি কোন মাপের কয়টি রড নেব, রিল নেব কয় বিয়ারিংয়ের, সুতা কোন কোন প্রস্থের নেব ইত্যাদি। তারপর যাওয়ার পথে গল্প করতে করতে যাব—সেটাও মজার। তাঁবু টাঙানো, চেয়ার বিছানো ইত্যাদি সবটাই মজার।
লেখক: আপনার ফুলপুর যাত্রায় কত খরচ হবে?
ডা. শাহরিয়ার: চল্লিশ হাজার টাকার বেশি। আমার পাঁচজনের দল। এদের মধ্যে দুই জন মাছধরায় সহকারী, মানে চার ফেলবে, টোপ বানাবে, মাছ নেট করবে ইত্যাদি। এরা সাধারণত পেইড হয়। তারপর ডে-নাইট প্রোগ্রাম, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার আছে। তাঁবু, চেয়ার, কাপড়চোপড় গোছগাছের ব্যাপার আছে। চা-কফি বানানোর ব্যাপার আছে। তার জন্যও আরেকজন লোক দরকার হয়। আর একজন বিশেষ লোক দরকার যার সঙ্গে গল্প করে আমি আনন্দটা শেয়ার করতে পারি। মাছ ধরার একেক যাত্রায় হিসেব করে দেখেছি ১০৫ রকমের জিনিস সঙ্গে যায়। রড, রিল, সুতা, ফাৎনা, সুইভেল, সীসা, তুলে আনার নেট, মাছের চার ও টোপ, আমাদের জামাকাপড়, তাঁবু, চেয়ার, পানীয় মিলিয়ে সংখ্যাটা ১০০ ছাড়ায়।
লেখক: আপনি কোথায় মাছ ধরতে পছন্দ করেন?
ডা. শাহরিয়ার: পুরোনো লেকে। সবচেয়ে পছন্দের হলো মীরেরসরাইয়ের মহামায়া লেক। পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সেখানে যাওয়ার পথ। যাত্রাটাই রোমাঞ্চকর। এছাড়া বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারির নীল সাগর, দিনাজপুরের রাম সাগর আর মীরপুর চিড়িয়াখানা লেক আমার পছন্দের।
লেখক: পুরোনো দীঘি আর নতুন দীঘিতে ফারাক কেমন?
ডা. শাহরিয়ার: পুরোনো দীঘিতে ঐতিহ্যবাহী অ্যাপারেটাস আর খাবার দিয়েও মাছ ধরা যায়। মানে অনেকটা প্রাকৃতিক উপায়ে সেগুলোতে মাছ ধরা যায়। নীল সাগর বা রামসাগরে মাছ বেশি পাওয়া যায় না; তবে যা আছে সব বড় বড়। রাতে যখন মাছ ধরি তেমন কোনো দীঘিতে, গভীর রাতে সব নিঝুম, সাড়াশব্দ নেই, বাতাস বয় মৃদুমন্দ, পানিতে টুপটাপ ঝরে পাতারা, মাছের সঙ্গে একান্তে চলে ধরা-ছোঁয়ার খেলা; সব মিলিয়ে একটা অপার্থিব অনুভূতি হয়।
লেখক: আপনি কি কিছুটা বাউল ধরনের?
ডা. শাহরিয়ার: লালন সাইয়ের গান আমার খুব পছন্দের। কথাগুলো শুনলে মনে হয় এগুলো তো আমিও বলতে চাই। নজরুলের অনেক গান ভালো লাগে।
লেখক: আপনি কি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি পড়েছেন?
ডা. শাহরিয়ার: আমার খুব পছন্দের একটা বই দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি।
লেখক: আপনার পরিবারের সদস্যরা কি আপনাকে সমর্থন দেয়?
ডা. শাহরিয়ার: এটা সৌভাগ্য বলতে হবে, আমার স্ত্রী এবং কন্যা অ্যাংলিং পছন্দ করে। আমি যখন চার বানাই মীর্জাপুরে, তখন ওরা অফিস বা স্কুল ছুটি নিয়ে চলে যায়। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। তিন বছর আগে তিন ড্রাম, মানে আশি কেজি চার বানিয়েছিলাম। তার অনেকটা আজো আছে। এগুলো যত পুরোনো, মানে ফার্মেন্টেড হয় তত মাছ আকৃষ্ট হয়। একটা ব্যাপার উল্লেখ্য, রাক্ষুসে মাছ ছাড়া অন্য মাছগুলো খাওয়ার জন্য লালায়িত থাকে না। ওরা খায় এনার্জি দরকার বলে; পেলাম আর খেলাম তেমন নয় কিন্তু।
লেখক: মাছ কি কৌশলী বা চতুর?
