মধ্যপ্রাচ্যে আনাগোনা দিচ্ছে আরেকটি বসন্ত!
বসন্ত মানেই যদি বসুধার চিত্রপটে পত্রপল্লবের আগমনী বার্তা কিংবা বসন্ত মানেই যদি হয় নতুন দিনের নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিদীর্ণ প্রান্তরেও হয়ত তাই হওয়ার কথা। কিন্তু আরব বসন্তের অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা বলছে সেখানে বসন্তের আশা যেন নির্ঘাত এক মরীচিকা! তবুও কাফেলা এগিয়ে মরীচিকায় বাজি ধরে, আলোচনার টেবিল যেমনভাবে শান্তি প্রতিস্থাপনের আশায় জাগ্রত থাকে অনন্তসময়।
বাস্তবিক কিংবা রাজনৈতিক সবদিক থেকেই মধ্যপ্রাচ্য আসলেই এক উষ্ণতম জনপদ, যেখানে প্রতি পদক্ষেপ ফেলতে হয় হিসেব করে, সেখানে শান্তির আশা আদৌ কি আলোর মুখ দেখবে? সেটা না হয় সময়ই বলে দেবে, তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এসে একটুখানি বাজি ইরান-সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চলমান আলোচনার ওপর ধরাই যায়।
একটা সময় ছিলো যখন দেশগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কথা উঠলেই রাজার মত সামনে এসে হাজির হত বাস্তববাদ তথা রিয়েলিজম, হোক সেটা রাজনীতির মাঠ কিংবা একাডেমিয়া। তার মানে এই নয় যে, এখন দেশসমূহ আর "হার্ড পাওয়ার, রিলেটিভ গেইন, ব্যালেন্স অফ পাওয়ার" ইত্যাদি নিয়ে ভাবছে না, কিংবা শক্তি সব এমন ধ্যান ধারণা থেকে সরে এসেছে; বরং বলা যায়, বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে তারা একধাপ এগিয়ে চিন্তা করছে যেখানে গেম থিওরির আলোকে 'কোঅপারেশন' বা সফযোগিতা করেও রাষ্ট্রের স্বার্থ হাসিল করা সম্ভব।
নানান তিক্ততা পেরিয়ে ইরান-সৌদি আরব হয়ত এই পথেই হাটতে চাচ্ছে, যেটা হবে আরব বিশ্বের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। কেননা স্নায়ু যুদ্ধের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যে মেরুকরণ দেখা দিয়েছিল তার রেষ আজও পুরোদমে বহমান এখানে। মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রধান শক্তিধর সৌদি আরব আর ইরানের সম্পর্ক গত শতকের ৭০ এর দশকের আগে এতটা জটিল ছিলনা যতটা আমরা এই শতাব্দীতে এসে দেখছি সিরিয়া থেকে ইয়েমেন তথা পুরো অঞ্চল জুড়ে। এই দুই দেশের পেছনে আবার যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার আশীর্বাদ আছে তাতে বলতে হয়, এই বিভাজনে যে শুধুই নিজেদের স্বার্থ জড়িয়ে তা কিন্তু নয়, বরং পরাশক্তিদের নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্যই মধ্যপ্রাচ্য যত অশান্ত থাকবে তত সুবিধা।
এমন পরিস্থিতিতে ভালো কিছুর প্রত্যাশা দূরুহ বটে, তবুও ব্যাকচ্যানেলে গত একবছর যাবৎ ইরাকের মধ্যস্থতায় ৫ দফায় বৈঠক করেন দুই দেশের কর্মকর্তারা। এসব নিয়ে সরাসরি কিছু না বললেও বিভিন্ন সময়ে খবর এসেছে ফলপ্রসূ পরিণতির। যার ফলশ্রুতিতে কিছুদিন আগে ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুয়াদ হোসেইনের বক্তব্যে জোর গুঞ্জন উঠেছে এবার শীঘ্রই সরাসরি বৈঠকে বসতে পারেন দুই দেশের শীর্ষ নেতারা। এই যে গতানুগতিক স্নায়ু্ যুদ্ধের মানসিকতা আর দ্বন্দ্ব জিয়িয়ে না রেখে যৌথ স্বার্থ বিবেচনায় সব পক্ষকে সাথে নিয়ে চলা এটাই আরবের নতুন দিনের রাজনীতির মূলনীতি হয়ে উঠবে। অনেকেই একে বলছেন হাইব্রিড কূটনীতি তবে এটি আসলে আরেকটি নতুন আরব বসন্তের সূচনালগ্ন যেখানে আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি রক্তের বন্যায় লাল হয়ে উঠা আরব ভূখণ্ডে আবার জাগবে শান্তির নিশান।
পুতিন-বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর, কয়দিন টিকবে এই বসন্ত
তবে রাজনীতির ময়দানে শান্তি কামনা এক অসাধ্য বস্তু, বাস্তবিক অর্থে ইরান সৌদি কি শান্তি চায় না জাতীয় স্বার্থই সবকিছুর উর্ধ্বে সেটিও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। হঠাৎ করেই বা কেনো দুপক্ষ সব ভুলে আলোচনার টেবিলে বসলো? এতকিছুর মাঝে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রও কি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? হয়ত না, তাই দিনকয়েক আগেই ১৩ জুন বাইডেন তেলআবিব হয়ে সফর করেছেন রিয়াদ, পুতিনও পাল্লা দিয়ে তাই পরের সপ্তাহে তেহরানে মিলিত হয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি আর তুরষ্কের এরদোয়ানের সঙ্গে।