যে ভাষায় ‘না’ বলে কোনো শব্দ নেই!
নেপালের আদিবাসী গোষ্ঠী কুসুন্দা। ছোট এ গোত্রের মানুষের সংখ্যাও কমে এসেছে। বর্তমানে নেপালের পশ্চিমাঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করে অল্পকিছু কুসুন্দা জনগোষ্ঠী। কুসুন্দাদের ভাষার নামও কুসুন্দা। আর এ ভাষা পৃথিবীর আর যেকোনো ভাষা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
ভাষাতাত্ত্বিকেরা মনে করেন এ পৃথিবীতে যত ভাষা, ভাষাগোষ্ঠী আছে, তার সঙ্গে কুসুন্দা'র কোনো সংযোগ নেই। এ ভাষার উৎপত্তি নিয়েও ভাষাপণ্ডিতদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। আরও মজার ব্যাপার হলো, কুসুন্দা ভাষায় 'না-বোধক' বাক্য বলার মতো কোনো শব্দ নেই। নেই 'হ্যাঁ' বা 'না' বোঝানোর মতো কোনো শব্দও নেই এ ভাষাতে। কুসুন্দা ভাষায় কথা বললে কোথাও পৌঁছানোর দিকনির্দেশনাও দেওয়া যাবে না। কুসুন্দার নেই নির্দিষ্ট কোনো ব্যাকরণও।
২০১১ সালে নেপালের সর্বশেষ জনশুমারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশটিতে ২৭৩ জন কুসুন্দা রয়েছেন। কিন্তু ভাষাটি সাবলীলভাবে বলতে পারেন কেবল একজন নারী। ৪৮ বছর বয়সী ওই নারীর নাম কমলা খত্রি।
কুসুন্দাদের অধিকাংশ বর্তমানে নেপালের দাং জেলায় বাস করেন। তাদের ভাষাটি টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে নেপালের ল্যাঙ্গুয়েজ কমিশন গত ২০১৯ সাল থেকে এখানে কুসুন্দা ভাষার ক্লাস নিচ্ছে। ১৮ বছর বয়সী হিমা খত্রি একজন কুসুন্দা। তার মতো আরও অনেক কুসুন্দা কিশোর-কিশোরীদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে নেপালের সরকার। দাং-এর মাহিন্দ্রা হাই স্কুল নামক একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়েন হিমা। এ স্কুলে চিরায়ত লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদেরকে শেখানো হয় কুসুন্দা ভাষাও।
গত দুই বছর ধরে কুসুন্দা শিখছে হিমা। এখন মোটামুটি মৌলিক পর্যায়ে ভাষাটি বলতে পারেন তিনি। 'জন্ম থেকে না শিখতে পারলেও এখন কুসুন্দা শিখে আমি গর্বিত,' বলেন তিনি।
২০ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পশ্চিম নেপালের জঙ্গলে বাস করত কুসুন্দা আদিবাসী। শিকার, স্থানীয় শহরে মাংস ও ময়দা বিক্রি ইত্যাদি করে জীবন চলত তাদের। এখন গ্রামে বাস করলেও নিজেদের 'বনের রাজা' বলে ডাকতেই পছন্দ করে তারা।
জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর নেপালে কৃষিকাজের জন্য জঙ্গলের ওপর চাপ বাড়ে। ১৯৫০-এর দশকে দেশটির সরকার বিশাল পরিমাণ জঙ্গল জাতীয়করণ করে। এসবের কারণে জঙ্গলের জীবন ছেড়ে থিতু হতে বাধ্য হয় কুসুন্দারা। জনসংখ্যা কম হওয়ায় বাধ্য হয়ে অন্যান্য আদিবাসী গোত্রের মধ্যে তাদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। একসময়ে প্রায় সবাই কুসুন্দা ভাষা বলা বন্ধ করে দেয়।
কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মাধব পোখারেল। গত ১৫ বছর ধরে কুসুন্দা ভাষার ডকুমেন্টেশন কাজের তত্ত্বাবধান করছেন তিনি। তিনি জানান, পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের বুরুশাকসি ও ভারতের নিহালি ভাষার মতো বিচ্ছিন্ন ভাষাগুলোর সঙ্গে কুসুন্দা ভাষার কোনো সংযোগ আছে কিনা আছে তা জানার জন্য অনেকগুলো গবেষণা করা হয়েছিল। কিন্তু কুসুন্দার সঙ্গে অন্য দুই ভাষার কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে ভাষা গবেষকেরা মনে করেন, তিব্বত-বার্মা ও ইন্দো-আর্য ভাষা আসার আগে সাব-হিমালয়ান অঞ্চলের কোনো সুপ্রাচীন আদিবাসী ভাষার টিকে থাকা একটি রূপ হচ্ছে কুসুন্দা।
কুসুন্দা ভাষা নিয়ে বিশেষ জ্ঞান রাখেন ভাষাতাত্ত্বিক ভোজরাজ গৌতম। তার কাছ থেকে জানা গেল কুসুন্দায় 'না-বোধক' কোনো শব্দ না থাকার ব্যাপারে। যদিও এ ভাষায় না বলার জন্য কোনো প্রমিত নিয়ম নেই, তবে অন্যভাবে না-বোধক অর্থ প্রকাশ করার অল্প কিছু উপায় রয়েছে। যেমন যদি কেউ কুসুন্দায় বলতে চান 'আমি চা পান করতে চাই না', তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে 'পান করা' ক্রিয়াবাচ্যটি ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু সেটা এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যার দ্বারা 'পান করা'র খুবই অল্প সম্ভাবনা প্রকাশ পাবে। এর দ্বারা বোঝা যাবে ব্যক্তি চা পান করতে চাচ্ছেন না।
এ ভাষায় নির্দিষ্ট করে দিক বলার জন্যও কোনো শব্দ নেই। অর্থাৎ 'বাম' বা 'ডান' এ শব্দগুলো কুসুন্দাতে নেই। এর বদলে কুসুন্দারা 'এদিকে', 'ওদিকে' ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন।
কুসুন্দা ভাষায় ব্যাকরণের কোনো বালাই নেই। এখানে শ্রোতার সাপেক্ষে ব্যক্তি কথা বলেন। এ ভাষায় কোনো কাজের অতীত বা বর্তমান রূপ নেই। যেমন কেউ যদি বলতে চায় 'আমি একটি পাখি দেখেছি', তাহলে তাকে সেটা এমনভাবে বোঝাতে হবে যেন তা শ্রোতা নিজে দেখেছেন বলে মন হয়। অন্যদিকে ভবিষ্যতের কোনো কাজের সঙ্গে কোনো ব্যাকরণগত কর্তার সম্পর্ক নেই এ ভাষায়।
কুসুন্দা ভাষার এ বিরল বিশেষত্বগুলোর কারণে এটি যেমন ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে চমৎকার একটি ভাষায় পরিণত হয়েছে, একই কারণেও ভাষাটি ধীরে ধীরে মানুষের মুখ থেকে হারিয়ে গেছে।
কমলা খত্রি নিজের সন্তানদের কুসুন্দা শেখাননি। কারণ তার কাছে মনে হয়েছিল কুসুন্দার বদলে নেপালি বেশি দরকারি। 'মানুষ আমাদের ভাষা নিয়ে হাসাহাসি করত, বলতো এটা নাকি স্বাভাবিক ভাষা না। আমাদের অনেক কথা শুনতে হতো। কিন্তু এখন আমার আফসোস হয় এ ভেবে যে নিজের সন্তানদের সঙ্গেও আমি আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারিনা,' বলেন কমলা।
কমলা খত্রি এখন লেঙ্গুয়েজ কমিশনের সঙ্গে কাজ করেন। নেপালের গোরাহি শহরে ১০ জন কুসুন্দাকে ভাষাটি শেখাচ্ছেন তিনি।
পোখারেল মনে করেন, এভাবে বাকি থাকা কুসুন্দাদের মধ্যে সহযোগিতামূলক শিখন পদ্ধতির মাধ্যমই হচ্ছে এ ভাষাটি টিকিয়ে রাখার মূল উপায়। কুসুন্দাদের নিজেদের আদিভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষেও তিনি। তার মতে যদি সব কুসুন্দাকে তাদের আদিভূমিতে ফেরত আনা যায় তাহলে তা ভাষা শেখার কাজে সহায়তা করবে। কারণ কোনো কিছু শেখার ওপর পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
