পদ্মা সেতুতে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম ব্যালাস্টলেস রেলপথ
দোতলা পদ্মা সেতুর ওপরতলা দিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। এবার নিচতলা দিয়ে চলবে রেল। গেল মাসে সেতু বিভাগ রেল কর্তৃপক্ষকে সেতু বুঝিয়ে দেওয়ার পর চলে যৌথ পরিদর্শন। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ শেষে চলছে সেতুর ওপর রেল লাইন বসানোর চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের কাজ। সেতুর উভয় প্রান্তেই ভায়াডাক্টে বসানো হয়েছে দেশের প্রথম ব্যালাস্টলেস বা পাথরবিহীন রেললাইন। মাওয়া-ভাঙা সেকশনে নান্দনিক ভাঙা রেল জংশনসহ ৪টি রেল স্টেশনের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। প্রতিদিন একের পর এক ট্র্যাক প্যানেল বসিয়ে দীর্ঘ হচ্ছে রেলপথ। রেললিংক প্রকল্পের কাজ শেষে রেল চলাচলা শুরু হলে জাতীয় উৎপাদন বেড়ে যাবে আরও ১ শতাংশ।
পদ্মা সেতুর রেললিংক প্রকল্পের মাওয়া-ভাঙা সেকশন সূত্র জানায়, সেতুর নিচতলার স্টিলের অবকাঠামোর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুর ওপর রেললাইন বসানোর প্রস্তুতিমূলক সব কাজ শেষ করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতুতে হবে ব্যালাস্টলেস রেললাইন। এতে সময় লাগতে পারে ৬ মাস। সেতুর জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তের রেলের ভায়াডাক্টের ওপর ব্যালাস্টলেস রেলপথের কাজ প্রায় শেষ। বাংলাদেশে ব্যালাস্টলেস রেললাইন এই প্রথম। মাওয়াপ্রান্তে ভায়াডাক্ট ২ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এর মধ্যে ১ দশমিক ১৭ কিলোমিটারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি অংশে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। জাজিরা প্রান্তের ভায়াডাক্ট ৪ দশমিক ০৩ কিলোমিটারের কাজ শেষ। ৬ দশমিক ৬২ কিলোমিটার ভায়াডাক্টের মধ্যে ওপর ট্র্যাক প্যানেল বসিয়ে কংক্রিটিং করে তৈরি হয়েছে রেললাইন।
কংক্রিটের স্পিলার তৈরি করা হচ্ছে ভাঙা রেল স্টেশনের পাশের কারখানায়। চায়না প্রযুক্তিতে সড়কের জন্য এক ধরনের এবং সেতুর জন্য একটু ভিন্ন ধরনের স্পিলার তৈরি করা হচ্ছে। স্পিলারের ওপর রেলপাত বসিয়ে ২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের এক একটি ট্র্যাক প্যানেল তৈরি হয়। প্যানেলগুলো সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। এরপর ট্র্যাকলিং মেশিনের সাহায্যে প্যানেলগুলো নিয়ে তৈরি হচ্ছে রেল চলাচলের পথ। ঢাকা-ভাঙা ৮২ কিলোমিটার দূরত্বের রেলের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। একের পর এক ট্র্যাক প্যানেল বসিয়ে দীর্ঘ হচ্ছে রেললাইন। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে ১৪ কিলোমিটার রেললাইন বাসানোর কাজ। পদ্মা সেতু রেললিংক প্রকল্পের আওতায় ১৭২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর ঢাকা-যশোর রেলপথ নির্মাণ কাজের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের রেলট্র্যাক ইনচার্জ আব্দুল হাই বলেন, "ব্যালাস্টলেস ট্র্র্যাক এবারই প্রথম বাংলাদেশে। ব্যালাস্টলেস ট্র্যাকের সুবিধা হলো, যাত্রা হবে আরামদায়ক। কোনো ঝাঁকুনি নেই।"
তিনি আরও বলেন, "সেতু ও ভায়াডাক্টের পরে ব্যালাস্টটেড রেল লাইন হচ্ছে। এতে পাথর আছে। এটাকে কোয়ালা ট্র্যাক বলা হয়। আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই কাজ শেষ করতে পারবো।"
পদ্মা সেতু রেললিংক প্রকল্পের আওতায় মাওয়া-ভাঙা অংশে হবে ৫টি স্টেশন। এর মধ্যে ভাঙায় নির্মিত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক ভাঙা রেল জংশন স্টেশন। স্টেশনগুলোতে থাকবে অফিস ভবনসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আবাসন ব্যবস্থা। পুরো উদ্যমে চলছে নির্মাণ কাজ।
জংশনের বিশাল এলাকাজুড়ে চলছে নানামুখী কর্মযজ্ঞ। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে মাটি ভরাট, ভবন নির্মাণ, পানি নিস্কাশনের সুব্যবস্থার কাজ। নতুন নকশায় আর প্রযুক্তিতে নির্মিত হচ্ছে অফিস, স্টেশন ও আবাসিকভবনসহ মোট ১৯টি অবকাঠামো। উন্নত দেশের আদলে নির্মাণ হচ্ছে ভাঙা রেল জংশন। নির্মিত হলে এটি হবে বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে আধুনিক জংশন। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রেলের সংযোগ ঘটাবে এই জংশন স্টেশন। ঢাকা-যশোর দীর্ঘ রেলপথে থাকবে ২০টি রেলস্টেশন। ১৬ টি স্টেশন নতুন করে নির্মাণ করা হবে, আর পুরোনো ৪টি স্টেশন ঢেলে সাজিয়ে করা হবে আধুনিক ও যুগোপযোগী।
এছাড়া, সেতুর দুই প্রান্তে নির্মাণ করা হচ্ছে ৪টি রেলস্টেশন। এরমধ্যে মাওয়া স্টেশনটি হবে তুলনামূলক নান্দনিক। দূর থেকে দেখতে মনে হবে এটি উন্নত দেশের রেলস্টেশন। মাওয়া স্টেশনের কাজ ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এছাড়া পদ্মা স্টেশনের কাজ এগিয়েছে ৭০ ভাগ। তোড়জোড় চলছে শিবচর স্টেশন নির্মাণের কাজও। এই স্টেশনের কাজও ৩০ ভাগ পর্যন্ত এগিয়েছে। এদিকে, ভাঙা স্টেশনের আধুনিকায়নের কাজও শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই।
পদ্মা সেতু রেললিংক প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক-১ (মাওয়া-ভাঙা সেকশন) ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাঈদ আহমেদ জানান, সেতুতে নানান ধরনের সার্ভে বা জরিপ চালানো হয়েছে। জরিপ থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত নকশার সঙ্গে সমন্বয় সাধনেরও কাজ চলছে।
"ভায়াডাক্ট-২ এর কাজ কিছু অংশ বাকি আছে, সেই অংশের কাজও শুরু হয়ে গেছে। ভায়াডাক্ট-৩ এর কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ৫টি রেল স্টেশনের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে দেশে সবচেয়ে আধুনিক রেল জংশনের কাজও পুরোদমে চলছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে", যোগ করেন তিনি।