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাইডেনের ক্ষমতায় আসার পর প্রথম এই আরব সফর অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জ্বালানি তেলের বাজারে যে অস্থিরতা চলছে তা কাটাতে সৌদিসহ অন্যান্য আরব দেশগুলোকে পাশে পাওয়া থেকে শুরু করে ইউক্রেন সংকটে আরব দেশগুলো যেমন অবস্থান নিয়েছিল সামনের দিনগুলোতে তাইওয়ান নিয়ে, যুদ্ধ বাধলে যেন এই মিত্রদের পাশে পাওয়া যায় তার বন্দোবস্ত করা আর ইরানের বিপক্ষে আরব-ইসরায়েলকে একাট্টা করাই হয়ত উদ্দেশ্য। জামাল খাসোগি হত্যা নিয়ে সরব থাকা বাইডেন যেভাবে সব ভুলে রিয়াদে ছুটে গিয়েছিলেন, তাতে ভালোই শঙ্কা জেগেছিলো ইরানের সাথে আলোচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে। তবে যেভাবে ধারনা করা হচ্ছিল বাইডেন এই সফর থেকে তেমন কিছু আদায় করে নিতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্র তাদের যেই হারে তেলের উৎপাদন বাড়াতে বলছে সেটা নিয়েও দ্বিমত আছে ওপেকের নেতৃত্বে থাকা সৌদির। মোহাম্মদ বিন সালমানের সময়ে এসে সৌদি "এক ঝুড়িতে সব ডিম না রাখার" যে পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছে তার প্রতিফলন হচ্ছে তাদের এই অবস্থান, যেখানে তারা সমানতালে হাতে রাখতে চাচ্ছে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রকে, আবার ইসরায়েল-ইরানের দিকেও নজর দিচ্ছে। অবশ্য ২০১৮ সালের পর থেকে খাসোগি ইস্যুতে পশ্চিমা চাপ আর হুথি বিদ্রোহীদের সৌদি তেল স্থাপনায় হামলা না হলে তারা এতটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারতো কিনা সন্দেহ ছিল। তাই নিজেদের প্রয়োজনেই তাদের ইরানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা দরকার।
অন্যদিকে, বাইডেনের সফরের কাছাকাছি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বোমা ফাটান এই বলে যে, ইরান থেকে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ড্রোন নিচ্ছে রাশিয়া। চমকপ্রদভাবে এই তথ্য ইরান বা রাশিয়া স্বীকার না করলেও ঠিক এর পরপরই পুতিন তেহরান যাওয়ার ঘোষণা দেন, যেটি ছিল ইউক্রেন যুদ্ধের পর পুতিনের সোভিয়েত সীমানার বাইরে প্রথম সফর। একই সময়ে ইরানে ছিলেন তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানও, উদ্দেশ্য সিরিয়া নিয়ে আলোচনা, যেহেতু সিরিয়ায় সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকায় এই তিন দেশই রয়েছে। তবে বিশ্ব রাজনীতির এই জটিল সময়ে এসে আলোচনার যে শুধুই সিরিয়া নিয়ে সীমাবদ্ধ ছিলনা তা নিশ্চিত। অনেকে তো একে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এক নতুন জোট হিসেবে দেখছেন, যদিও বিষয়টি হয়ত এতদূর গড়ায়নি। তবে ড্রোন ইস্যুতে বাইডেনের সফরের ঠিক আগেই আরবে ইরান ভীতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা ছিল। ইরান হয়ত খুব ভালভাবেই সৌদির সাথে আলোচনার ট্র্যাকে আছে, যার কারণে পরিস্থিতি এরপর স্বাভাবিকই ছিল।
বাইডেন-পুতিনের মধ্যপ্রাচ্যে ভিন্ন দুটি সফরের পর ইরান-সৌদি বলয়কে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে আবার নতুন সংঘাত শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, যদিও পরিস্থিতি এখনো অনুকূলে।
রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে ধর্মীয় মতপার্থক্য থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শসহ অনেক বিষয়ে বিভাজন থাকলেও উভয়েই আবার নিজেদের সম্পর্ক আগের পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা ভাবছে। তবে এই সহাবস্থানের মানে আসলে কী? দুইদেশই কি সংঘাতের পথ ছেড়ে একেবারে বের হয়ে আসতে পারবে? ইরানের প্রক্সি যুদ্ধ আর পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সৌদির যে চিন্তা, তা কতটা মেটাতে পারবে তেহরান? আর রিয়াদই বা কতটা ছাড় দেবে ইরানকে। সেটা হয়ত দুপক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু হলেই বলা যাবে।
তবে এই দুইদেশ যে নীতিতে এগোচ্ছে, সেটিকে স্নায়ু যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে নিজেদের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রুশ-মার্কিন দাতাত প্রক্রিয়ার সাথে মিলানো যায়। যেখানে বৈপরীত্য থাকা সত্বেও একটা পর্যায় পর্যন্ত উভয় শিবিরই সন্দেহ নিরসনে ছাড় দিয়ে চলতে রাজি হয়েছিল। তবে তাদের গত একবছরের আলোচনা যদি সঠিক পথে চলতে থাকে তাহলে সামনে ভালো কিছু হতেও পারে, যেটি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বলা যায় আরেকটি বসন্তের ডাক।
- লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়