ডা. শাহরিয়ার: মাছ আসলে বোকা, স্মৃতিশক্তি কম। আমরা অ্যাংলাররা ওদের আকৃষ্ট করতে এতসব কৌশল প্রয়োগ করছি আর প্রলোভন দেখাচ্ছি যে ওরা নিরাসক্ত হয়ে উঠেছে। এখন ওদের কাছে টানতে নিত্যই নতুন নতুন চার আর টোপ দিতে হচ্ছে। সে কারণে আমরা ভাবছি ওরা বুঝি দিনে দিনে চতুর হয়ে উঠছে।
ডা. শাহরিয়ারের ১৬টি রড আছে। তাঁর কাছে জানলাম, শেকস্পিয়ার, আবু গার্সিয়া, অ্যাড্রেনালিন, অ্যাংকর, বার্কলে, দাইওয়া ইত্যাদি বড় বড় অ্যাংলিং এপারেটাস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আছে।
শাহরিয়ার শুনেছিলেন, সুইডিশ প্রতিষ্ঠান আবু গার্সিয়া তৈরি করেছেন এক নাতি তাঁর দাদার নামে। একদিন মাছ ধরতে গিয়ে দাদার মেকানিক্যাল রিলের রড মাছ টেনে নিয়ে চলে যায়। তারপর থেকে নাতি ভাবতে থাকে কীভাবে রিলের উন্নতি সাধন করা যায়। আর তা থেকেই পৃথিবীতে স্পিনিং হুইলের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটি ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কাজী জহিরের গুরু বাবুল পাল
দুজনের বয়সের ফারাক খুব বেশি নয়। তবু বাবুল পালকে গুরু মানতে কাজী জহির মোটেও দ্বিধাগ্রস্ত নন। সেই কাহালুতে বাবুল পালের মাছ ধরা দেখেই তাঁর মধ্যে জেগে উঠেছিল অ্যাংলার হওয়ার বাসনা।
তবে বাবুল পালের অ্যাংলিংয়ের বয়স তিন দশকের বেশি। বলছিলেন, 'ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় থেকেই বড়শি উঠে এসেছিল হাতে। তখন উমাচরণ কর্মকারের তৈরি বড়শি আর রিল পাওয়া যেত। তারপর চুরাশি সালে পড়ার সূত্রে ঢাকায় এসে নতুন নতুন সব অ্যাংলিং অ্যাপারেটাসের সঙ্গে পরিচয় হয়। হুইল বড়শি দিয়ে নিয়মিত মাছ ধরার শুরু আটাশি সালে। তারপর প্রথম কর্মস্থল গলাচিপায় গিয়ে দেখি অবারিত সুযোগ। চারধারে নদী-নালা, খাল-বিল ছড়ানো। এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সঙ্গেও বন্ধুতা হয়ে যায়। তারা ডেকে ডেকে মাছ ধরতে নিয়ে যেত।'
বাবুল পাল একজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট। মাছ ধরাকে তিনি রিক্রিয়েশন জ্ঞান করেন। এতে খরচ হয় অনেক আর সময়ও যায় প্রচুর; তবে আনন্দ যেটুকু পান সেটার মূল্য অমূল্য।
বাবুল বলছিলেন, 'রিক্রিয়েশন করতে গিয়ে আমি কোনোরকম ঝগড়ায় জড়াই না। জেলাসি, বিবাদ আর লোভে জড়ালে আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়। অ্যাংলার হতে গেলে আপনার প্রথম যে গুণটা লাগবে সেটা ধৈর্য্য। অধৈর্য মানুষ আর যা-ই হোক অ্যাংলার হতে পারবে না।
'ধরা যাক, কোনো পুকুরে টিকিটে মাছ ধরতে গেছি, আমার দুপাশে আরো দুজন অ্যাংলার বসেছেন। তাদের বড়শিতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাইট হচ্ছে, আমারটায় হচ্ছে না। এখন আমি যদি অধৈর্য হয়ে উঠি তবে ভুল করে ফেলব। তাতে নিজের তো বটেই, মাছেরও ক্ষতি হবে। মাছ তো আমার মতোই জীব। তাকে কষ্ট দেওয়া, আহত করা বা নেশাগ্রস্ত করার আমি পক্ষে নই। এমনিতেই আমার আনন্দের জন্য সে মুখে বড়শি নিচ্ছে তার ওপর যদি তাকে আরো কষ্ট দিই সেটা হবে ভীষণ অন্যায়।
'আমি তাই বিশ্বাস করি, যত কম কষ্ট দিয়ে মাছকে তুলে আনা যায় ততই ভালো। তার জন্য মাছকে পর্যাপ্ত সময় দিই, মাছকে আদর করে নেটে ঢোকাই।'
যেসব পুকুর বা দীঘির মালিক অ্যাংলিংবান্ধব, তাদের পুকুরেই মাছ ধরতে যান বাবুল পাল। যারা অ্যাংলিংকে বাণিজ্যিকভাবে দেখেন, যাদের কথায় ও কাজে মিল নেই তাদের পুকুরে যান না বাবুল। ধর্মসাগর, নীলসাগর, রামসাগর, দুর্গাসাগর বা চিড়িয়াখানা লেকে মাছ ধরতে বেশি পছন্দ করেন বাবুল তিনি।