কিউবান বিপ্লবের জাদুঘর
২৬ জুলাই, ১৯৫৩। নিজ দেশের স্বৈরশাসক সেনাবাহিনী প্রধান বাতিস্তার নির্মম শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবের অগ্নিশপথ নিয়ে মোনকাদা নামের এক সেনাব্যারাকে আক্রমণ করলেন একদল বিপ্লবী, নেতৃত্বে ফিদেল কাস্ত্রো নামের এক তরুণ আইনজীবি।
দেশমাতৃকার উপর চলমান দমন পীড়নের বিরুদ্ধে হাতের অতি অপ্রতুল সম্পদ নিয়েই ছোট ভাই রাউল ও অন্যান্য বন্ধুদের মন দ্রোহের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করেই সেই আক্রমণ থেকে বার্তা পৌছাতে চাইলেন শাসক গোষ্ঠী ও তাদের উপরওয়ালা মার্কিন বাণিজ্য কোম্পানিগুলোর কাছে।
পরবর্তীতে সরকারের কোপানলে পড়ে গ্রেফতারকৃত সকল বিপ্লবীর দীর্ঘ মেয়াদের সাজা হয়, স্বয়ং ফিদেলকে প্রহসনের বিচারে দেওয়া হয় ১৫ বছরের জেল। এবং কয়েক বছর পরই বিপ্লবের পরিকল্পনাকারী মূল যোদ্ধাদের রাজনৈতিক নির্বাসনে পাঠানো হয় মেক্সিকোতে, রুদ্ধ হয়ে যায় স্বদেশভূমিতে ফেরার সমস্ত পথ।
কিন্তু তারুণ্য, বিপ্লব আর দেশপ্রেমের সামনে কোন প্রতিকূলতায় যে অটল হয়ে থাকতে পারে না তারই প্রমাণ দিল যেন ফিদেল আর তার বন্ধুরা- ১৯৫৬র ডিসেম্বরে মাত্র ৮২ জন অকুতোভয় যোদ্ধা গ্রান মা নামের এক নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল কিউবার জলকাদাময় ম্যানগ্রোভ বনভূমির রাজত্বে।
স্বপ্ন গেরিলা যুদ্ধে করেই উৎখাত করবে বাতিস্তাকে, সঙ্গী হবে দেশের আপামর নিপীড়িত জনসাধারণ।
কিউবানদের সাথে যোগ গিয়েছেন আর্নেস্তো গুয়েভারা নামের এক আর্জেন্টাইন, যার ঝুলিতে আছে সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে ভাল ফলাফল করে গিনেস বুকে খোদাই করা ডাক্তার হবার বিশ্বরেকর্ড, কিন্তু কিউবানদের কাছে তার নাম কেবলমাত্র চে।
মহাপরিকল্পনা শুরু থেকেই বাধার মুখ দেখতে থাকে, গ্রান মা কিউবার উপকূলে ভিড়ে ঝকঝকে দিনের আলোতে, শুরু হয়ে সেনাবাহিনীর আক্রমণ।
নানা বাঁধা পেরিয়ে সিয়েরা মায়েস্ত্রো পর্বতে যখন গেরিলারা পুনর্মিলিত হন তখন তাদের সংখ্যা মাত্র ১২! সেই থেকে কি করে নিজেদের সংগঠিত করে, স্থানীয় জনগণকে সাথে নিয়ে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে মাত্র ২ বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদার সরকারের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাতিস্তাকে দেশ ছাড়া করল সে কাহিনী রূপকথাকে ছাড়িয়ে পরিণত হয়েছে কিংবদন্তীতে, সারা বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত জনগণের কাছে কিউবার বিপ্লব হয়ে গেছে মুক্তির প্রতীক।
