সাইবার অপরাধের শিকার ৫৫.২৭ শতাংশই অভিযোগ করে আশানুরূপ ফল পান না
সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগের পর ৫৫.২৭ শতাংশ ভুক্তভোগীই আশানুরূপফল পাননি। অভিযোগকারীদের মধ্যে মাত্র ৭.৪ শতাংশ আইনশৃগুলা বাহিনী দ্বারস্থ হয়ে আশানুরূপ ফল পেয়েছেন।
২০২১ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অভিযোগের পর আশানুরূপ ফল পেয়েছেন মোট ভুক্তভোগীর মাত্র ২২.২২ শতাংশ, যা ২০২২ সালের পরিসংখ্যানের তুলনায় ১৫.১৮ শতাংশ বেশি।
'বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ প্রবণতা-২০২২' শীষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
শনিবার (১৩ আগস্ট) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন।
জরিপে ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ০২ মার্চ পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ে ভুক্তভোগী ১৯৯ জনকে ১৮টি প্রশ্ন করা হয়। সেই মতামতের ভিত্তিতে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজের সভাপতিত্বে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন গবেষকদের মধ্যে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মনিরা নাজনীম জাহান।
১৯৯ জন ভুক্তভোগীর ওপর পরিচালিত এ জরিপে দেখায় যায়, মাত্র ৫৩ জন সমস্যা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহীনির কাছে গেছেন, যা মোট ভুক্তভোগীর ২৬.৬ শতাংশ। তবে এটি ২০২১ এর তুলনায় ৫.১৭ শতাংশ বেশি। এছাড়া পুরুষ অভিযোগকারীদের তুলনায় নারী অভিযোগকারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। নারী ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ১১.০৬ শতাংশ সমস্যা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েছেন এবং ৪৫.৭৩ শতাংশ আইনের আশ্রয় নিতে অনিহা প্রকাশ করেছেন।
ভুক্তভোগীদের আইনিব্যাবস্থা না নেওয়ার কারণের মধ্যে ভিন্নতা দেখা গেছে। বিষয়টিকে গোপন রাখতে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি সর্বোচ্চ ২১ শতাংশ ভুক্তভোগী। এছাড়া ১৭ শতাংশ ভুক্তভোগী সামাজিক ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য, ১৭ শতাংশ আইনিব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানি পোহাতে হবে, ১৭ শতাংশ অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না- এসব ভেবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী । অন্যদিকে, ২ শতাংশ ভুক্তভোগী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন আছে তা মনেই করেন না।
এতে আরও দেখায় যায়, ভুক্তভোগীদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন ৪৩.২২ শতাংশ। বাকি ৫৬.৭৮ শতাংশ ভুক্তভোগীর দেশে বিদ্যমান আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এরমধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে মানসিক হয়রানি। এবারের জরিপে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী কিছুটা বেড়ে ৫০.২৭ শতাংশ হয়েছে, যা গতবারের প্রতিবেদনে ছিল ৫০.১৬ শতাংশ।
এবার দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং বা তথ্য চুরি। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যাবহার করে অপপ্রচার চালানো এবং অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো।
এবারের জরিপে সাইবার অপরাধের তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, যার হার ২৩.৭৯ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ২৮.৩১ শতাংশ, যা এবারের তুলনায় ৪.৫২ শতাংশ বেশি। তবে চিন্তার বিষয় হলো, গতবারের প্রতিবেদনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা ছিল ১৬.৩১ শতাংশ। কিন্তু এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮.৬৭ শতাংশে, যা গতবারের তুলনায় ২.৩৬ শতাংশ বেশি।
এছাড়া, যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও (পর্ণোগ্রাফি) ব্যাবহার করে হয়রানি এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও (পর্ণোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানির পরিমাণ গতবার ছিল ৭.৬৯ শতাংশ, কিন্তু সেটি এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৪ শতাংশে এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা গতবারের প্রতিবেদনে ৫.৮৫ শতাংশ পাওয়া গেলেও এবার তা ১.০৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৯৩ শতাংশে।
করোনা মাহামারির কারণে বিশাল সংখ্যক মানুষ অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যাও বিপুল হারে বেড়েছে। জরিপ অনুযায়ী প্রায় ১৫.০৬ শতাংশ মানুষ অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এছাড়া প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ভুক্তভোগীদের মধ্যে বেশিরভাগ, ৮০.৯০ শতাংশেরই বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এরপরে রয়েছে ১৮ বছরের কমবয়সী ভুক্তভোগী এবং এই ভুক্তভোগীদের হার ১৩.৫৭ শতাংশ। তৃতীয়স্থানে রয়েছে ৩১ থেকে ৪৫ বছর বয়সের ভুক্তভোগী, যাদের হার ৫.০৩ শতাংশ এবং সর্বশেষ অবস্থান করছেন ৪৫ ঊর্ধ্ব ভুক্তভোগী, যাদের হার ০.৫ শতাংশ।