রঙের মাশুল: যেখানে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বিবর্ণ জীবন!
প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করেন মোহাম্মদ হাসান এবং পরবর্তী ১২-১৪ ঘন্টা তাকে রঙ মেশানো পানিতে হাত ডুবিয়ে কাজ করতে হয়। কোন মৌসুমে কোন ফ্যাশন ট্রেন্ড চলছে তার উপর ভিত্তি করে মেটে-গেরুয়া থেকে শুরু করে লাল, নীল, সবুজ ইত্যাদি বাহারি রঙ নিয়ে তার কাজ। কখনো কখনো রঙের মধ্যে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণে হাসানের হাত জ্বালাপোড়া করে। কিন্তু কুছ পরোয়া নেহি! নারায়ণগঞ্জের পুরিন্দা গ্রামের আরো শত শত ডাইং কারখানা শ্রমিকের মতো তিনিও এসব কাজে অভ্যস্ত।
পুরিন্দা'কে বলা হয় 'রঙ এর গ্রাম'। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামে পৌঁছালেই দেখা যাবে হরেক রকমের রঙে রাঙানো সুতা শুকোতে দেওয়া হয়েছে এদিক-সেদিকে। তারই একপাশে ডাইং কারখানায় হাসান ও তার সহকর্মীরা মিলে লবণ, এসিড ও ইমালসিফায়ার সেদ্ধ করে তৈরি করছেন বিভিন্ন রঙ।
হাসান বলেন, "সুতায় লাল রঙ করতে আমরা প্রথমে ৩-৪টি রঙ একসাথে মেশাই। তারপর ওই মিশ্রণের মধ্যে সুতা ডুবিয়ে কিছুক্ষণ ঘষি। তারপর আবার একটা রঙের মিশ্রণে সুতার বান্ডিল ডুবিয়ে রাখার পর সেটা লাল হয়।"
জানা যায়, ডাইং কারখানায় কাজ করে মোহাম্মদ হাসান মাসে ২২,০০০ টাকা আয় করেন। তার ভাষ্যে, "এই কাজটা অনেক কষ্টের। কিন্তু খেয়েপরে বেঁচে থাকতে হলে আমাকে এই কাজ করতেই হবে। আমার হাতে আর কোনো উপায় নেই। এই কাজ যেহেতু শিখে গেছি, এখন এই করেই খেতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "যখন তরুণ বয়স ছিল তখন জীবনকে ভালোভাবে গড়তে পারিনি। তাই এখন আর সুন্দর-রঙিন জীবনের স্বপ্ন দেখি না।"
আজ থেকে ৫০ বছর আগে, নিতান্ত কিশোর বয়সেই পুরিন্দার এক ডাইং হাউজে কাজ করা শুরু করেছিলেন মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। তিনিও স্বীকার করেন, প্রতিদিন খালি হাতে কড়া রাসায়নিক পদার্থ ও রঙের সংস্পর্শে আসার ফলে তার চামড়ায় ঘা হয়ে যাচ্ছে।
"এটা খুবই কষ্টের কাজ। আমি হয়তো অন্য কাজও করতে পারবো। কিন্তু এই কাজ শিখে গেছি বলেই এখনো এটাই করছি", বলেন শফিকুল।
তবে ডাইং এর কাজ করার ফলে শুধু যে ত্বকের ক্ষতি হচ্ছে এখানকার কর্মীদের, তা নয়। নারায়ণঞ্জের প্রধান সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এএফএম মুশিউর রহমান জানান, আড়াইহাজার উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থিত ডাইং কারখানাগুলো কোনো স্বাস্থ্য প্রটোকল মেনে চলে না। রঙ এর সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকে বাঁচতে তাদের কোনো সুরক্ষামূলক কাপড় বা গ্লাভসজাতীয় কিছু নেই এবং যেসব রঙ তারা ব্যবহার করে, সেগুলো ত্বকের পাশাপাশি ফুসফুসেরও ক্ষতি করে।
ডা. মুশিউর রহমান বলেন, "ফুসফুসে ইনফেকশন থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে তাদের। এসব কারখানার কর্মীরা ব্রঙ্কাইটিস, কফে ভোগে। আমরা দেখেছি যে এদের মধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বেশি।"
কিন্তু গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ে কারখানা মালিক ও কর্মীদের নেই কোনো সচেতনতা। পুরিন্দার একটি ডাইং কারখানার মালিক মোহাম্মদ শাহজালাল প্রধান স্বীকার করেন এই খাতে কিছু 'সীমাবদ্ধতা' আছে। তিনি বলেন, "আমরা যেসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করি সেগুলো থেকে বাজে গন্ধ বের হয়। কোনো কোনো কর্মীর শরীরে অ্যালার্জি হয়ে যায়।"
টেক্সটাইল বাংলাদেশের প্রধান শিল্প খাত এবং ডাইং কারখানাগুলো এরই একটি অংশ। এই মুহূর্তে দেশের ৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ টেক্সটাইল খাতে কাজ করছে। দেশের মোট জিডিপিতে এই খাতের অবদান ১১ শতাংশের বেশি এবং মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগই আসে তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে।
কিন্তু ডাইং হাউজগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসার স্বীকৃতি না দেওয়ায় এখানে নিয়মনীতির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ফলে নিয়ন্ত্রকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কারখানা মালিকেরা যা খুশি তাই করতে পারেন, যদিও এই কারখানাগুলো দশকের পর দশক ধরে টিকে আছে।
নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের প্রেসিডেন্ট সেলিম মাহমুদ বলেন, "এসব কারখানার কর্মীদের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক হিসেবে ধরা হয়। তাদের কর্মক্ষেত্রে কোনো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেই।"
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ডাইং কারখানাগুলোর এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানেই না। আড়াইহাজার উপজেলার প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, "এ ধরনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আছে কিনা তা প্রশাসনের জানা নেই। সাধারণত, আমরা এ ধরনের কারখানাগুলোর তদারকি করি না। আমাদের কাছে এ ব্যাপারে এখনো কেউ কিছু জানায়নি।"
সূত্র: আরব নিউজ