কিউবার বিপ্লবের প্রায় সমস্ত নিদর্শনতো বটেই এমনকি সেই মোটরবোট গ্রান মা পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে ওল্ড হাভানায় অবস্থিত কিউবার বিপ্লব জাদুঘরে। চলুন ঘুরে আসি ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণ থেকে।
১৯২০ সালে নির্মিত সুরম্য ভবনটি বরাদ্দ ছিল কিউবার রাষ্ট্রপতির জন্যে(যদিও সেই সময় কিউবা সত্যিকার অর্থে কোন স্বাধীন দেশ নয় বরং আমেরিকার আধুনিক উপনিবেশ হিসেবেই পরিচিত ছিল সারা বিশ্বে), বাতিস্তা দেশ ত্যাগে বাধ্য হবার পরপরই ১৯৫৯ সালে বিপ্লব জাদুঘরে পরিণত করা হয় এই স্থাপত্যকে।
সিংহদ্বার দিয়ে ঢোকার পরপরই টিকিট কাটার কর্তব্য শেষ করে ( কিউবার সবখানেই স্থানীয়দের জন্য অতি সস্তা নামমাত্র দর্শনী আর পর্যটকদের জন্য বেশ কয়েক গুণ চড়া মূল্য) ঢুকে পড়লাম বিপ্লব পূর্ববর্তী কিউবার গ্যালারীতে, সেই সময়ের নানা আলোকচিত্র, দলিল দস্তাবেজ সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সাক্ষী। সেই সাথে আছে বাতিস্তার গুন্ডা বাহিনীর শিকার কয়েকজন বিপ্লবীর রক্তে রঞ্জিত পোশাক, ধারণা করা হয় কম পক্ষে ২০,০০০ মানুষ সেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল, বিশেষ করে মুক্তিকামী ছাত্ররা।
এর পরে আসে ২৬ জুলাই বিপ্লবের নানা মুহূর্ত, সাদাকালো আলোকচিত্রগুলো সব ধরনের জানা-অজানা রঙে উদ্ভাসিত হয়ে আমাদের সামনে সৃষ্টি করে যায় সেই বীরত্বগাথা।
এক কোণে দেখা যায় সিয়েরা মায়েস্ত্রোর দুর্গম পার্বত্য এলাকায় ব্যবহৃত রেডিও ট্রান্সমিটার। ডাক্তার চের ব্যবহৃত ফাস্ট এইড বক্স, গেরিলাদের টাইপ রাইটার, নানা অস্ত্র। আলোকচিত্রের সাথে সাথে সেই সময়ের নানা খবরের কাগজ, ম্যাপ, পতাকায় জড়িয়ে আছে যেন বারুদের উত্তেজনাময় গন্ধ।
পুরো একটা গ্যালারী উৎসর্গিত হয়েছে কিউবার বিপ্লবের অন্যতম দুই প্রধান বিপ্লবী ক্যামিলো সিয়েনফুয়েগোস এবং চে গুয়েভারার স্মৃতির প্রতি।
ক্যামিলো সিয়েনফুয়েগোস, কিউবার বিপ্লবের রাজপুত্র, ১৯৫৯ সালের সফল বিপ্লবের সময় ফিদেলের পরে সমগ্র কিউবায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। দুঃসাহসিক পরিকল্পনা, ক্ষুরধার প্রত্যুৎপন্নমতিতা তাকে পরিণত করেছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ গেরিলা নেতাতে, বিশেষ করে ইয়াগুয়েজের যুদ্ধে তার ভূমিকা এনে দিয়েছেল ইয়াগুয়েজের নায়ক খেতাব। মুক্ত কিউবাতে অন্তত দুঃখজনক ভাবে এক বিমান দুর্ঘটনায় সম্ভবত সাগরে সলিল সমাধি ঘটে ক্যামিলোর, তার বয়স হয়েছিল তখন কেবলমাত্র ২৭ !