কুসুন্দা ভাষা পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়ায় এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তিও। বার্লিনভিত্তিক নাউহিয়ার মিডিয়া নামের একটি স্টুডিও কুসুন্দা ভাষা, সংস্কৃতি, ও ঐতিহ্যের ডকুমেন্টেশনের কাজে সহায়তা করছে। এ স্টুডিওটি কুসুন্দাদের সাবেক জীবন নিয়ে একটি ভার্চুয়াল রিয়ালিটিভিত্তিক গেমও তৈরি করেছে। এ গেমটি খেলার জন্য গেমের চরিত্রদের সঙ্গে কুসুন্দা ভাষায় যোগাযোগ করতে হয় খেলোয়াড়কে।
তবে আরও একটি সমস্যায়ও জর্জরিত কুসুন্দারা। নেপাল কুসুন্দা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ধন বাহাদুর কুসুন্দা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ কুসুন্দা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। এদের কোনো জমির মালিকানা নেই। তারা শ্রমিক ও কুলি হিসেবে কাজ করেন।
নেপালের কুসুন্দারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এ কারণেও তাদের ভাষাটি রক্ষা করা প্রয়োজন। তাদের যদি নিজস্ব কোনো ভাষা না থাকে, তাহলে নেপালের বাকিসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের আর কোনো পার্থক্য থাকবে না। এ ভাষাটি তাদের পরিচিতি বহন করে, এটির মাধ্যমেই সরকারের কাছ থেকে তারা প্রয়োজনীয় মনোযোগ পান।
লন্ডন ইউনিভার্সিটির পোস্ট-ডক্টোরাল ফেলো টিম বট কুসুন্দাদের পক্ষে কাজ করছেন। তার মতো গবেষকদের সহায়তায় কুসুন্দারা এখন নিজেদের একত্রিত আবাস বা 'একিক্রিত বাস্তি'র দাবি জানাচ্ছে। বট ও তার নেপালি গবেষণা সহকারী উদয় রাজ আলেয় এ নতুন আবাসের সম্ভাব্যতা পরীক্ষার জন্য তহবিলের খোঁজ করছেন বর্তমানে।
আদিবাসী ভাষা পুনরুজ্জীবিত করার অন্যান্য সম্ভাব্য সুবিধাও রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো গবেষণায় আদিবাসী ভাষা পুনরুজ্জীবিতকরণ এবং শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির মধ্যে সংযোগ থাকার কথা জানা গেছে।
কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব আদিবাসী সম্প্রদায়ে ৫০ শতাংশের কম মানুষ তাদের মাতৃভাষায় দক্ষ, সেগুলোতে তরুণদের আত্মহত্যার হার ছয় গুণ বেশি। অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি আদিবাসী গোত্রের ওপর করা গবেষণায় দেখা গেছে যেসব আদিবাসী মাতৃভাষায় কথা বলেন, তারা কম হারে পানাহার ও অবৈধ মাদক ব্যবহার করেন।
১৮ বছর বয়সী হিমা আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেন, 'আমার মনে হয় আমি কুসুন্দাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। নিয়মিত এ ভাষার চর্চা করলেই এটি টিকে থাকবে।' হিমা জানেন তিনি ভবিষ্যতে কী হবেন। তার লক্ষ্য একজন ভাষাশিক্ষক হয়ে মানুষকে কুসুন্দা শেখানো।
- সূত্র: বিবিসি