বন্ধু ক্যামিলোর নামে ছেলের নাম রেখেছিলেন চে।
যে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন নিজেকে, মুক্তির সেই অমোঘ বাণী ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেশ ছাড়িয়ে মহাদেশে এবং বিশেষ করে পিতৃভূমি আর্জেন্টিনায়।
কিউবার মন্ত্রিত্ব ঠেলে পরে আফ্রিকার কঙ্গোতে বিপ্লব সংগঠনের প্রচেষ্টার পর বলিভিয়াতে গেরিলা যুদ্ধরত অবস্থায় সামরিক জান্তার হাতে সি আই এর প্রত্যক্ষ সহায়তায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন চে, যার সম্পর্কে দার্শনিক জ্য পল সাত্রে বলেছিলেন Che Ernesto Guevara is the Most Complete Human Being of Our Time।
এই গ্যালারিতে সযত্নে রক্ষিত আছে দুই বিপ্লবীর ব্যবহৃত অস্ত্র, পোশাক, টুপি, নানা স্মারক। সেই সাথে আলোকচিত্র ও তথ্যের সমাহার। ঘরের একপ্রান্তে আছে তাদের গেরিলাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের প্রমাণ আকারের ভাস্কর্য।
উল্লেখ্য কিউবার অন্যতম বৃহত্তম নগরী সান্তা ক্লারা দখল মুক্ত করতে এই দুই গেরিলা নেতার নেতৃত্বাধীন সেনারা কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে যুদ্ধ করে। দুইজনই আজ অমর মুক্তিকামী মানুষের মনে, সেই জন্যই হয়ত তাদের স্মৃতির অবস্থান একসাথে যেমন বিপ্লব জাদুঘরে তেমন হাভানার বিখ্যাত বিপ্লব চত্বরেও। এরপরে এক ফাঁকা জায়গায় ফিদেল, চে, ক্যামিলোর ধাতব ভাস্কর্য।
তারপরই রাষ্ট্রপতির চেম্বার, আলাদা টিকিট কেটে সেখানে দেখা গেল সাবেক রাষ্ট্রপতি ব্যবহৃত টেবিলের পিছনে কিউবান স্বাধীনতার আন্দোলনের পুরোধা কবি হোসে মার্তির ভাস্কর্য, এক কোণায় বাতিস্তার দুর্নীতি আর বিলাসব্যসনের প্রতীক সোনার প্রলেপ দেওয়া টেলিফোন।
এর পরে বিশেষ একখানা ঘর, যেখান অনুষ্ঠিত হয়ে ছিল সেনাদখলমুক্ত কিউবার নবসরকারের প্রথম দিকের গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলো। ঘরের আসবাবপত্র ও সাজসজ্জা ঠিক তেমনই আছে যেমন ছিল সেই উম্মাতাল যুগ সন্ধিক্ষণে, ভাবা যায় এই ঘরেই সামনের টেবিল ঘেরা চেয়ারে বসে ছিলেন একসময়ে ফিদেল, চে, রাউল, হুয়ান আলমেইদা!
চিন্তা করতেই রোমাঞ্চে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।
এরপরে বিপ্লবের নানা গ্যালারী পার হয়ে বিশেষ করে ফিদেলে ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে তার গেরিলা যুদ্ধে ব্যবহৃত জিনিসের বিশেষ প্রদর্শনী দেখে আমরা রওনা দিই জাদুঘরের অন্য অংশে। সেখানে আছে গেরিলা যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত বেশ কিছু জিপগাড়ী, ভূপাতিত এক মার্কিন বিমান ও অন্যান্য যুদ্ধযান। আর এদের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে গ্রান মা!
সেই মোটরচালিত নৌকা যাতে করে গেরিলা দল পা রেখেছিল কিউবার মাটিতে, আজ তা পূর্ণ মর্যাদায় সংরক্ষিত। গ্রান মার পাশেই বিপ্লবের নায়কদের উদ্দেশ্যে প্রজ্জলিত অগ্নিশিখা, যা স্মরণ করে যাচ্ছে মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের সূর্যসন্তানদের।
যে লড়াই এখনো থামে নি, যে বিজয় এখনো সুদূর পরাহত, যে লড়াই নিয়ে চে গুয়েভারার বক্তব্য ছিল- জীবন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। এই জীবন সে পায় মাত্র একটি বার।
তাই এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবন যাপন করার যন্ত্রণা ভরা অনুশোচনায় ভুগতে না হয়, যাতে বিগত জীবনের গ্লানিভরা হীনতার লজ্জার দগ্ধানি সইতে না হয়, এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর মুহূর্তে মানুষ বলতে পারে- আমার সমগ্র জীবন, সমগ্র শক্তি আমি ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্য- মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামে।।
(আজ ফিদেল ক্যাস্ট্রোর জন্মদিন, নিজের ব্যক্তি জীবনে সফলতার চেয়ে তিনি সবসময়ই চেয়েছেন আদর্শের প্রচার ও টিকে থাকা। উনার সেই প্রচেষ্টা ও বিপ্লবের প্রতি শ্রদ্ধা)